রবিবার, ২০ জুন, ২০১০

বাবাদের ছবি - ছেলেমেয়েদের জন্যে! (অথবা বাবাদিবসের বাখানি)

আজকে বাবা দিবস। আমাদের সংস্কৃতিতে এই দিবসটা একেবারেই নতুন, আর নতুনের প্রতি সবারই একটা সন্দেহমূলক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে। সেই কারণে ভাবতে গেলে মাঝে মাঝেই নেতিবাচক মনোভাবেরও দেখা পাই। ব্যক্তিগতভাবে আমি একটা মাত্র দিনে ঘটা করে বাবাকে স্মরণ করার পক্ষে নই। আমার মতে মা-বাবা যে কোন মানুষের একান্ত আপনজন, সবচেয়ে নিঃস্বার্থ তো বটেই। তাঁদের জন্যে একটা মাত্র দিনে আলাদা করে উদযাপনের কোন মানে হয় না। তাঁরা চিরন্তন, আমার পার্থিব জীবনের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান তাঁদের। আমার সুখ, নিরাপত্তা আর মানবিক গুণাবলীর পেছনেও তাঁদের হাত সবচেয়ে বেশি।

হয় কি, সারাদিন পাশাপাশি থাকলে অতি আপনজনদেরও অনেক সময়ে বলা হয় না তাঁরা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তাদেরকে আমরা কতোটা ভালোবাসি। সেই কথাগুলো হুট করে বলতেও একটু লজ্জা লজ্জা লাগে। মায়ের আর বাবার জন্মদিনে বাসায় ঘটা করে কেক কাটি, বাচ্চাদের মতো আনন্দ করে তাঁদেরকে একটু হলেও খুশি রাখার চেষ্টা করি। এর পাশাপাশি বাবা দিবস, মা দিবসে আরেকটা সুযোগ/উপলক্ষ্যও পাওয়া গেলো বলারঃ "বাবা, তোমার জন্যেই সব ভালোবাসা। তোমার কাছেই শিখেছি জীবনের কতো পাঠ, প্রথম নামতা, প্রথম সাইকেল চালানো।" প্রথম যেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শুরু হলো, তুমিই বলেছিলে, "এখন তুমি বড়ো হয়ে গেছো, জীবনের সব সিদ্ধান্ত এখন থেকে তোমাকেই নিতে হবে। খালি মনে রাখবে তোমার কাজেকর্মে যেন অপরের ক্ষতি না হয়, তাহলেই তুমি 'মানুষ' হতে পারবে!"


ইদানিংখুব মুভি দেখছি। পুরনো দেখা মুভিগুলো ঘেঁটে ঘেঁটে দেখছিলাম বাবা-ছেলে অথবা বাবা-মেয়ের সম্পর্ক নিয়ে ভালো ছবিগুলো কি কি। আমার দেখা সেইসব মুভির একটা সংগ্রহ নিয়েই লিখবো ভাবলাম!



এই মুভিটা নির্বাক যুগের, এবং চার্লি চ্যাপলিনের পরিচালক হিসেবে অন্যতম মাস্টারপিস। অভিনেতাও মূলত দুজনে- চার্লি হলো সেই পুরনো ভবঘুরে, যার কোন চালচুলা নাই, ঘরবাড়ি নাই, টুটাফাটা পোশাক, বোওলার হ্যাট পরে আর ছড়ি হাতে সে ঘুরে বেড়ায়। এভাবে ঘুরতে ঘুরতেই তার দেখা হয়ে যায় এক অনাথ শিশুর সাথে। শিশুটি পরিত্যক্ত, বিনাবাপের ছেলেকে মা জন্মানোর পরেই ফেলে রেখে গেছে। চার্লি সেই ছেলেটিকে তুলে নেয়, তারপরে তাকে পালতে থাকে। নিজের খাওয়ার কোন খবর নাই, কিন্তু সেই নাম-পরিচয়হীন শিশুটির জন্যে সে কত কীই না করলো!
উদ্ভট ভবঘুরের মনুষ্যত্ব দেখে চোখের পানি আটকে রাখাও মুশকিল, আবার দেখা যায় তার কমিক চেহারার নানারকম মুখভঙ্গি আমাদের মুখেও এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে তুলছে! এই ছবিটা সম্ভবত চার্লি চ্যাপলিনের আইকনিক প্যাথো-কমেডির (যে ছবির মূল সূর বিষাদাত্মক, অথচ সমাপ্তি মিলনাত্মক) একটা উজ্জ্বল নিদর্শন। দেখার পরে একই সাথে মন খারাপ হয়, আবার মন ভালোও হয়।


এই ছবিটাও অসামান্য খালি বাবা এবং ছেলের অভিনয়ের গুণে! উইল স্মিথকে আমার সবসময়েই বাণিজ্যিক ছবির হালকা চালের অভিনেতা মনে হতো, কিন্তু এই ছবি এবং সেভেন পাউন্ডস দেখার পরে আমি সেই ধারণা বদলে ফেলেছি। গুণী পরিচালক (গ্যাব্রিয়েল মুচ্চিনো) আর দুর্দান্ত চিত্রনাট্য পেলে ছবি ভালো হবেই। সেই সাথে জুড়ে গেছে বাস্তবের পিতাপুত্রের অভিনয় (উইল স্মিথ আর তার ছেলে জ্যাডেন স্মিথ)। আর এই ছবিটা একটা সত্য ঘটনার উপরে ভিত্তি করে বানানো বলে দেখার সময়েই মনে হতে থাকে কারো জীবনের কাহিনী দেখছি!
যাদের কাছে মনে হয় বিদেশের জীবন খুব সুখের আর আনন্দের, তাদেরকেও যে আমাদের মতো জীবনযুদ্ধ করতে হয়, একটা একটা করে পয়সা জোগাড় করতে হয় সেটা এই ছবিটা দেখলে বুঝা যায়!

ডেনিস ডুগানের এই ছবিটাও অনেকটা দ্য কিডের ঘরানার। পার্থক্য হলো এই মুভিটায় অভিনয় করেছেন এডাম স্যান্ডলার। আর তার মধ্যে ট্রাজেডির লেশমাত্র নাই। পুরো ছবিতে তার ছোট ছোট জোক আর পান শুনতে শুনতে হাসি আটকানো মুশকিল। তার চরিত্র (সানি) থাকে কেয়ারফ্রি ধরনের এক যুবক। ঘটনাক্রমে বন্ধুর বিনাবিয়ের ছেলে এসে তার ঘাড়ে পড়ে। সেই বন্ধু আবার তখন আরেক মেয়ের সাথে বাগদান করে ফেলেছে। সামনে বিয়ে। এরকম নাজুক অবস্থায় ছেলের পরিচয় জানলে সমূহ(!) বিপদ, তাই সানির ঘাড়েই পড়ে কিছুদিন সেই বাচ্চা ছেলেকে দেখাভালের ভার। যে মানুষ নিজেরই ঠিকমতো টেক কেয়ার করতে পারে না, সে কী ধরনের মুশকিলে পড়ে, সেটা এই ছবি দেখলে ভালো মতো বুঝা যায়। আর যারা বাচ্চা ভয়ঙ্কর কাচ্চা ভয়ঙ্কর বলে মনে করেন, তাদের জন্যেও শিক্ষামূলক ( ;) ) ছবি এইটা! হা হা হা!
Father of the bride (1950) , (1991)
বাবা হিসেবে সবচেয়ে কঠিন কাজের মধ্যে একটা মনে হয় নিজের মেয়ের বিয়ে। এমনিতেই দেখা যায় মেয়েরা বাবার বেশি কাছের হয়। সব মেয়েরই কমবেশি কিশোরী বয়সের আইডল হলো তার বাবা। সেই বাবার সাথেই তার বেশি খাতির থাকে। তারপরে একদিন সেই বাবা টের পান যে তার মেয়ে বড়ো হয়ে গেছে! সে এখন একটা ছেলের প্রেমে পড়েছে। তার সাথে বিয়ে করে নতুন সংসার শুরু করতে চায়। সেই সময়ের অনুভূতি সব বাবার জন্যেই মনে হয় একরকম। হঠাৎ করে টের পান মেয়ের চোখে তিনি এখন সেকেন্ড হিরো, নতুন হিরো (নাকি ভিলেইন?) হয়ে দেখা দিয়েছে অজানা এক উড়ে এসে মেয়ের হৃদয়ে জুড়ে বসা কেউ! এই অবস্থায় বাবা'রা কী করেন?
ছবিটা দেখার সময়ে অনেক হাসিঠাট্টার মাঝেও মনে হয়েছে বাবার অনুভূতিগুলো একেবারেই আলাদা! সে না পারে সইতে, না পারে প্রকাশ করতে। ছবিটার দুইটা ভার্সন আছে। একটা '৫০ সালের (স্পেন্সার ট্রেসি-এলিজাবেথ টেইলর পিতা-কন্যার অভিনয়ে), আরেকটা '৯১ সালের (স্টিভ মার্টিন-কিম্বারলি উইলিয়ামস পিতা-কন্যার অভিনয়ে)। দুইটাই সমানভাবে উপভোগ্য, তবে আমার নিজের কাছে পুরনোটা বেশি ভালো লেগেছে। হয়তো দুইজনই দুর্দান্ত অভিনেতা বলে!


                                                                Mrs. Doubtfire (1993) 

ক্রিস কলম্বাসের অসাধারণ সব ছবির মাঝে এই ছবিটা আলাদাভাবে উল্লেখযোগ্য, অনেকগুলো কারণে। রবিন উইলিয়ামস কতোটা শক্তিশালী অভিনেতা সেটা কারণ নম্বর এক। দুই নং কারণ হলো রবিন উইলিয়ামস কতোটা বড়োমাপের অভিনেত্রী সেটা। তিন নং কারণ হলো রবিন উইলিয়ামস একইসাথে পুরুষ ও নারীচরিত্রে কতোটা পারদর্শী সেটার অনবদ্য উদাহরণ এই ছবিটা! সব মিলিয়ে দমফাটা হাসির, একই সাথে ছেলেমেয়ের জন্যে তার অনাবিল ভালোবাসার। বিদেশী সমাজের মতো এখন আমাদের সমাজেও বিবাহ বিচ্ছেদ অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এই ছাড়াছাড়িতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সন্তানেরা। সেই সন্তানদের জন্যে বাবা'র থেকে দূরত্ব ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, কারণ দেখা যায় বেশিরভাগ সময়েই কাস্টডি মায়ের তরফে যায়। বাবার সাথে দেখা হয় কেবল উইক-এন্ডের দুই দিন। এই ধরনের ব্যবস্থা মানতে নারাজ ড্যানিয়েল, তাই সে কেয়ার টেকারের বেশ ধরে হাজির হয় নিজেরই বাড়িতে, ছেলেমেয়ের কাছে। দুই ধরনের জীবন হ্যান্ডেল করার ঝক্কি আর ঝঞ্ঝাট নিয়েই এই ছবিটা। এটার একটা মজার রিমেক হয়েছিলো হিন্দিতে (চাচী ৪২০)। সেটাও কমল হাসান আর টাবুর অভিনয় মিলিয়ে দেখতে খারাপ লাগে নি!


এবারে একটু সিরিয়াস ছবি। পিতৃত্বের সাথে কেবল হাসিঠাট্টা বা আত্মত্যাগই জড়িত নয়, একই সাথে দায়িত্ববোধ আর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণের সংবেদনশীলতারও গুরুত্ব অনেক। পিতা হিসেবে, আইকন হয়ে ওঠা, বা আইডল হয়ে ওঠার জন্যে যে পরিমাণ দৃঢ়তা দরকার, যে ধরনের একাগ্রতা দরকার, সেটা সবার মাঝে থাকে না। সেটা ধীরে ধীরে চর্চা করে গড়ে তুলতে হয়।

'টু কিল এ মকিংবার্ড' সেই ধরনের গল্প নিয়েই তৈরি। একই নামের উপন্যাস থেকে ছবিটা বানানো হয়েছে, হারপার লি'এর উপন্যাসটি পুলিৎজার পুরষ্কারপ্রাপ্ত। সেটা থেকে ছবি বানানো হয়েছে '৬২ সালে। মূল চরিত্রটি বাবার, অভিনয় করেছেন গ্রেগরি পেক। ছবিটায় তিনি দুই সন্তানের পিতা, মা মারা যাওয়ার পরে যাদেরকে একাই কোলেপিঠে করে মানুষ করছেন। পেশায় আইনজীবি। শান্ত গ্রামের মতো শহরে হঠাৎ একদিন এক শ্বেতাঙ্গ মহিলা নিহত হলেন, সেই খুনের দায়ে অভিযুক্ত হলো এক কালো। সময়টা '৩০-এর দশক, আমেরিকায় তখনও কালোদের নিগ্রো বলা হতো। ছবিটার পরতে পরতে বর্ণবাদ, সামাজিক অনৈতিকতাগুলো উঠে এসেছে। তবে মজার ব্যাপার হলো এর সবকিছুই দেখা হয়েছে একটা কিশোরের চোখ দিয়ে। তার চোখে কী করে তার বাবা নায়ক হয়ে উঠলেন। সাধারণ মানুষ (এবং সাদা) হয়েও একজন কালোর হয়ে আইনি লড়াইয়ে নামলেন সেটার গল্প এই ছবিটা। নিঃসন্দেহে টিন-এজার ছেলেপুলে নিয়ে একসাথে বসে দেখা যায়!


এই অ্যানিমেশন মুভিটা দেখে প্রথম যা মনে হয়েছে, সেটা হলো মাছেরাও মানুষ! তাদেরও আছে বেঁচে থাকার, থুড়ি, বাবা হওয়ার অধিকার। ফাইন্ডিং নিমো সম্ভবত সবাই দেখে ফেলেছেন। তারপরেও যারা দেখেন নি, তারা বিরাট অপরাধী, দ্রুত দেখে ফেলেন সুযোগ পাওয়া মাত্রই। যাদের ৫ থেকে ১০ বছর বয়েসি বাবু আছে, তারা আরো দ্রুত দেখেন। বাচ্চার সাথে সাথে নিজেরও পিতৃত্বের পাঠ হয়ে যাবে!

ক্লাউন ফিশটার নাম মারলিন। তার ছেলের নাম নিমো। ছেলের ব্যাপারে অতিরিক্ত সচেতন থাকেন তিনি, বাস করেন অস্ট্রেলিয়ার রীফের ভেতর। ছেলেকে ভর্তি করেছেন স্কুলে, প্রথম দিন তাকে স্কুলে পাঠানোর সময় সদাচিন্তিত মারলিনকে সবারই ভালো লাগবে। কেউ কেউ নিজের ছায়াও(!) খুঁজে পেতে পারেন। তারপরে এক দুঃসহ দূর্ঘটনায় নিমো হারিয়ে গেলো। সেই খোঁজে বের হলো ছোট্ট মারলিন, আর সেই নিয়েই ছবির গল্প!


সবশেষে ক্রেমার ভার্সেস ক্রেমার। এই ছবিটা একসাথে পাঁচটা অস্কার পেয়েছে। ছবির মূল চরিত্র বাবা এবং মায়ের রোলে আছেন ডাস্টিন হফম্যান এবং মেরিল স্ট্রিপ। এখানেই সম্ভবত ছবিটা কেন দেখতে হবে সেটা বলা হয়ে গেলো। তারপরেও যদি কারো দোনমনা থাকে, তাহলে ছোট বাচ্চাটার অভিনয় দেখার জন্যে দেখতে পারেন। আমার ধারণা, বাবা মায়ের চাইতে সে অনেক বেশি ভালো অভিনয় করেছে।

এই ছবির গল্পটাও বিবাহ বিচ্ছেদের সাথে জড়িত। বাবা মায়ের ছাড়াছাড়ির পরে ছেলেটা থাকা শুরু করে বাবার সাথে। গেরস্থালির কাজে অনভিজ্ঞ বাবার চাকরি জীবনেও ভয়ানক কাজের চাপে থাকেন। ঘর আর বাহির দুইদিক সামলাতে গিয়ে তার হিমশিম খেতে হয়। সেখানে ছেলের দিকেও মনোযোগ দেয়া লাগে।
এরই মাঝে একসময় মা ফিরে আসেন। কিন্তু তাদের মাঝে মিল ঘটাতে নয়, বরং ছেলেকে নিয়ে যেতে। স্বভাবতই বাবার দাবি, এতোদিন ছেলেকে মানুষ করেছেন তিনি, সুতরাং তিনিই ছেলেকে এখন লালন করবেন। আবার মায়ের দাবিও ঠিক, ছেলে এখনও নাবালক, এবং মায়ের কাছেই সে ভালো থাকবে। এই টানাপোড়েন গড়াতে গড়াতে কোর্টতক গেলো।
অদ্ভুত রকমের মানবীয় ছবিটা। বাবা-ছেলের সম্পর্ক, মায়ের প্রতি ছেলের টান, বাবার আবেগ, মায়ের ভালোবাসা সব মিলিয়ে ঝালমুড়ি।

===

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন