বুধবার, ৯ মার্চ, ২০১১

পদার্থের ভান

প্রচণ্ড শব্দের গতি, তারচেয়েও প্রচণ্ড আলোকের বেগ। পদার্থবিদ্যায় পড়েছিলাম, শব্দ ও আলোক শক্তির দুই রূপ। মানব পদার্থ কেবল, ভেতরে অণুপরমাণু তিলে তিলে রক্ত-মাংস গড়ে তুলেছে। শক্তির কাছে পদার্থের হার নিশ্চিত, তাই শব্দে আমাদের ধাক্কা লাগে, আলোকে আমরা পুড়ে পুড়ে যাই!

দুপুর রৌদ্রের রশ্মিগুলো তীব্রতায় একে অপরের সাথে মিশে যায়, খালি চোখে তাকালে গতি-দ্রুততায় আমার ধাঁধা লাগে, বুঝতে পারি না ঠিক কী দেখছি, কেমন দেখছি। রশ্মিগুলো ঠিকরে ঠিকরে চোখের ভেতর সেঁধিয়ে যেতে থাকে আর অনূদিত হতে থাকে যাবতীয় দৃশ্য, পাখি ও বৃক্ষ, রাজপথ ও রাজন্যের শাসন। প্রাচীন শহরে বাস করি, শহর নিজস্ব সময়ে প্রাচীনতার ওপর চাকচিক্যময় প্রলেপ দিয়েছে, সেসব আমাকে প্রতিমুহূর্তে বোকা বানায়। আমি বেকুব থেকে বেকুবতর হই। আপাত-নবীন প্রাণে-প্রাচীন শহরে প্রাগৈতিহাসিক যানে চলাচল করি। যানচালকের লুঙ্গি ও গেঞ্জি কালো শরীরে কালো ঘামে সেঁটে আছে। শরীরের ভেতরে সাপের মতো কিলবিলে পেশী ও ক্ষুধা, আমার সাথে তার লেনদেন রফা হয়েছে দশ টাকা। দশমুদ্রার বিনিময়ে তার কয়েকশো বিন্দু ঘাম ও কয়েক হাজার কিলোক্যালোরি এটিপি কিনে নিয়েছি। রিকশা টানছিলো সে, প্রবল ক্লেশে, দশ মুদ্রার উজান-টানে। ঝাঁঝালো রৌদ্রের তীর পিঠে বিঁধতে বিঁধতে সে ও আমি এগুতে থাকি। আমাদের মাঝে উলম্ব ঝুলছে কতোগুলো প্রথাগত শ্রেণীর সিঁড়ি। সিঁড়িটি তার পিছনদিকে, সেদিকে তার খেয়াল নেই। সিঁড়িটি আমার সামনে, তবে আগ্রহ নেই পেরুনোর।

এই একঘেঁয়ে দৃশ্যটি কেন বর্ণনা করছি? কেন খোল-নলচে খুলে ফেলছি এই দায়সারা যাপনের? কেন চেষ্টা করছি মুহূর্তের ভাঁজের ভেতরের মুক্তোকে তুলে আনার? এরকম আটপৌরে বর্ণন কে শুনেছে কবে? আমারও তো জানা ছিলো না, এই মুহূর্তের পিঠে এক অভূতঘটন ঘটে যাবে। যে ঘটনার সাথে আমি বা সে জুড়ে যাবো না; আবার ভেবে দেখি যে আমি ও সে জুড়ে গেছি নিরুপায়! আমরা উত্তরদিকে যাচ্ছিলাম, ডান গালে হেলে পড়া সূর্যরশ্মির তোড়ে ভাসতে ভাসতে। আমাদের উল্টোদিকের রাস্তাটি ফাঁকা ছিলো, সেখানে কেউ ছিলো না কেবল শব্দহীনতা ও আলোক প্রাচুর্য। আলোর বেগেই এক দ্রুতযান ছুটে এলো। গতিময় দ্বিচক্রযান। মোটা মোটা টায়ারের মোটর বাইক গোঁ গোঁ করে ছুটে যাচ্ছিলো চোখের পলকে। তবু তা একঘেঁয়ে, তবু তার মধ্যে কোন উদ্দীপনা নেই। আমি বা সে কেউই তাকাই নি সে'দিকে। আমাদের পথ ছিলো উত্তরমুখী।

বিকট শব্দের চুম্বক আমাদের টেনে নিলো। প্রকাণ্ড বাজ পড়েছে খালি রাস্তায়। বাতাসের পর্দা ফ্যাড়ফ্যাড় করে চিরে ফেলেছে কেউ। ল্যাতপ্যাত করছে ভাঙা মোটর বাইক। সামনে ছিটকে চলে গেছে অশ্বারোহীর হেলমেটটি। অশ্বারোহী মোটরবাইক থেকে কিছুটা পিছনে। রাস্তার গায়ে এক জ্বালামুখ, আগ্নেয়গিরিসম ফুলকি দেখলাম সেখানে গনগনে ফুটছে। অশ্বারোহীর ছিন্নমুখ, খিন্নচোয়াল, সেখানে কটকট করে তড়পাচ্ছে। আমার ও চালকের প্রবল বমিতে উত্তরমুখী রাস্তাটি ভেসে ভেসে যেতে থাকলো। পদার্থের ভেতর থেকে দুইমুখা রাস্তায় গলগল করে বেরিয়ে আসছে শব্দ ও আলোকরশ্মিময় শক্তি... শক্তি!...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন