সোমবার, ২ এপ্রিল, ২০১২

দ্বিঃ১


আমার যে বন্ধুটির নাম অনীক, সে বেশ হিলহিলে ছিল এই তো কয়েক বছর আগেও। পাতলা ফতুয়া পরলে তার উঁচু হাড় বেরিয়ে থাকা কাঁধ দুটোকে হ্যাঙ্গারের মতো দেখাতো। গলার হাড় বেরিয়ে আছে, চোয়াল বসে আছে। দুই গাল যেন কোন অখ্যাত হোমিওপ্যাথের চেম্বারের বসবার সোফা, তোবড়ানো ঢ্যাপ খাওয়া। ওকে যতোটা শুকনা ও অপুষ্টিক্লিষ্ট লাগতো, সেটা দেখে কয়েক বছর আগে আমি যথেষ্ট সহানুভূতি ও সমপরিমাণ করুণা অনুভব করতাম। সেই অনীক কয়েক বছরে খাওয়া দাওয়া করেছে অনেক, বিশ্রামও নিয়েছে প্রচুর। হোমিওপ্যাথের চেম্বারের সোফা বদলে গেছে কর্পোরেট সোফার মত হৃষ্টপুষ্টতায়। পুষ্টিও জুটেছে তার শরীরে, মনে। তাই সে বেশ হাস্যোজ্জ্বল, সুখী মানুষের মতো নির্লিপ্তি ল্যালপ্যাল করে ওর চোখে। আমার অফিসে এসেছে আজ অনেকদিন পর। আমরা একটা সময় একসাথে ঘুরে বেড়িয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলো - সেইসব চোয়াড়ে ডিমভাজি খেয়ে দিন পার করা দিনগুলোয় আমি আর অনীক বিষম বন্ধু ছিলাম। আমাদের মতে মিলতো না প্রায়শই, আমাকে অনীক সম্ভবত উন্নাসিক কেউকেটা ধরে নিয়েছিল। আমিও সম্ভবত অপুষ্টিকাতর অনীককে ফালতু শ্যালো ধরে নিয়েছিলাম। কিন্তু এই ধরে নেয়ানেয়ি টপকে আমাদের দহরম-মহরম বন্ধুত্ব ঘটে গেল। জগতের আর সকল র‍্যান্ডমনেসের মতই সুন্দর বন্ধুত্ব। ঘুরে বেড়াতাম, রাজ্যের বিষয় নিয়ে তর্ক আর আড্ডা হতো। বেশি হতো ঝগড়াই, তবে একে অপরের ঘাড়ের ওপর কোপ মারতে চাওয়ার আগেই সেটা মিটমাট হয়েও যেত। হয়তো মিটমাট হতো কারণ আমাকে অনীক উন্নাসিক ভাবতো আর আমি তাকে ভাবতাম ফালতু। ঝগড়া জিইয়ে রাখার জন্য সেয়ানে সেয়ানে টক্করটা জরুরি।

সেই পুরানো অনীক আমার সামনে বসে আছে। দুঃখিত, ভুল বললাম পুরানো অনীক না, নতুন অনীক। আগের বোতলে নতুন মদ। হৃষ্টপুষ্ট তেলতেলে অনীক বসে হাসছে। গলায় বেশ চৌকস একটা টাই ঝুলছে। আমি ওকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি - চুল দেখি, নিপাট, আঁচড়ানো। জুলফির কাছে সূক্ষ্ণ রেজরের টান চোখে পড়ে। শার্টটা চকচকে ইস্ত্রি করা, মনে হচ্ছে ব্র্যান্ডের শার্ট। হাতের কব্জিতে ঝিকিয়ে উঠছে রুপালি ঘড়ি। এগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আমার ঘাড় শিরশির করে। এসির বাতাস হিমশীতল লাগতে থাকে। অনীক কি খেয়াল করে আমার এই নার্ভাসনেস? মনে হয়। ঠোঁট চেপে মিটিমিটি হাসছে! আমিও মিটিমিটি হাসছি। আমাদের বসার ভঙ্গি এক। হুবহু হাত- হুবহু পা- হুবহু চুলের বিন্যাস। আমি অনীকের দিকে তাকিয়ে ভ্রূ নাচাই, চোখ টিপ দেই। অনীকও আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রূ নাচায়, চোখ টিপ দেয়। আমি জিজ্ঞাসা করি, কেমন আছিস? অনীকও আমাকে জিজ্ঞাসা করে, কেমন আছিস? আমি উত্তর দেই না। অনীক উত্তর দেয় না। আমরা একে অপরের দিকে তাকিয়েই থাকি। তাকিয়েই থাকি। অনীক আমাকে আর উন্নাসিক ভাবে না। আমি অনীককে আর ফালতু ভাবি না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন