বুধবার, ৯ জুন, ২০১০

দ্য ডিভাইন পনিটেইল



...dedicated to him that, despite the enemies and the bad luck, was, is and will be always the talent person that the italian football has ever expressed.
-Antonio Cavallaro
ক্যালিফোর্নিয়ার প্যাসাডিনায় রোজ বো’ওল স্টেডিয়ামের কথা। সময়টা চুরানব্বুইয়ের সতেরই জুলাই, দুপুর গড়িয়ে বিকেলের রোদ তেরছা হয়ে পড়ছে মাঠের ভেতর। সাড়ে বারোটায় খেলা শুরু হয়েছে, নব্বুই মিনিটের পরে অতিরিক্ত তিরিশ মিনিটের খেলাও শেষ। বন্ধ্যা ম্যাচ, এখনতক কোন গোলের দেখা নেই, পুরো টুর্নামেন্টেই অবশ্য গোলখরা। ফাইনাল ম্যাচ হচ্ছে বিশ্বকাপের, এতোক্ষণ ধরে এই গোলহীন লড়াইয়ের শেষে দুইদলের সব খেলোয়াড়ই ক্লান্ত, বিমর্ষ কোচদের দু’জনের চেহারায় ফুটে উঠছে অনিশ্চয়তার রেখা। টাইব্রেকারের জন্যে অপেক্ষা করছে ৯৪ হাজার দর্শক, তাদের সামনে দিয়ে একে একে দুই দলের চারজন করে খেলোয়াড় প্যানাল্টি কিক করলো। স্কোর ৩-২। পাঁচ নম্বরে পিছিয়ে থাকা দলের যিনি কিক নিতে গেলেন, তার জন্যে হিসাব ছিলো গোল না করতে পারলে হার, আর গোল দিতে পারলেও অপর দল মিস না করলে বিশ্বকাপের আশা শেষ। দর্শকদের নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখা মুহূর্ত পেরিয়ে গেলো, দেখা গেলো সেই পঞ্চম খেলোয়াড়ের সাবলীল মাপা দৌড়, কিক নেয়ার সাথে সাথে বলটা উড়ে গেলো গোলবারের ওপর দিয়ে গ্যালারির দিকে। বিপক্ষদলের সমর্থকদের উল্লাসে রোজ বো’ওল স্টেডিয়াম ফেটে পড়লো। আর সেই আকাশ ফাটা চিৎকারের নিচে দেখা গেলো নির্বাক হয়ে উড়ে যাওয়া বলটার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি- রবার্তো ব্যাজ্জিও।
আদর করে তাকে ডাকা হতো Il divin codino (দ্যা ডিভাইন পনিটেইল)। কোঁকড়ানো ছোট ছোট চুলের পেছনে একটা ঝলমলে পনিটেইল। বাইশ বছরের দীর্ঘ ক্যারিয়ারের প্রায় বেশিরভাগ সময়েই এটা ছিলো তার আইকন।
প্যানাল্টি কিকের সাথে এ’রকম অম্ল-মধুর স্মৃতি ব্যাজ্জিওর পুরো ফুটবল ক্যারিয়ারে অনেকগুলো। যেমন ফাইনালের ঘটনার চার বছর আগে, ফ্লোরেন্সের মাঠে টাইব্রেকারের সময় জুভেন্টাসের জার্সি পরা ব্যাজ্জিও কিক নিতে অস্বীকৃতি জানালেন। বিপক্ষ দলটা ছিলো ফিওরেন্তিনা, যে দলের হয়ে ’৮২ থেকে ’৯০ পর্যন্ত খেলেছেন। মাত্রই সেই মৌসুমের শুরুতে রেকর্ড পরিমাণ ট্রান্সফার ফি দিয়ে জুভেন্টাস তাকে কিনে নিয়েছে, কিন্তু এখনও তিনি ফিওরেন্তিনাকে ভুলতে পারেন না। এই ক্লাবই তাকে এতোটা পরিচিতি দিয়েছে, এতোদিনের সেই সম্পর্ক ভুলে তিনি প্যানাল্টি কিক নিতে যান নি। বরং সাইড লাইনের পাশে পড়ে থাকা ফিওরেন্তিনার একটা বেগুনি স্কার্ফ তুলে নিয়ে চুমু খেলেন। পরে তিনি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “Deep in my heart I am always purple.” ফ্লোরেন্সের রঙ বেগুনি।
সারাজীবন ক্লাব থেকে ক্লাবে ব্যাজ্জিওকে খেলতে হয়েছে। ভিঞ্চেঞ্জা (’৮২ – ’৮৫), ফিওরেন্তিনা (’৮৫ – ’৯০), জুভেন্টাস (’৯০ –’৯৫), মিলান (’৯৫ – ’৯৭), বোলোনা (’৯৭ – ’৯৮), ইন্টার (’৯৮ – ’০০), ব্রেসিয়া (’০০ – ’০৪)। প্রায় বাইশ বছরে এতোগুলো ক্লাবের হয়ে খেলেছেন, মাঝে দুইবার তার দলবদলের ট্রান্সফার ফি সেই সময়ের সর্বোচ্চ ছিলো। এগুলো হঠাৎ শুনলেই মনে হবে হয়তো তিনি খুবই হিসেবি আর পেশাদার খেলোয়াড় ছিলেন। কিন্তু আসলে ভেতরে ভেতরে ব্যাজ্জিও বরাবরই আবেগি, বলা চলে emotional fool, এজন্যেই হয়তো আটানব্বুইয়ের বিশ্বকাপে মাঠে নামলেন সেই বিখ্যাত পনি টেইল ছাড়া।
ছোট ছোট চুল, পুরো ম্যাচেও কোচ তাকে খেলাতেন না, দেল পিয়েরোর বদলি হিসেবে নামেন শেষ দিকে। ‘বুড়ো’ হয়ে আসছেন ভেবে সবাই হয়তো একটু করুণা কি সহানুভূতি দেখায়- এমন অবস্থা। চিলির সাথে ম্যাচে যখন ইটালি ১-২ গোলে পিছিয়ে তখন বদলি হিসেবে নামলেন। আক্রমণে উঠে ডি-বক্সের কাছাকাছি জায়গায় বল কাটাতে গিয়ে তা চিলির ডিফেন্ডারের হাতে লেগে গেলো। প্যানাল্টি! আবার! চুরানব্বুইয়ের পরে এই প্রথম ব্যাজ্জিও’র সামনে আরেকটা প্যানাল্টি কিক নেয়ার সুযোগ। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে ঠিক সেই মুহূর্তে কী ভেবেছিলেন তিনি! টিভিতে দেখালোঃ হ্যান্ডবল হওয়ামাত্রই রেফারির বাঁশি শুনে একটু ঝুঁকে গেলেন ব্যাজ্জিও। নিজেকে আড়াল করলেন সবার থেকে, তার স্মৃতিতে চার বছর আগের কথাই ভেসে আসছিলো নিশ্চয়ই। একটু পরে নিজেকে সামলে নিয়ে ধীরে ধীরে প্যানাল্টি কিক নিতে এগিয়ে গেলেন। এবারে ভুল হলো না, তার গোলেই তখন চিলির সাথে ম্যাচে সমতা পেলো ইটালি।
ফুটবলের মাঠে হাজার হাজার সমর্থকদের চিৎকার, কোচের কথা, সতীর্থদের কথা, গেম প্ল্যান, স্ট্র্যাটেজি এই সবকিছু ছাপিয়ে আমার কাছে ব্যাজ্জিওর এই মানবিক রূপটা অদ্ভুত ভালো লাগে। মনে হয় এই লোকটা ফুটবলার হয়ে বিপদে পড়ে গেছেন নিজের বেহিসেবী আবেগ নিয়ে।
এমন না যে ব্যাজ্জিওর ক্যারিয়ারে খালি হা-হুতাশ। পাশাপাশি রাখলে এক বিশ্বকাপ ছাড়া তার পুরো ক্যারিয়ারে তেমন একটা হার নেই। নব্বুইয়ের দশকে জুভেন্টাসের স্কুদেতো জয়ের পেছনে তিনিই ছিলেন মূল শক্তি। লীগের অনেকগুলো ট্রফি জিতেছিলো সেই সময়ে জুভেন্টাস। পঁচানব্বুইয়ে ফিফা বর্ষসেরা খেলোয়াড়ও হয়েছিলেন তিনি, একইসাথে ইউরোপিয়ান বর্ষসেরাও! বিশ্বকাপে ব্যাজ্জিও ইটালির একমাত্র খেলোয়াড় যিনি পরপর তিনটা বিশ্বকাপেই গোল করেছেন। আর চুরানব্বুইয়ের বিশ্বকাপের পুরোটাই তার অনবদ্য খেলার দৃষ্টান্ত।
অনবদ্য এই অর্থে যে তেমন একটা স্কিল দেখিয়ে খেলতেন না। এমনকি পুরো মাঠ দাপিয়েও বেড়াতেন না। যেটা করতেন সেটা হলো সুযোগের সদ্ব্যবহার। তক্কে তক্কে থাকতেন, আর যাকে বলে, ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় থাকতেন, দুর্দান্ত ফিনিশিং ছিলো। খুব বেশি যে কৌশলটা খাটাতেন তা হলো ডজিং। এমন অনেকগুলো গোল দেখেছি, যা কেবল গোলকিপারকে পুরোপুরি নাস্তানাবুদ করেই দিয়েছেন।
পরিসংখ্যান যদিও তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না, ওটা দিয়ে তেমন কিছু বুঝাও যায় না, তবু একটা মজার ফ্যাক্ট পেলাম। যে তিনটা বিশ্বকাপে ব্যাজ্জিও ইটালির হয়ে ১৬ টা ম্যাচ খেলেছেন (’৯০, ’৯৪, ’৯৮), তার প্রতিটাতেই ইটালির বিদায় হয়েছে টাইব্রেকারে। ’৯০-এ আর্জেন্টিনা, ’৯৪-এ ব্রাজিল আর ’৯৮-এ ফ্রান্স। তার মানে কোনবারেই ইটালি সরাসরি কোন ম্যাচ হেরে বাদ পড়ে নি {গ্রুপ ম্যাচগুলোর মাঝে কেবল একটা ম্যাচেই তারা হেরেছিলো (’৯৪) আয়ারল্যান্ডের সাথে}।
আসলেই ফুটবল একটা নিষ্ঠুর খেলা!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন