রবিবার, ২ ডিসেম্বর, ২০১২

পাইয়ের জীবন - রূপকজাদু!


আজকে দেখে এলাম লাইফ অফ পাই। ইয়ান মার্টেলের বিখ্যাত বইয়ের চলচ্চিত্ররূপ। অ্যাং লিয়ের কাজ আমার খুব পছন্দের, তার বেশ কয়েকটি ছবি দেখা হয়েছে - যেমন "সেন্স অ্যান্ড সেন্সিবিলিটি", "ব্রোকব্যাক মাউন্টেইন", "ক্রাউচিং টাইগার হিডেন ড্র্যাগন" ইত্যাদি। ছবিগুলো দেখে তার ব্যাপারে আমার একটা প্রত্যাশার মাত্রা তৈরি হয়েছিল। সব পরিচালককে নিয়েই হয়। আমার কাছে সিনেমার এক এবং একমাত্র শিল্পী হলেন পরিচালক। অভিনেতা, ক্যামেরাম্যান, স্ক্রিপ্টরাইটার - এরা হলেন কেবল সেই শিল্পীর আঁকার ভিন্ন ভিন্ন তুলি, এর বেশি কিছু না। অ্যাং লিয়ের ব্যাপারেও একটা নির্দিষ্ট ধারণা তৈরি হয়েছিল আমার, কিন্তু আজকে সেই ধারণা ভেঙে গেল। অ্যাং লি তার পূর্বের সব সীমানা ও সীমাবদ্ধতাকে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলেছেন। তার এই ছবিটা সম্ভবত তার কর্মজীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হতে যাচ্ছে। টেরেন্স ম্যালিকের যেমন "ট্রি অফ লাইফ", অ্যাং লিয়ের তেমন "লাইফ অফ পাই"...
ছবির কেন্দ্রবিন্দুতে হলো Piscine Patel বা সংক্ষেপে Pi, অভিনয় করেছেন ইরফান খান। চরিত্রটির নাম নিয়ে অংশটুকু বারবার ইরফানের আরেক ছবি "দ্যা নেইমসেক"-এর কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। সেখানে গোগোলের নিজের নাম নিয়ে যে টানাপোড়েন, হীনম্মন্যতা - তার কাছাকাছি হীনম্মন্যতাও পাইয়ের জীবনে ছিল। ছোটবেলা থেকে পাইয়ের মাঝে যে গভীর আত্মজিজ্ঞাসা, ধর্ম ও জীবনকে বোঝার নিষ্কলুষ চেষ্টা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। ছোট ছোট জিজ্ঞাসা তার মাঝে - আমরা কে - স্রষ্টা কে - স্রষ্টা কেমন - ধর্ম কী, এগুলো তো আমাদেরও মনে কখনো না কখনো আসে। সেই ছোট্ট কিশোর পাই-এর আকুতি তাই বড়ো চেনা মনে হয়। পাইয়ের মায়ের চরিত্র করেছেন টাবু, এবং বরাবরের মতই অনবদ্য তার অভিনয়। মুম্বাইয়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি আসলে বুঝলো না টাবু কত বড়ো অভিনেতা, বিদেশি পরিচালক আর মিডিয়া বুঝলো। বলিউডে তাকে সারাজীবন অফট্র্যাক আর বাণিজ্য-অসফল কিছু মুভি করতে হলো। (ব্যাপক আফসোসের ইমো)
তবে এদের দুইজনকেও ছাপিয়ে গেছে সুরজ শর্মা। অভিনয়ে অভিষেক হলো তার এই ছবির মাধ্যমে - এবং এক মুহূর্তের জন্যেও মনে হয় নি কোন অভিনয় দেখছি। তার উৎকণ্ঠা, তার মরণের ভয়, তার বেঁচে থাকার প্রবল চেষ্টা- এই সবকিছুর মধ্যে কতটা বাস্তব আর কতটা অভিনয় ফারাক করা মুশকিল।
ছবিটার গল্প তেমন কিছু বলবো না। আপাতদৃষ্টিতে বেশ সাধারণ গল্প (উপরের লিংকে দেখলেই বুঝবেন)। কিন্তু যেটা নিয়ে বলো সেটা হলো ছবিতে রূপকের অভিনবত্ব নিয়ে। ছবিটি দেখার সময় অবশ্যই হাতে দু'ঘণ্টা সময় নিয়ে বসবেন। যারা দেশে দেখবেন, ভালো প্রিন্টের জন্য অপেক্ষা করুন। এই ছবি বাজে প্রিন্টে দেখলে রীতিমত হতাশ ও ক্ষুব্ধ হবেন। মেজাজ খারাপও হতে পারে। কিন্তু ভাল প্রিন্ট দেখে অনুভূতি হবে ঠিক উল্টোটা! সিনেমাটোগ্রাফি আর ফটোগ্রাফি দেখে হতবাক হয়ে গেছি। আমি ঠিক জানি না এর চেয়ে নয়নাভিরাম ছবি আর দেখেছি কী না। পুনরুক্তি হলেও বলি - ট্রি অফ লাইফ-এ মহাজাগতিক সৃষ্টির যে অসহ্য সুন্দর চিত্রায়ন দেখেছিলাম, তার থেকে সুন্দর লেগেছে লাইফ অফ পাই-এর সমুদ্র-সকাল-ঝড়-বিদ্যুচ্চমক! এমন সৌন্দর্য হতবাক করে দেয়, ইন্দ্রিয় দখল করে নেয়। কিন্তু ছবিটায় কি এগুলোই সব? এত ঠাট-ঠমকের বাইরেও চোখে পড়লো জীবন দর্শন নিয়ে টুকরো টুকরো কথা। রূপকগুলো আমি নিজেও সব ধরতে পারি নি, এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলাম যে অপারগতা স্বাভাবিক। এজন্য ছবিটা আরো কয়েকবার দেখবো। বইটাও পড়বার ব্যাকুল আগ্রহ হচ্ছে। যে জীবন দোয়েলের, ফড়িংয়ের - তাকে একবার ছুঁয়ে দেখবার সাধ হচ্ছে।
ছবিটা শেষ করার পর অনেকক্ষণ আমার মাথায় কিছু ঢুকছিল না। কী দেখলাম, কেন দেখলাম। এই দু'চোখে যা দেখি, তার সবই কি সত্যি? তার বাইরে কি আর কোন সত্যি নাই? এমন কি হতে পারে না যে একই জীবনের একাধিক রূপ পাশাপাশি সমান্তরালে চলছে! হতে পারে না যে কোন রূপই আসলে সত্যি না, কিংবা সবগুলোই সত্যি। বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পাইয়ের বাবার একটা উক্তিঃ You can believe whatever you want, but believing everything does not mean anything. It only means you don't believe in anything. (স্মৃতি থেকে লিখছি, মূল উদ্ধৃতিটা পেলাম না)
এ'বছর বেশ কিছু ভাল ছবি বের হয়েছে। আমার প্রিয় কিছু ছবিও আছে। তবে এ কথা জোর দিয়ে বলতে পারি যে লাইফ অফ পাই এই বছরের সেরা ছবি। শুধু তাই না, এটি সম্ভবত এই দশকের সেরা ছবির লিস্টে প্রথম পাঁচে থাকার দাবি করে।
এর বেশি বললে আসলে ছবিটা দেখার মজা নষ্ট করা হবে। তাই এটুকুই থাক...
আর সব কথা বলা হয়ে গেলে নীরবতার কণ্ঠস্বর শুনবেন কীভাবে?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন