রবিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১২

যাকে আমি ভাল পাই না তাকে আমার সিটিএনঃ একটি রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচারী ভাবনা

আদি আরম্ভ ছিল মা, জননী, জনয়িত্রী, প্রসূতি। নাড়ির বন্ধন পেঁচিয়ে কোঁকড়ানো চামড়ার সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ছিল। আরম্ভের সেই মুহূর্তটিতে আসলে অস্তিত্বের স্বকীয়তা সৃষ্টি হয়। জ্ঞানতঃ ওটাই ব্যক্তির প্রথম পরিচয়। পরিচয়ের আদিবিন্দু। ওই বিন্দুর চলার পথকে রেখা বলা হবে, সেই রেখাটি তার ব্যক্তি পরিচয়ের রূপরেখা নির্মাণ করে। ব্যক্তি তার লিঙ্গনির্বিশেষে এই বিন্দুটিকে চেনার চেষ্টা করে নিজের অজান্তেই! যে কোন ব্যক্তির অস্তিত্বের সবচেয়ে কঠিন সত্য হলো জন্মমুহূর্তের কোনো স্মৃতি তার কাছে নেই। এখানে বলে রাখি যে স্মৃতি কিন্তু হুবহু তথ্য সংরক্ষণ করতে পারে না। যে কোন ঘটনার একটি বড় অংশ আমাদের স্মৃতিতে থাকে না। আমাদের মস্তিষ্কের অভিনব সংরক্ষণ প্রক্রিয়ার কারণে হারিয়ে যাওয়া অংশটিকে সে জুড়ে নিতে থাকে আশেপাশের তথ্য থেকে। এজন্য আমাদের সকল স্মৃতির একটি অংশ বানানো, সরাসরি ঘটনাটি নয়। যাক, সে অন্য আলাপ। যা বলছিলাম, ব্যক্তির মস্তিষ্কে তার জন্মমুহূর্তের তথ্য জমা করা নেই। থাকলেও সচেতন মস্তিষ্ক সেখানে প্রবেশ করতে পারে না। তাই সে ধরে নেয় একটি কল্পনার মুহূর্ত ঘটেছিল তার জন্মের সময়। এই শেকড়ের স্মৃতিটি নেই বলেই তার বিপন্নতা। অস্থিরভাবে সে খুঁজে বেড়াতে থাকে কোথায় শুরু, কোথায় আরম্ভ। এই খোঁজের বিপন্নতা থেকে নানাবিধ অবলম্বন দরকার হয় ব্যক্তির।
আচ্ছা, চলুন তো, এই ব্যক্তিকে ভুলে আমরা একটু নৈর্ব্যক্তিক দিকে যাই। বেশ কয়েকবছর আগে, আমি বান্দরবানের বগা লেক থেকে হেঁটে রুমা বাজার চলে এসেছিলাম বন্ধুদের সাথে। প্রায় ছয় ঘণ্টার পাহাড়ি পথ পিঠে একটি ব্যাকপ্যাক নিয়ে হাঁটতে হয়েছিল। প্রথমে আমরা বগা লেকের পাহাড় থেকে সরু পথ ধরে নেমে এসেছিলাম। আগের রাতে শিশির পড়ে পথটি বেশ পিচ্ছিল হয়ে ছিল মনে আছে, ট্যুর গাইড পাহাড়ি লোকটি বেশ অবলীলায় নেমে যাচ্ছে দেখেও আমরা নামতে পারছিলাম না অনভ্যস্ততায়। সেই পথ থেকে নেমে এসে আমরা প্রায় দুই ঘণ্টা একটি ঝরণার পথ পাড়ি দিয়েছিলাম। ঝরণাটি আসন্ন শীতের কারণে শীর্ণদেহ, ঝিরঝিরি পানি বয়ে চলেছে। চারপাশে বৃহদাকার ধূসর পাথর থম ধরে আছে। পাথরগুলো খুলে খুলে এসেছে দুই পাশের পাহাড় থেকে। পাহাড়ের গায়ে গুল্মের চাদর বিস্তীর্ণ সবুজ হয়ে আছে। পকেটের মোবাইল ফোনটি বের করে দেখলাম কোন নেটওয়ার্ক নেই সেখানে। দুয়েকটা পাখির পাখনার ঝাপ্টানো শোনা যায় কি যায় না। জনবিহীন সেই ঝিরিপথে হেঁটে যেতে যেতে সহসাই আমার মনে হল এই বিপুল প্রকৃতির মাঝে আমি অসহায় ও একাকী হতে পারতাম। এখানে আমি আদিম ও নিরক্ত হতে পারি। এই প্রকৃতি শত শত বছর ধরে এমনই আছে। ঋতুর বদলে তার চেহারা বদলায় বটে, কিন্তু সেটাও পর্যায়বৃত্তিক। আমি ক্ষুদ্র একটা প্রাণী, এখানে এসেছি, এবং আবার চলেও যাচ্ছি। আমার পদচ্ছাপও এখানে থাকবে না। এই প্রকৃতির ত্বক স্পর্শ করে চলে যাওয়া অসংখ্য মনুষ্য প্রাণীর কারো কথাই সে মনে রাখবে না। আমরা তার কাছে সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক। যদি এটাই সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে এই প্রকৃতির স্থায়িত্বের ব্যাপারটিই ধ্রুব, আমাদের চলমানতা আসলে জরুরি না। অসীম ঘটনার অসীম সমুদ্রে একজন ব্যক্তির জীবনের সকল ঘটনা খুব ছোট্ট একটি চলক। তাই এর প্রভাব মূল সমীকরণে উপেক্ষণীয়।
আমরা যে বিষয় ও ঘটনাগুলো আমাদের চারপাশে ঘটতে দেখে সেগুলোর মূল্য ও গুরুত্ব পরিমাপ করি, সেগুলোকে জরুরি বা ফালতু দুইটি প্রান্ত ধরে নানাভাবে মাপি, সেগুলো আসলে লম্বা সময়ের বিচারে কোন আঁচড়ই ফেলতে পারে না। তাহলে এই মুহূর্তেই একটি প্রবোধ দিন নিজেকে। আপনার কাছে জরুরি একটি ঘটনা আসলে জরুরি না। কিছু যায় আসে না সেটাকে নিয়ে মাথা না ঘামালে। ফেলে দিতে পারেন, জাস্ট ফর কিউরিসিটিস সেইক, ফালতু মনে করে ফেলে দিয়ে দেখুন আদৌ কোনো পরিবর্তন হয় কি?
ফুটনোটঃ এই লেখাটি যে মুহূর্তে লিখছি, সে মুহূর্তে প্রায় চৌদ্দ হাজার কিলোমিটার দূরত্বে একটি মহাসাগর ও দুটি মহাদেশ পাড়ি দিয়ে যদি বাংলাদেশে তাকানো যেতো, তাহলে দেখতে পেতাম কিছু তুচ্ছ ইসলামী দল সেখানে হরতাল করছে। ইস্যুঃ (তাদের দাবিতে) ইসলামের মহানবী মুহাম্মদের চরিত্র হনন করা হয়েছে। তাই জ্বালাও পোড়াও। আবার এটাও শুনেছি যে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদার সফর উপলক্ষে তিনটি জেলায় হরতাল হবে না। সুতরাং, (তারা ছাড়া বাকি সবাই যা বুঝছে) এটি মূলত নাশকতামূলক অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠান সরকারি শক্তিগুলো (পুলিশ, র‍্যাব) দমন করছে না, কারণ তাহলে ওই বাকি সবার বুঝটা উল্টে যাবে।
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-প্রীতি নেই-করুনার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি,
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
(অদ্ভুত আঁধার এক / জীবনানন্দ দাশ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন