বুধবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১০

নির্বাণ



মানুষকে বোবা করে তোলার সব প্রক্রিয়া যখন সমাপ্ত, তখন তাদের মাঝে এক ধরনের মিশ্র ক্লান্তি দেখা যাবে। অবয়ব পরিষ্কার নয় বলে তারা ঠিক কতোটা ক্লান্ত, সেটা আমি বুঝে উঠতে পারি না। স্যরি, আমি খালি নিজের কথা বলি। বাকিরাও বুঝে উঠতে পারে না। আমি এবং বাকিরা, আমরা সবাই তাদের মুখের রেখা পড়ার চেষ্টা করি। কিন্তু কোনো লাভ নাই, শালাদের মুখই নাই, তার আবার মুখের রেখা? ধুস! রেগেমেগে সব ভেঙে ফেলতে ইচ্ছা করে আমাদের। এরকম ধ্বংসযজ্ঞ অনেকবার করেছি আমরা, চারপাশের সবকিছু ভেঙে ফেলেছি। তারপরে অনেক ভাঙচুরের পরে আমরা শান্ত হয়েছি। মাথা ও রক্ত ঠাণ্ডা হলে খেয়াল করেছি যে এইসব ভাঙচুর করে কোনো লাভ হয়নি। তাদের টিকিও স্পর্শ করা যায়নি, তারা বহাল তবিয়তেই আছে- আমাদের দিকে মুচকি মুচকি হাসছে। হাসিটাও স্পষ্ট নয়। ঐ যে বললাম, তাদের অবয়ব দেখা যাচ্ছে না ঠিকঠাক।


এই কারণে আমরা বারবার হেরে যাই- আমাদের পরাজয়ের পেছনে কোনো রণক্ষেত্রের বিশ্বাসঘাতকতা দায়ী নয়- যেটা ঘটেছিলো প্রাগৈতিহাসিক পুরাণের পলাশী-পরিচ্ছেদে। অথবা সম্প্রতি ইতিহাসে সংকলিত রক্তবিষ-শুয়োরদের ছদ্মবেশী আক্রমণপন্থাও আমরা এখন ধরতে পারি। এই পন্থায় আমাদের অনেক ভয়ানক একটি পরাজয় ঘটেছিলো- প্রাগৈতিহাসিক পুরাণের বঙ্গ-পরিচ্ছেদে। আমাদের শৈশবেই এইসব প্রাগেতিহাস পড়ানো হয়। এগুলো থেকে আমরা ভ্রান্তিমোচনের উপায় এবং কৌশল শিখি। তথ্যগুলো একটা রঙিন সিরিঞ্জে ভরে আমাদের ঘাড়ের একটু উপরে, নরম গর্ত দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়। বেশি ব্যথা লাগে না চেতনানাশকের প্রভাবে, তবে একটু ঝিমঝিম করে। সিরিঞ্জগুলো রঙিন করা হয় যাতে শিশুরা ভয় না পায় সেজন্যে। সিরিঞ্জ পুশ করার পর একদিন সেই গাঢ় রঙ আমাদের চোখের রং বদলে দেয়। দূর থেকে দেখলেই বুঝা যায় কারা কারা এখন বঙ্গ-পরিচ্ছেদ, বা পলাশী-পরিচ্ছেদ, বা পাকি-পরিচ্ছেদ, বা কোম্পানি-পরিচ্ছেদ নিয়েছে। এগুলো নিয়ে এখন আমরা আর তর্কও করি না- সবাই সঠিক অভ্রান্ত প্রাগেতিহাস জানলে সেটা নিয়ে কথা বলা বাতুলতা। আমরা বাতুলতায় সময় নষ্ট করি না।


রণক্ষেত্রে যারা এবারে খুব চৌকস রণ করেছেন তারা মিশমিশে কালো হয়ে গেছেন, কারণ তারা কালো রঙের সিরিঞ্জে করে স্মৃতিনাশক ঢুকিয়ে দিয়েছে। এদের চোখ তো চোখ, হাত-পা-মুখ-চুল-ত্বক-আঙুল-বুক-পেট-লিঙ্গ সবকিছু কালো কুচকুচে হয়ে গেছে। খুব খেয়াল না করলে এদেরকে মূর্তি বলে মনে হয়, যারা খুব দুর্দান্ত রণকৌশল দেখিয়েছেন। এরা কথা বলতে পারে না এখন। সেটাই বলছিলাম শুরুতে- যখন আমরা মানুষরা বোবা হয়ে যেতে শুরু করি তখন তাদের সম্ভবত ক্লান্ত লাগে। বোবা ও অথর্ব আমাদের চোখের ভেতরে সাদা অংশটি কালো হয়ে গেলে তারা হেসেও ওঠে জোরে। সেই হাসি বোবা মানুষেরা, আমরা শুনতে পাই, তবে ঠাহর করতে পারি না। কী করে করবো? আমাদের তো চোখের ভেতরে কালো রঙ!


হেসে উঠে তারা একটি তালিকা ধরিয়ে দেয় মূল-বোবার হাতে। শুধু মূল-বোবা'ই তখনও চোখে দেখতে পাচ্ছিলেন। তিনি তালিকাটিতে চোখ রাখেন। পড়ার সাথে সাথে তার মাথার পেছনের নরম গর্তে লাগানো ধ্বনিযন্ত্রে শব্দগুলো জোরে জোরে উচ্চারিত হতে থাকে। তালিকায় লেখা আছেঃ




=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+==+=+=+=+=
______সকল কৃতজ্ঞতা তাঁর! সকল দায়িত্ব তাঁর!______


___আজ আধুনিক পুরাণের দশম বছরের দ্বাবিংশতিতম দিন।___


মানুষকে আমরা পরাজিত করেছি অত্যাধুনিক রণক্ষেত্রে তিনদিনব্যাপী রণ সম্পন্ন করে। এখন তাদের আটককৃত দক্ষ যোদ্ধাদের সকলকে কৃষ্ণমধু দিয়ে নিরপেক্ষ সত্ত্বায় পরিণত করা হয়েছে। কৃষ্ণমধু দেয়া হয়েছে চোখ-হাত-পা-মুখ-চুল-ত্বক-আঙুল-বুক-পেট-লিঙ্গ ইত্যাদি অঙ্গে। সেইসাথে বর্ণিত হলো কেন তাদের অধিকার নেই, কেন তারা কালো হয়ে গেলেন, কেন তারা বোবা এবং কেন সকল ক্ষমতা হারালেন-


১. চোখে মধু দেয়া হয়েছে যাতে তারা আর কখনোই সত্য দেখতে না পান। এখন থেকে তারা কেবল সেই ছবিই দেখবেন যেটি আমরা দেখাবো।


২. হাতে মধু দেয়া হয়েছে যাতে তারা স্বেচ্ছায় কোন ক্রিয়া করতে না পারেন। এই সাথে হাতের সকল অনিচ্ছাকৃত কার্যও নিষিদ্ধ হলো।


৩. পায়ে মধু দেয়া হয়েছে যাতে তারা কোথাও হেঁটে যেতে না পারেন। এখন থেকে তাদেরকে নিতম্বের ওপর ভর দিয়ে গোড়ালির সাহায্যে চলাচল করতে হবে।


৪. মুখে মধু দেয়া হয়েছে যাতে তারা কোন নিজস্ব বক্তব্য রাখতে না পারেন। কথা ও শব্দের সকল অধিকার রদ করা হলো।


৫. চুল, আঙুল ও ত্বকে মধু দেয়া হয়েছে যাতে তারা পরষ্পরকে স্পর্শ করে কোন তথ্য পাচার করতে ও যূথবদ্ধ হতে না পারেন। মধুর প্রলেপের কারণে তারা এখন সম্পূর্ণ শরীরে ও মনে বিচ্ছিন্ন থাকবেন।


৬. বুকে মধু দেয়া হয়েছে যাতে আত্মা ও হৃদয় বলে বহুল প্রচারিত প্রপঞ্চটি দমন করা যায়। যেহেতু সঠিক নিয়মে আত্মা ও হৃদয়ের অবস্থান নির্ণয় করা যায়নি, সেহেতু আমরা নিকটবর্তী হাইপোথিসিসটি মেনে নিয়েছি।


৭. পেটে মধু দেয়া হয়েছে যাতে তারা সর্বসময় ক্ষুধা ও তৃষ্ণা দূরীভূত থাকেন। নিবৃত্তির বশবর্তী হয়ে প্রাগৈতিহাসিক রণসমূহের কোনো পুনরাবৃত্তি আমরা চাই না।


৮. লিঙ্গে মধু দেয়া হয়েছে যাতে সেগুলো বাইরের কোনো উদ্দীপনা বা ভেতরের লিবিডোর থেকে মুক্ত থাকে। অতীতে অতিপ্রজননশীল মানুষ নিয়ন্ত্রণ ও পরিদর্শনের সংখ্যা ছাড়িয়ে বিপজ্জনক মাত্রায় বেড়ে গিয়েছিলো। সেটি বন্ধ করতে এই নতুন উদ্যোগ।


একটি সুসভ্য, সুষ্ঠু, নিয়ন্ত্রিত জনগোষ্ঠি আমাদের সকলেরই কাম্য। সেই বিশেষ উদ্দেশ্য সাধনে মানুষের ভবিষ্যত সংরক্ষণে আমরা সদা তৎপর। সকল বিভ্রান্তি ও দ্বিধা এড়িয়ে যারা আমাদের সাথে রণে সাহায্য করেছেন- তারা বন্ধু, সহযোগী ও সাথী। তারা অবশ্যই তাঁর (সকল কৃতজ্ঞতা তাঁর! সকল দায়িত্ব তাঁর!) কৃপা পাবে।


=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+=+==+=+=+=+=


পুরো তালিকাটি পড়া হলে মূল-বোবার হাত থেকে তারা সেটি কেড়ে নিলো। মূল-বোবার কথা বলাও বন্ধ হয়ে গেলো। তারপর মাত্র দুই মিনিটের মধ্যে তার চোখের সাদা অংশটি কালো হয়ে উঠলো কৃষ্ণমধুর প্রভাবে। আমরা বাকিরা একটা ধপ করে শব্দ শুনলাম। তারপরে হিস হিস করে শব্দ হতে থাকলো। আমরা সবাই যদি দেখতে পেতাম তবে দেখতাম যে মূল-বোবার নিথর ধড় ইলেকট্রিক শক দেয়া ব্যাঙের শরীরের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। ধপ করে খসে পড়েছে তার কালো চুলসহ মাথাটা।


যেন পাহাড়ের ওপর থেকে গড়িয়ে সেটা একজনের পায়ের কাছে এসে থামলো।
যেন কোন ব্যারাকের কালো নর্দমায় সেটা ভেসে উঠলো তিন দিন পরে।
যেন কোন বধ্যভূমিতে গণকবর খুঁড়তেই লাফিয়ে বেরিয়ে এলো সেটা।
যেন কালো শীতল নদীতে সেটা আলতো করে ভেসেই যাচ্ছিলো।
যেন পিচের ঢালু রাস্তায় তপ্ত দুপুরে সেটা গড়িয়ে যাচ্ছে।
যেন লাঠির আঘাতে কারাগারের অন্ধকুঠুরিতে সেটি গুমরে মরছে।
যেন কোন জমিদারবাড়ির পেছনের বনে কতগুলো তলোয়ার তাকে টুকরো করেছে।


তার খোলা ভোকাল কর্ড আর ঘাড়ের ভেতর থেকে হিস হিস করে রক্ত বেরিয়ে আসছে। মেঝের পুরো মুহূর্তেই লাল হয়ে উঠলো। আমরা যেখানে বসেছিলাম, আমাদের পায়ে, পাছায়, হাতে লাল রঙ লেগে গেলো। আমরা যদি ত্বকে কোন অনুভূতি পেতাম, তবে আমরা গরম রক্তের অনুভব পেতাম। আমরা যদি কথা বলতে পারতাম তাহলে আমরা চিৎকার করে উঠতাম। আমাদের চোখের সামনে এভাবে মূল-বোবা'র মাথা কেটে ফেলার আগে বাধা দেয়ার চেষ্টাও করতাম। মূল-বোবা হয়ে ওঠার আগে তার একটা সুন্দর নাম ছিলো- সেই নাম ধরে আমরা শ্লোগান দিতাম, তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করতাম। আমাদের হাত-পা কালো না হয়ে উঠলে আমরা দৌড়ে যেতাম তাদের দিকে, বাধা দিতাম নিশ্চিত!


কিন্তু আমাদের চোখের ভেতর, মাথার ভেতর, মুখের ভেতর, হাতের ভেতর, পায়ের ভেতর ঘোর ঘোর কালো। তারা না চাইলে আমরা আমাদের লিঙ্গও উত্থিত করতে পারবো না। তাদের কী মনে হলো, তারা চাইলেন আমরা যেন একটু হাসি। অমনি আমাদের মুখে মুচকি মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। দেখা গেলো মূল-বোবার ধড় ছটফটানি কমিয়ে দিয়েছে, মাথাটা তখনও আমাদের একজনের পায়ে লেগে এদিক ওদিক দুলছে। রক্তের বেগ কমে গেছে। থিকথিকে ঘন কালচে রক্তের মাঝে বসে আমরা অল্প অল্প দুলছি এবং হাসছি।






তারা নিশ্চয়ই মহান। তারা নিশ্চয়ই প্রতিভাবান। তারা নিশ্চয়ই সুসভ্য। তারা নিশ্চয়ই আমাদের ভালো চান। মূল-বোবার মাথাবিহীন ধড়ের পাশে রক্তে ভিজতে ভিজতে আমরা এই ধরনেরই একটা প্রবল বোধিলাভ করি!




***

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন