শুক্রবার, ১১ নভেম্বর, ২০১১

চোখ নিয়ে কিছু চোখা কথা

ঈদের ছুটি শেষ হয়ে এলো। আগামিকাল থেকে আবার চিরপুরাতন নিয়মে ফিরে যাবো। বাসায় কিছু ডিজিটাল যন্ত্র যন্ত্রণা দিচ্ছিল - প্রিন্টার প্রিন্ট করে না, ল্যাপটপের মাইক্রোফোন বিদ্ঘুটে শব্দ করছে, এইসব। তো, এগুলো নিয়ে আইডিবি গেলাম, তারপর দুপুরে লাঞ্চ সেরে ভাবলাম পুরান ঢাকার দিকে যাই। বিউটির শরবতের নাম শুনেছি, খাওয়া হয় নি। হল-এ থাকতে কেউ একবার আওয়াজ দিলেই হতো, এখন তো আয়োজন করে এদিকে আসতে হয়। তাই ভাবলাম, ঘুরে আসি। বঙ্গবাজারের চৌরাস্তা থেকে আরেকটু ভিতরে যেতে হয়, গাড়ি রেখে হেঁটেই যাচ্ছি। একটু চিকন রাস্তা, দুইদিক থেকে রিকশা চলছে। পাশে ফুটপাতও নেই, তাই সামলে সুমলে হাঁটছি। আমার সামনেই একটি মেয়ে হাঁটছিল, সাধারণ সালোয়ার কামিজ পরা। আমি একটা প্রজেক্ট নিলাম। অপরদিক থেকে যারা হেঁটে আসছে, তাদের সবার চোখের দিকে খেয়াল করবো। প্রথমেই শাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা-টুপি পরা একজন লোক, দেখলাম তিনি এগিয়ে আসছেন এবং আমার সামনের মেয়েটিকে পেরুনোর আগে আগাপাশতলা যেন স্ক্যান করে ফেললেন। একটু চমকে গেলাম, পোশাক-আশাক যে মানুষকে ভাল বানাতে পারে না সেটা আবারও বুঝলাম। র‍্যানডম স্যাম্পল হিসেবে মাত্র একজনকে দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া ঠিক না, তাই ভাবলাম, আরেকটু দেখি। এলেন আরেকজন, লাল-কালো চেকশার্ট পরনে, মধ্যবয়স্ক, মাথায় চুল কম, খানিকটা মোটা, তিনিও দেখলাম যাবার সময় এক ঝলক চোখ বুলালেন। এলো আরেকজন, ইনি লুঙ্গিপরিহিত, চোয়ালভাঙা চেহারা, তিনিও মেয়েটির মুখের দিকে তাকালেন আর তারপর বুকের দিকে। না, প্রিয় পাঠক, মেয়েটি ওড়না পরেই ছিলেন, শুধু তাই না, ওড়নাটি "ঠিকভাবেই" পরে ছিলেন। তারপরেও এই স্ক্যানিং।

মোড় থেকে দোকান পর্যন্ত দূরত্ব যতোটুকু, সেখানে আমি প্রায় দশজনকে দেখলাম মেয়েটিকে ক্রস করলো। তাদের সকলেই, হ্যাঁ, সকলেই একইভাবে তাকে স্ক্যান করেছে। যেন এদের সবাইকে স্কুলে পড়ানো হয়েছে "যে কোন নারীকে রাস্তায় পার হবার নিয়মাবলী"। যেমন আমাদের শেখানো হতো রাস্তা পেরুনোর নিয়ম – “প্রথমে ডানে দেখুন, তারপর বামে, তারপর আবার ডানে দেখে রাস্তা পার হউন”। ঠিক তেমনি, “আপনার উল্টোদিক থেকে কোন নারী হেঁটে এলে প্রথমে তার মুখের দিকে তাকান, তারপর তার বুকের দিকে তাকান, তারপর তার শরীরের অন্য কোন অঙ্গ যথা কোমর, পাছা, উরু, পা ইত্যাদি নিয়ে আপনার ফেটিশ থাকলে সেদিকে তাকান, তারপর তাকে পেরিয়ে যান”। এই নিয়মাবলীর সাথে সতর্কতা হিসেবে থাকবে –

কোনো অবস্থাতেই মেয়েটিকে দেখতে গিয়ে সামনের দিকের খেয়াল হারাবেন না, কোন গাড়ি বা ট্রাকের তলায় চাপা পড়ে ভবলীলা সাঙ্গ হতে পারে।

আমি আরো একটু এগিয়ে চিন্তা করলাম। এই দাড়িটুপিওয়ালা লোকটি বাসায় ফিরবে, তার যা বয়স তাতে বিবাহিতই হবেন। তিনি নিশ্চয়ই ধর্মমতে বিয়ে করেছেন, বউয়ের সাথে সহবত করবেন এবং সে'সময় তার মাথায় এই মেয়েটির কথা ভেসে উঠবে। এমন হতে পারে যে তার বউ গ্রামের বাড়িতে আছে, সেক্ষেত্রে তিনি বাসায় বা মেসে ফিরে টয়লেটে পায়খানার ওপর বসে হাত মারবেন। তারপর বাসায় ফোন করে বউ ও বাচ্চাদের খবরাখবর নিবেন। রাত্রে আবার উত্তেজনা এলে হাত মেরে ভাত খেয়ে ঘুমাতে যাবেন। একই সূত্রে লাল-কালো শার্ট পরিহিত ব্যক্তি কিংবা পরের ব্যক্তিগুলোও নিশ্চয়ই তাদের নিজ নিজ কাম-চরিতার্থ করবেন। কেউ বউকে, কেউ প্রেমিকাকে, কেউ গণিকাকে লাগিয়ে ঠাণ্ডা হবেন। নভেম্বর এসে গেল, তবু তাপমাত্রা কমলো না!

আমার চিন্তার দৌড় এই অবধি এসে থেমে গেলে আমি খুশি (!) হতাম। বাস্তবে যা দেখি, সেটা আরো খারাপ। এভাবে ওড়নার ফাঁকফোকর দিয়ে স্ক্যান করতে করতে এদেরই কেউ কেউ সন্ত্রাসী হয়ে ওঠেন। অবদমিত তীব্র কামনা সামাজিক ভগিজগি মানে না। মগজে প্রশ্ন ওঠে, "কিসের সমাজ, কিসের আইন, এই মাইয়ামাগী সব দ্যাখায়া চলতাসে ক্যান?" তখন তারা রাতের অন্ধকার, কিংবা নির্জন জায়গা পেলে আক্রমণ করে ধর্ষণ করেন, কিংবা ভীড়ভাট্টার সুযোগ নিয়ে নিদেনপক্ষে নারীর শরীরে হাত চালান, পাছায় বা বুকে একটা টিপ দিলাম - আহ!

অনেকে এহেন আক্রমণের পরে মেরেও ফেলেন, কী দরকার প্রমাণ রেখে? আমার কেন জানি মনে হয় মেরে ফেলে ভালই হয়। সুবিধা নানাবিধ। এই যেমন ধর্ষিতাকে যে পরিমাণ সামাজিক নোংরামো ও কৌতূহলের শিকার হতে হয়, সেটা থেকে রেহাই মেলে। আবারও ধর্ষিত হবার ঝুঁকি কমে যায়। পাশাপাশি, দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা একজন কমে গেল। কী চমৎকার, তাই না!

ধর্ষণের খবর জেনে আমরা যারা আহা-উহুঁ করি, কিংবা ক্ষেপে উঠি, কিংবা সরকারের মুণ্ডপাত করি, তারা সবাই-ই এহেন স্ক্যানিং করে থাকি। এখানে স্বীকার করার দরকার নাই রে ভাই। আবার অস্বীকার করারও দরকার নাই। যার যার স্ক্যানিং, তার তার কাছে। আপনি নিজেই জানেন আপনি কবে কোন মেয়ের দিকে কোন চোখে তাকিয়েছেন। আর এটা জানেন বলেই আপনার মতো চোরের বড়ো গলা শোনা যায়! আপনি ক্রমাগত দোষের তীরটি ঐ মেয়েটার দিকে তাক করছেন। তার জামাকাপড়ের দিকে, তার চলাফেরার দিকে, এমনকি তার আচার-আচরণের দিকেও! যদিও আপনি জানেন যে আপনার নজর ঠিক নাই। আপনার হাঁটাচলা, বানরের মতো ব্রেইনে চলমান যৌনচিন্তা ঠিক নাই। এগুলো অসুস্থ। সারাক্ষণ সেক্স-ডিপ্রাইভড হতে হতে আপনার চিন্তা ও চেতনা খালি ধোনের গোড়ায় ঘুরঘুর করে।

এই নোংরামো কীভাবে দূর হবে? আমি দুটো পথের কথা ভাবছি। এতোদূর যখন পড়েই ফেলেছেন, আরেকটু ধৈর্য ধরে সেই দুটোর কথাও শুনুন।

প্রথমটি মেয়ে তথা নারীদের জন্য। ‘অবলা’, ‘গৃহিনী’, ‘মায়ের জাত’ ইত্যাদি ফালতু সেন্টিমেন্টাল বিশেষণ তো শুনেছেন। আপনি কি নিজেকে সেটাই মনে করেন? আপনি কি মনে করেন যে আপনার জন্ম হয়েছে একজন ঊন-মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে, যে সারাজীবন অন্য পুরুষের নজর এড়ানোর জন্য ঢেকেঢুকে তাঁবুর ভিতরে ঢুকে বসবাস করবে? কিংবা আপনি মনে করেন, যে সর্বংসহা ইমেজটি ২০ বা ৩০ বছরে গড়ে তুলেছেন – এটাই আপনার জীবনের সেরা(?) কীর্তি। আপনি পড়াশোনা করেছেন, ইন্টারনেট ও ফেসবুক ব্যবহার করতে পারেন। অর্থাৎ আপনার একটি ব্রেইন আছে। কেবল লিঙ্গ নারী বলে আপনি ব্রেইন ব্যবহার করেন না, অন্যে যা বলে, বইয়ে উপন্যাসে যা শেখায়, সেই নারীরূপটাই আপনার কাছে সব। আপনি যে একটা মানুষ এবং অন্য আরেকটা পশু যে আপনার উপরে হামলা করলে তাকে পালটা আঘাত করার শক্তি ও অধিকার আপনার আছে, তা আপনি ভুলে গেছেন। হয়তো সারাজীবনে শিখেনও নাই। এর মূল দোষ সমাজের এবং আপনার পরিবারের, আর খানিকটা দোষ আপনার নিজেরও বটে। আপনার উপর দিয়ে ইচ্ছামত মাড়িয়ে একজন টয়লেটে গিয়ে হাত মারে, এই চিন্তাটা কি মাথায় আগুন ধরিয়ে দেয় না? দিলে আপনি কতো বড়ো কাওয়ার্ড* যে সেটা দূর করতে কোন চেষ্টাই করেন নাই (*এই শব্দটার বাংলা ‘কাপুরুষ’। হায়! ভাবখানা এই যে নারী তো এমনিতেই কাওয়ার্ড, তার জন্য আবার আলাদা শব্দ লাগবে কেন? পুরুষ হবে সাহসী, তাই কেউ যদি সাহসী না হয়, তবে সে পুরুষই নয় = কাপুরুষ!)  ভাবুন। এই আক্রমণ, এই নীরব ধর্ষণ ঠেকাতে আপনি কী করতে পারেন, ভাবুন। খুলির ভিতরে ব্রেইনে দুয়েকটা ভাঁজ ফেলেন। ফেসবুকে শাহরুখ খানের প্রোফাইলে সাবস্ক্রাইব না করে একটু গুগল করুন বিদেশে মেয়েরা নিজেদের সেল্ফ‌ ডিফেন্সের জন্যে কী কী ব্যবস্থা নেয়। সেগুলোর কয়েকটা ব্যবস্থা সময় নিয়ে গড়ে তুলতে হয়, আর কয়েকটা পন্থা একেবারেই সহজ। সামান্য একটু সাহস আর বুদ্ধি কাজে লাগাতে পারেন এই বিষয়ে?

দ্বিতীয় পথটি পুরুষদের জন্য। এই বদমায়েশি থেকে শুরু করে নোংরা আক্রমণ, গ্রোপিং ও ধর্ষণ পর্যন্ত অপরাধগুলো যারা ঘটান, তাদের বাইরে হয়তো অনেকে আছেন, যারা একজন মেয়েকে মানুষ হিসেবে সম্মান দিতে শিখেছেন। অনেক পরিবারে ছেলে ও মেয়েকে সমান অবস্থান শেখানো হয়, পরষ্পরকে কেবল মানুষ হিসেবে যে সম্মান দেয়া উচিত, সেটা সেখানো হয়। বিবর্তিত হতে হতে আমরা হোমিনিড থেকে হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতি হয়েছি, আর আদিম জিনের নিয়ন্ত্রণ করার নিয়মও শিখেছি। সাধারণ ভাষায় এটাকে বলে সভ্যতা, ভব্যতা, সৌজন্যবোধ। এগুলো হারিয়ে ফেলা ওই দাড়িটুপি, লালশার্ট, লুঙ্গি পরা আদিম জিনের বাহকদের বিলুপ্তি হওয়া দরকার। শুভবুদ্ধির উদয় তাদের আদৌ হবে কি না জানি না, তবে যারা অন্তত এই নোংরামোর বিপক্ষে, তারা সরব হোন। কাউকে এভাবে তাকাতে দেখলে অন্তত একটা ‘হৈ’ বলে আওয়াজ করেই দেখুন না মজা! লোকটি বিব্রত হবে, ছিটেফোঁটা লজ্জা অবশিষ্ট থাকলে হয়তো আর এমন করবে না। (উপজাত হলো আপনি একটু মজার সার্কাস দেখতে পেলেন)। পাশের একজন পুরুষের মতামত ও বিরোধিতা যদি এইসব ব্রেইনলেসের মাথায় ঢোকে (কারণ নারীকে তো তারা মাংশ মনে করেন, নারীদের বিরোধিতার হয়তো ভ্রূক্ষেপও করবে না, উল্টা মেয়েটিকেই গালাগালি খেতে হবে)।

আশা করতে পারি, খারাপকে খারাপ বলার চর্চাটি সামাজিকভাবে আবার আমাদেরই চালু করতে হবে। পুতুপুতু লুলুবাবু হয়ে তো কচুও কাটা শিখি নাই। এখন দুয়েকজন কাম-কাতর লুঙ্গি-বানরের রাডারটিকে যদি নিষ্ক্রিয় করতেও না পারি, তাহলে আর কীসের শিক্ষা, কীসের মনুষ্যত্ব?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন