শুক্রবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৯

পাথরের ঘ্রাণ!

কেন চলে গেলে দূরে, ভাসায়ে মোরে সুরে
কেন ফিরে এলে আবার, বাড়াতে দুখের ভার।
কোন কোন গান কেমন অন্তরের ভেতরে শিকড় গেড়ে ফেলে, ভাবলে অবাক হতে হয়!
*
ছোটবেলায় বাসার সামনে একটা পাকা রাস্তা ছিলো। সেই রাস্তার পাশে পিচ আর আলকাতরা মেশানো দুয়েকটা পাথর দেখা যেতো। ঠিকমতো জোড়া লাগেনি তারা। বিকেলের দিকে আমি সাইকেল চালাতে শিখে সেই রাস্তাগুলো দিয়ে অনবরত ঘুরে বেড়াতাম। নিরাপদ, শান্ত কলোনি। কবে যেন মায়ের নিশ্চিত ঘুমের ফাঁকে বিকেল পড়ার আগেই দাউদাউ রোদে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। পিঠের ওপর রোদকে পুড়ানোর কাজে চাকরি দিয়ে আমি বেশ আরামেই সাইকেল চালাচ্ছি। পনেরো কি বিশ মিনিটের মাথায় দমের অভাব আর ঘামের প্রাচুর্যে থামতেই হলো। রাস্তার পাশে ঘাসের ওপর সাইকেল কাত করে রেখে দিয়ে বসে পড়লাম। হাঁপাচ্ছিলাম, কিছু একটা করতে হয় বলে ঘাস টেনে টেনে ছিঁড়ছি, সেসময় চোখ গেলো খুলে আসা কিছু পাথরের দিকে। ফ্যাকাসে ধুলোর মধ্যে পড়ে আছে চুপচাপ। হাতে উঠিয়ে ঠুকোঠুকি, গোল গোল খেলা শুরু হলো। দম ফিয়ে এলে আর ঘাম শুকিয়ে গেলে, হাফ প্যান্টের পকেটে পুরলাম। সাইকেল ঠেলে বড়ো মাঠে গিয়ে ক্রিকেট কি ফুটবল দেখেছি মনে পড়ে। ছোট পকেটের ভেতর তখন পাথরে পাথরে মিলমিশ।

**
আমার গন্ধ বিষয়ে খুব আগ্রহ। কোনকিছুর গন্ধ শুঁকলে একটা অবয়ব টের পাই মাথায়, স্মৃতির খাতায় কোন একটা অব্যাখ্যাত প্রক্রিয়ায় কোন কোন সূত্র লেখা আছে সবকিছুরই!
মায়ের ঘরে গেলেই একটা আবছা কিন্তু প্রবল গন্ধ পাই! মায়ের কাঁথা জড়িয়ে নাকের কাছে ধরলে অজান্তেই চোখ বুঁজে আসে। খুব শান্তির ঘুম পায় আমার...। তেমনি জানি আমার বালিশেও একটা নিজস্ব গন্ধ ছড়িয়ে আছে। তারপরে ধরা যাক, কাঠের টেবিল বা বাসার দরজার সামনে রাখা টবের গাছগুলোর একটা মাদকভরা গন্ধ আছে, আমাকে টেনে ধরে মাঝে মাঝেই। কুড়িয়ে তোলা সেই পাথর দুটোকেও আমি প্রায়ই হাতে নিয়ে শুঁকতাম। প্রথম দিকে ধুলোমেশা পাথুরে একটা গন্ধ পেতাম। ধীরে ধীরে বাইরের ধুলো কমতে শুরু করলো, আর জমতে থাকলো আমার ঘরের গার্হস্থ্য-ধুলোর আস্তরণ। পাথুরে সেই গন্ধটা কিন্তু পুরোপুরি গেলো না। টেবিলের ড্রয়ারের কোণে রেখে দেয়া পাথরের গায়ে এমন কী গন্ধ পেতাম আমি, কে জানে!

সবকিছুই একটা সময়ে পুরনো হয়। আমার এই অকারণ গন্ধশীলনও কেমন কেমন করে অনভ্যস্ত আচরণ হয়ে গেলো। ভুলে গেছি আমি সেই পাথরদুটোকে। জীবন ব্যস্ত হয়েছে, আমি তার চেয়েও ব্যস্ত হয়েছি। ঝিনাইদহে পড়তাম, ছুটিছাটায় বাসায় আসা হতো। একেবারে চলে আসার সময়ে ও'দুটো পাথর ব্যাগে করে আমিই এনেছিলাম মনে হয়। বাসার বদলেও আমার অজান্তেই সেগুলো তল্পিতল্পার সাথে গুটি গুটি পায়ে চলাচল করেছে। আর সবশেষে আমার ঘরেই তাদের ঠিকানা হয়েছে। আমার আর পুরনো এই পাথরদুটোর কোন দরকার পড়ে না। চারপাশে কতো অসংখ্য গন্ধের উপাদান!
কলেজের পরে এলো বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে সিঁড়ির গন্ধ আর করিডোর পেরিয়ে ক্লাসে ঢোকার পরে যে মৃদু সুবাস পেয়েছিলাম- তা খুব সহজেই মাথায় গেঁথে যায়! সেদিনই প্রথম জানলাম, "মৃদুতার তীব্রতাই বেশি!" তবে পড়ার চাপে, আর কিছুটা পরীক্ষার ভীতিতে মৃদুসুবাস উড়ে গেলো। কলমের কালি হাতের আঙুলে লেপ্টে যেতে লাগলো, সেই হাত ধোয়ার পরেও সেই গন্ধটা যায় না। একটা সময়ে পাট চুকে গেলো ওখানে। চার বছরের শিক্ষা আর এক বছরের অযথা-অলস "পরীক্ষা-পেছানো-ছুটি" কাটিয়ে পাশ করলাম। চাকরি করতে গিয়েও নতুন ধরনের ব্যস্ততা। রোজ যেতে হয়, চাইলেই অলস অনাগ্রহে এড়ানো যায় না- এ এমনই এক গ্যাঁড়াকল। ছুটির দিনগুলোতে ঘুম চেপে ধরে বিছানার সাথে। "ঘুমা ঘুমা, কালকেই আবার অফিসে যেতে হবে।"
রোজ সকালে পরিপাটি হয়ে যেতে হয় কাজে। জিন্‌স আর টি-শার্টের জায়গায় ঘন ঘন পড়তে হয় শার্ট-প্যান্ট-জুতো। দাড়ি কাটতে হয় দু'তিনদিন যেতে না যেতেই। বন্ধুদের উপহারের সুবাদে কয়েকটা বিদেশি পারফিউমও আমার ঘরে আশ্রয় পেলেন। মাঝে মাঝে তাদের মাথা খুলে শরীরে ছিটাই, ঝাঁকিয়ে নেই। ভুরভুরে সুবাসটুকু ভালোই লাগে। তারপরে ফেরার সময়ে রিকশা-সওয়ার হলে সারাদিনের পরে মুছে যাওয়া সৌরভের জায়গায় জেঁকে বসে ঘাম-ধুলো-ক্লান্তি। রিকশাওয়ালা প্যাডেল টানে, আমি মুছে যাওয়া আলোতে, গাঢ় আধারে নানারকম হিসাব মেলানোর চেষ্টা করি। বেশিরভাগই মিলে না। আর মিলে না বলেই অসমাপ্ত হিসাবটুকু পরের দিন চলতে থাকে। রিকশাওয়ালা কিছু টের পান না, জানা কথা। তার হিসাব আরো অনেক সরল এবং কঠিন, জবাবশূন্য এবং জ্ঞাত।
***
জীবনের নিয়মই বোধহয় এমন যে আমরা যা হারিয়ে ফেলি তার শোক ঠিকভাবে বুঝে ওঠার সুযোগ সে আমাদের দেয় না। বেশি কিছু না, নিতান্তই ব্যক্তিগত ক্ষয়ক্ষতি এটুকুই আমরা ঠিকমত মনে রাখতে পারি না। প্রাপ্তিও প্রচুর থাকে হয়তো, অন্তত আপাত-প্রাপ্তির মতো ব্যাপারগুলো উপশমের কাজ করে খুব। তাই হারিয়ে যাওয়া মানুষ, স্মৃতি বা হৃদয়-সম্পদের জন্যে শোকটাও স্তিমিত হয়ে আসে। আর সেটা আসে বলেই নতুনভাবেই আমরা আঘাত সহ্য করতে পারি!

স্মৃতির স্বভাবও গন্ধের মতো হয়ে গেছে, দ্রুত ভুলে যাই সবকিছু। আজকে আমার সব অলসতার গায়ে আগুন ধরাতে সকাল সকাল মা চিৎকার শুরু করলো। "ভাদাইম্যা পুলা। কাজকাম নাই। পড়ে পড়ে ঘুমায়। ওঠ্‌! ঘর গুছা। দুইদিন পরে ঈদ, ঘরের কী অবস্থা! টেবিল চেয়ারে ধুলা। এই ঘরে কি মানুষ বাস করে?" গলাবাজির তোড়ে ধুপধাপ উঠে বসি। তারপরে চোখ কচলে মুখ-হাত ধুয়ে চারদিকে তাকিয়ে মনে হয় আসলেই অনেক ধুলো জমে গেছে! একটা ন্যাকড়া নিয়ে ধুলো ঝাড়া শুরু করি। বইগুলো এলোমেলো, গুছালাম। রাজ্যের সিডি, ডিভিডি পড়ে আছে খোলা, একটা একটা করে প্যাকেটে পুরে আলমারিতে ভরলাম। বিছানা-বালিশের চাদর, ওয়াড় গেলো ধোবার জায়গায়, তারপর ঘর ঝাঁট আর মোছা। একেবারে শেষে, টেবিলের ওপরে খাতা, কাগজ, হেডফোন, চার্জার -ইত্যাদি নানাপদের জিনিস গুছাতে শুরু করলাম। খুব পরিপাটি করে এনেছি, এমন সময়ে ড্রয়ার গুছাতে গিয়ে হাতে পাথরদুটো ঠেকলো।
এক মুহূর্তের থমকে যাওয়া। নিঃশ্বাস নেই। হাত টেনে বের করে আনি জোড়াভাইকে। হাতের মুঠোয় বিবর্ণ ধুলোমাখা, ধূসর পাথর! নাকের কাছে নিয়ে খুব ধীরে শ্বাস টেনে নিই। অপরিচিত গন্ধ এসে ধাক্কা দেয়। বহুদিন পরে কারো সাথে দেখা হলে যেমন মনে হয়, "কোথায় যেন দেখেছি", সামনাসামনি দাঁড়িয়ে যেভাবে আমরা অপ্রস্তুত হই কিছুটা, সেরকম একটা অনুভূতি হতে থাকে আমার। পাথর নিশ্চুপ, আমিও। নির্বাক যোগাযোগেও কোন আলোড়ন ওঠে না মনে। এরপর আমার ঠিক কী করা উচিত তা বুঝে উঠতে পারি না। দ্বিধায় দোল খেতে খেতে পাথর দুটোকে আবার ড্রয়ার-গহীনেই রেখে দেই।
ড্রয়ার বন্ধ করে দেয়ার পরে বুঝতে পারি আমি নিজের কাছেই অপরিচিত হয়ে গেছি। হাতের তালুতে করে নাড়াচাড়া করা সেই দুটো অমূল্য পাথর আসলে আমি হারিয়েই ফেলেছি! এখানে যা আছে, তা কেবল স্মৃতিভার, কেবল ক্ষয়াটে আলোর মত ভ্রম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন