রবিবার, ২০ এপ্রিল, ২০১৪

লজিকন ডায়রি

আজকে আমাদের ক্যাম্পাসের "লজিকন" (LogiCon) ছিল। এটা অনেকটা কমিকন-এর মতো উৎসব, মূলত ছাত্র সংগঠনের উদ্যোগে বিজ্ঞান, সংশয়বাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন বক্তা এসেছিল। আমি আগ্রহ নিয়ে গেলাম কারণ কার্ল স্যাগানের ছেলে ডোরিওন স্যাগান আসবেন key-note speaker হিসেবে কথা বলতে। কিন্তু তার চাইতেও ভাল লাগলো আরেকজনের কথা।

সারাদিনের অনুষ্ঠান, কিন্তু ছুটির দিনে সকালে আলস্য নিয়ে উঠতে উঠতেই দুপুর। লাঞ্চের পর গেলাম, দেড়টার দিকে ড্যারেল রে মঞ্চে উঠলেন। বিষয়টা ছিল যৌনতা ও লিঙ্গের বিবর্তন। খুবই ইন্টারেস্টিং ব্যাপার-স্যাপার। অভিজিৎ রায় একটা ব্লগ সিরিজ (পরে যেটা বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে) লিখেছিলেন, "সখী ভালোবাসা কারে কয়"। সে সিরিজটা পড়ে কিছু কিছু বিষয়ে জানা ছিল, তবে আজকে ড্যারেলের স্পিচ থেকে আরো নতুন নতুন বিষয়ে জানলাম। বিবর্তনের ধাপে আমাদের মাসতুতো ভাই জানতাম গরিলা আর শিম্পাঞ্জিকে। বোনোবো নামে আরেক মাসতুতো ভাই আছে যার কথা প্রথম শুনলাম। এবং বোনোবোর সাথে আমাদের মিলই বেশি!

ড্যারেল লোকটা খুবই মজা করে কথা বলেন। আরকানসাস একটা গোঁড়া রিপাবলিকান স্টেট। তিনি নিজেও ক্যানসাস স্টেটের মানুষ, আশির দশক পর্যন্ত চার্চের সাইকোলজিস্ট ছিলেন। আর এখন ধর্মত্যাগী মানুষদের কাউন্সেলিং করেন। এই অঞ্চলের মানুষ ধর্মের ব্যাপারে বাংলাদেশের মানুষের মতই আচরণ করে। সমাজে ধর্মের প্রভাব, কুসংস্কার, বর্ণবাদ, এগুলো অনেক তীব্র। চার্চের সামাজিক ক্ষমতাও প্রবল। এখানে সমকামিতা পাপ, গর্ভপাত অবৈধ। এরকম বদ্ধ পরিবেশে বেড়ে ওঠা যে কারো জন্যই ধর্মত্যাগের জন্য যথেষ্ট মোটিভেশন লাগার কথা। ড্যারেলের প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম ছেড়ে দেয়ার পেছনে তার পেশার অভিজ্ঞতা একটা বড় প্রভাবক ছিল বলে মনে হলো।

পেশার কারণে বিভিন্ন মানুষের ভেতরের দ্বন্দ্ব নিয়ে সরাসরি কাজ করেছেন তিনি, আর নিজের ভেতরেও এমন ধর্মের দমন-পীড়ন অনুভব করেছেন নিশ্চয়ই। যেমন, যৌনতার সাথে ধর্মের সাপে-নেউলে সম্পর্ক। এজন্য ধর্মের ভেতরে থাকা মানুষ যৌনতা নিয়ে কথা বলতে অসম্ভব লজ্জা, অস্বস্তি এবং বাধা বোধ করেন। ধর্ম যৌনতাকে ধামাচাপা দিতে চায়, যা আসলে প্রকৃতিবিরুদ্ধ ব্যাপার। এই পীড়ন এতোটাই প্রবল যে নিজের জীবনসাথীর সাথে যৌনতার ব্যাপারগুলো নিয়ে আলাপ করেন না অনেকে। এই দমনের কারণে শিশু ও কিশোর-বয়সীরা সঠিক যৌনশিক্ষা পায় না। বেশিরভাগই এতটাই অজ্ঞ থাকে যে কোন পারভার্ট যদি সেক্সুয়াল এবিউজ করে, সেটা ঠেকানো তো দূরের কথা, বুঝতেও পারে না। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে যেমন, যৌনতার এই অবদমনের কারণে যৌনবিকারগুলোর ছড়াছড়ি দেখা যায় বেশি। দেখা গেছে, যে স্টেটে এই দমনমূলক আচরণ কম, সেখানে বিকারগুলো কম। যেখানে স্কুলে-কলেজে সঠিক যৌনতা শেখানো হয়, সেখানে ধর্ষণ কম, ইন্টারনেটে পর্ন খোঁজার পরিমাণও কম। এসব ডেটা নির্দেশ করে যে যৌনতার আলাপকে ডাল-ভাত খাওয়ার মতো ব্যাপার না বানালে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।

যারা এরই মধ্যে ব্যক্তি পর্যায়ে যৌনতার ট্যাবু কাটাতে পেরেছেন, তাদের মাঝেও অনেক সময় ছোটবেলার শেখা আচরণের কিছু কিছু থেকে যায়। যেমন নিজের শরীর নিয়ে লজ্জা বা অস্বস্তি। অন্য একজন মানুষকে ভালোবাসার আগে নিজেকে ভালোবাসা জরুরি। আমি এই পৃথিবীতে একবারই জন্মাবো, আর এই জন্মে আমার শরীর একটাই। সেই শরীর বোঝা হয়ে গেলে বেঁচে থাকাই তো দুস্কর, তাই না? তাই নিজের শরীরটাকে সবার আগে ভালোবাসা লাগে। এটা আমাদের ধর্মে নিষেধ করে। প্রায় সব ধর্মেই করে। নিজের শরীরকে আরাম দেয়া এক গর্হিত অপরাধ! অথচ কোন যুক্তি হয় না। ধার্মিক হলেও এটা চিন্তা করা উচিত, যে আপনাকে যা মানতে বলা হচ্ছে, তা মেনে আদৌ কোন উপকার হচ্ছে, নাকি ক্ষতি হচ্ছে।

আরেকটা বড়ো ট্যাবু হলো নারীর যৌনতা। এইটা যেন একটা রূপকথার ইউনিকর্ন! যেন নারীর কোন যৌনতা থাকতেই পারে না। সে হবে পুরুষের যৌনতা মেটানোর মাধ্যম মাত্র। অথচ নারী, পুরুষের মতোই যৌনতাবোধ করে। এটা পুরুষকে যেমন জেনে ও মেনে নিতে হবে, তেমনি নারীকেও বুঝতে হবে। নারী বা পুরুষ, সর্বোপরি মানুষ হলে তাকে অপর একজন মানুষের যৌনতার ব্যাপারে নন-জাজমেন্টাল অবস্থান আমাদের প্রজাতি হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষ তো সুবিধাবাদী আর ক্ষমতাবান বলে নারীর ব্যাপারটা বুঝতে চায় না। সেটা তবু আমি বুঝতে পারি। ধনী কখনো গরীবের কষ্ট বুঝে না। দুঃখের ব্যাপার হলো, নারীও বুঝতে চায় না। নারী হয়েও আরেক নারীর যৌনতার প্রকাশকে পুরুষের মতো করেই নিন্দা করে। বেশি দূর যেতে হবে না, আমাদের আশেপাশেই এরকম উদাহরণ পাবেন। নারীর পোশাক ও জীবনধারণ নিয়ে কথা বলার সবচেয়ে বড় ঠিকাদারিটা অন্য নারীরাই নেন। এই ভণ্ডামি আর কতোদিন!  

এই আলাপটা বেশ গুরুগম্ভীর বিষয়, কিন্তু পুরো টক-টা এরকম ছিল না মোটেও। এগুলো ফাঁকে ফাঁকে এসেছে। মূল ফোকাস ছিল এই যে জীবদেহের সবচেয়ে দ্রুত বিবর্তিত জিনগুলোর মধ্যে বৈচিত্র্য এবং বিভিন্নতায় যৌন-জিনগুলোই সবচেয়ে এগিয়ে। অর্থাৎ, প্রাণী ও উদ্ভিদে যৌন-জিন সবচেয়ে তাড়াতাড়ি বিবর্তিত হয়। এই জিনের প্রভাব বাহ্যিক হতে পারে (যৌন-অঙ্গের আকার ইত্যাদি), কিংবা হতে পারে আভ্যন্তরীন (যৌন-আচরণের বিচিত্রতা)। বংশগতি বা heredity এর কারণে নিজের সবচেয়ে সফল জিনকে যেমন আমরা পরের প্রজন্মে দিয়ে দিতে চাই। এই চেষ্টাটা মাধ্যম যৌন-অঙ্গ এবং যৌন -আচরণের ওপর নির্ভর করে বলেই এরা আশেপাশের পরিবর্তনের সাথে দ্রুত বদলে যায়।

একটা মজার জিনিস দেখলাম, আগেও জানতাম, কিন্তু এভাবে খেয়াল করি নি। ফুল আসলে উদ্ভিদের যৌন-অঙ্গ। আমরা যখন কোন গোলাপ নাকে ঠেকিয়ে গন্ধ নিচ্ছি, তখন আসলে ঐ গাছের যৌনাঙ্গে নাক ঠেকাচ্ছি। (এর পরে ফুলের গন্ধ নিতে গিয়ে কারো 'eww' লাগলে আমি দায়ী না!)। আরেকটা "পোয়েটিক" ব্যাপার হলো মানুষ প্রেমের সময় একে অপরকে এই ফুল দিয়ে ভালোবাসার প্রকাশ ঘটায়। খুবই ইন্টারেস্টিং না?

গাছের ফুলের মতো প্রাণীর যৌন-অঙ্গ ও আচরণও বিচিত্র রঙ-ঢঙে ভরা। শুধু স্তন্যপায়ী এবং আদি-বানরের উত্তরসূরী চারটা প্রজাতির মাঝেও বিচিত্র সব আচরণ দেখা যায়। এগুলোর প্রায় সবই অভিজিৎ ভাইয়ের ব্লগে চলে এসেছে, আমি আর বিস্তারিত বললাম না। আগ্রহীরা লিংকের সিরিজটা দেখে নিয়েন।

এরকম উৎসবে গেলে অনেক কিছু জানার পাশাপাশি পুরা চিন্তার জগতে একটা ওয়াশিং মেশিন ইফেক্ট হয়। মাঝে মাঝে নিজেকে চেক-অ্যান্ড-ব্যালেন্স করার জন্য তাই এগুলোর দরকার আছে। ডরিওন স্যাগান সেই জায়গায় একটা টোকা দিয়েছেন। সেটা নিয়ে সামনে লিখবো!

২টি মন্তব্য:

  1. হিংসিত হলাম। বিবর্তন আর্কাইভের জন্য ছোট করে লিঙ্গের বিবর্তন নিয়ে লেখা দিতে পারবেন?

    উত্তরমুছুন