মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৪

লজিকন ডায়রি ২

|আগের পর্ব|

বিবর্তন এবং বুদ্ধিমান প্রাণীর কথা এলেই আমরা সাধারণত ডাইনোসর কিংবা অন্য কোন প্রাণী নিয়ে কথা বলি। যারা দাপটের সাথে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়িয়েছে এবং একসময় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আমি বরং তার চেয়ে নিকটের কিছু নিয়ে বলি- আমরা যে গোত্রের প্রাণী, সেই গোত্র নিয়ে। পৃথিবীতে হোমো গোত্রের উদ্ভব হয়েছে মাত্র আড়াই কোটি বছর আগে। হোমো স্যাপিয়েন্স অর্থাৎ আমাদের উদ্ভব হয়েছে মাত্র দুই লাখ বছর আগে। তার মানে হোমো গোত্রের অন্য প্রজাতির স্তন্যপায়ীরা দুই কোটি আটচল্লিশ লাখ বছর ধরে পৃথিবীর বুকে বিচরণ করে বেড়িয়েছে, তারপর একে একে বিলুপ্তও হয়ে গেছে। তাদের হাড়-গোড় দেখে আমরা জানতে পেরেছি যে তারা আমাদের অস্তিত্বের চাইতে অনেক অনেক বেশি সময় ধরে পৃথিবীতে ছিল। এরা অনেকটা আমাদের মতোই ছিল, আমাদের সাথে এদেরই সবচেয়ে বেশি মিল।

এদের বিলুপ্তি কি নির্দেশ করে যে আমরাও একদিন পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবো? অন্য কোন প্রজাতি উদ্ভব হবে নাকি? কিংবা ইতোমধ্যে যেসব প্রাণী আছে সেগুলোর কোন একটি থেকে আরেক বুদ্ধিমান/শক্তিমান প্রজাতি এসে পৃথিবীতে খাপ খাইয়ে নিবে? হতে পারে। এমনও হতে পারে আমরা এই গ্রহ ছেড়ে অন্য গ্রহে চলে গেলাম। এই গ্রহকে বিষাক্ত করে বসবাসের অনুপযোগী আমরাই করে তুলছি। পৃথিবী নিজেই নিজেকে সুস্থ করে তোলে, তাই আমাদের দূষণ হয়তো সে শুধরে নিতে পারবে। কিন্তু আমরা যেভাবে সংখ্যায় বাড়ছি, সেটাও তো ভয়ানক। এই হারে বাড়তে থাকলে একসময় ব্যাকল্যাশ অবশ্যম্ভাবী। বিভিন্ন দুর্যোগ আর অভাবে আমরা নিজেরাই নিজেদের ধ্বংস করে দিতে পারি।

প্রজাতি হিসেবে এইসব লক্ষণ বলে, আমরা হয়তো ডাইনোসর বা অন্য প্রজাতির চেয়ে খুব বেশি বুদ্ধিমান নই। ভবিষ্যতের অন্য বুদ্ধিমান প্রজাতি যখন আমাদের ফসিল পরীক্ষা করবে, তখন হয়তো একই কথা মনে করবে। দাপুটে, কিন্তু বেকুব।

পৃথিবীতে আমাদের আপেক্ষিক স্থায়িত্ব বুঝতে নিচের ছবিটা ভাল নির্দেশক হতে পারে। বড় করে দেখতে এখানে ক্লিক করুন।



We love to think we are special, but the history of science suggests otherwise.

আমাদের অন্যতম স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো আমরা লিখতে-পড়তে পারি। আমরা আমাদের চিন্তা-ভাবনা-কাজ-সৃষ্টি রেকর্ড করে রাখতে শিখেছি। এই একটি বৈশিষ্ট্যই আমাদের অনেকদূর এগিয়ে দিয়েছে। মানব প্রজাতি গত এক লাখ পঁচানব্বই হাজার বছরে কতোটুকু এগিয়েছিল? আর গত পাঁচ হাজার বছরে কতোটুকু এগিয়েছে? এটা তুলনা করলেই বুঝতে পারি যে আমাদের অভিনবত্ব কোথায় লুকানো আছে। অন্য প্রজাতির থেকে বহু বহু গুণ এগিয়ে এসে আমাদের ভেতরে আত্মম্ভরিতার (self-aggrandizement) জন্ম হয়েছে। আমরা নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব ভাবতে শুরু করেছি। এই মিথ্যাটি এতো শক্তিশালী কারণ এটা একজন উচ্চারণ করা মাত্রই যারা শুনছে সবার মগজে একটা আরামের রাসায়নিক ক্রিয়া হয়। আমি জানি না প্রথম কোন মানুষ এই কথাটা বলেছিল, কিন্তু যারা তার আগে এভাবে ভাবে নি, তারা এটা শোনামাত্রই ভাবতে শুরু করেছিল, সেই ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। ধীরে ধীরে এটা ধর্মীয় বাণী হয়ে গেছে! অনড়, অটল, অলঙ্ঘনীয়! কিন্তু উপরেই ব্যাখ্যা করেছি যে আমরা আসলে অন্য প্রজাতির চাইতে খুব বেশি এগিয়ে নাই, এবং আমাদের বিলুপ্তিও just around the corner!

ভবিষ্যত বিলুপ্তি ছাড়াও আরেকটি যুক্তিতে ব্যাখ্যা করতে পারি যে আমরা আসলে ততোটা স্পেশাল কিছু না। এই পরীক্ষাটা ডোরিওন স্যাগান তার বইতে ব্যাখ্যা করেছেন, আমি তুলে দিচ্ছি। ধরুন, এই মুহূর্তে স্পেসশিপে চড়ে কোন উন্নত বুদ্ধিমত্তার এলিয়েন আসলো পৃথিবীতে, যেমন বিভিন্ন হলিউডি মুভিতে দেখায়। তাদের হাতে প্রফেসর শঙ্কুর এনাইহিলিশন গান, যে বন্দুকের গুলিতে টার্গেট হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। ধরি এলিয়েনরা আমাদের একটুও পছন্দ করলো না। আমাদের দিকে গানটা তাক করে প্যারামিটার সেট করলো "এনাইহিলেট হোমো স্যাপিয়েন্স"। চিন্তা করুন তো গুলি করা মাত্রই আমরা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবো। কিন্তু আমাদের শরীরের ভেতরে বসবাস করা কোটি কোটি ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, অণুজীব ইত্যাদি কোথায় যাবে? বন্দুকে তো তাদের মারতে বলা হয় নি। গুলি করা মাত্র আমাদের কোষ-কলা-অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উবে যাবে। কিন্তু আমাদের অবয়বের আদলে ওসব প্রাণী রয়ে যাবে। আমাদের ত্বকের ভেতরে থাকা ভাইরাস, পেটের ভেতরে থাকা ব্যাকটেরিয়া, আর সারা শরীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য অণুজীব কিলবিল করতে থাকবে আগের মতোই। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে এরা প্রায় সকলেই মানব-দেহের ওপর নির্ভরশীল, খাদ্য এবং আশ্রয়ের জন্য। আমাদের শরীরটা না থাকলে তারা বেশিক্ষণ টিকতে পারবে না। তার মানে আসলে আমরাও এসব প্রাণী ছাড়া টিকতে পারবো না। টেকা দূরের কথা, এরা আমাদের শরীরে আছে বলেই আমরা মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারি, নাহলে জন্মের সাথে সাথেই আমাদের মৃত্যু হতো। জন্মই হতো না, শুক্রাণু আর ডিম্বাণু মিলে জাইগোটটাই তৈরি হতো না, বাকি সব তো দূরের কথা। তার মানে আমরা আমাদের যে অস্তিত্ব এবং ক্ষমতা নিয়ে অহঙ্কার করি, তা একেবারেই ঠুনকো। যেসব অণুজীবকে সামান্য বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করি, তারা আমাদের জন্মের পরিবেশ তৈরি করে দেয়। শুধু তাই না, বিবর্তনের সময়ের হিসেবে তারা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি সময় ধরে পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রজাতি হিসেবে আমরা তাদের বয়সের তুলনায় নেহাতই দুগ্ধপোষ্য শিশু!

তাই পৃথিবীতে প্রাণের অতীত বা ভবিষ্যত দেখলে আমাদের প্রজাতির অস্তিত্ব ও গুরুত্ব তেমন বেশি কিছু না। এই কঠিন সত্যটা মেনে নিতে আমাদের অনেক কষ্ট হবে। কিন্তু তিক্ত সত্য এটাই।

এখন কথা হলো এইটা এতই জরুরি কেন? কারণ ডোরিওন স্যাগানের মতে আমরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার কম্পাস হারিয়ে ফেলছি। আমাদের তাড়না, প্রেরণার ক্ষেত্র খুব দ্রুত বদলে গেছে। যুদ্ধ একটা বড়ো কারণ, অস্থিরতা এবং অর্থনীতি আরেকটা কারণ। আর রাজনীতি তো আছেই। এসবের প্রভাবে আমাদের সামষ্টিক সমাজে বিজ্ঞান ও গবেষণার চেহারাটা সুখকর বা হিতকর না। প্রজাতি হিসেবে আমরা নিজেদের টিকিয়ে রাখার কোন চেষ্টাই করছি না। গ্লোবাল ওয়ার্মিং থেকে শুরু করে নানাভাবে আমরা একমাত্র বাসস্থানের তেরোটা বাজাচ্ছি। নিজেরাও মারামারিতে এতো ব্যস্ত যে শান্তিমতো বসে চিন্তা করার সুযোগটাও হচ্ছে না। আবার পৃথিবীর বাইরে কোথাও আরেকটা আবাসও সেভাবে খোঁজা হচ্ছে না। আর সব যুদ্ধ থামালেও অচিরেই আমাদের সংখ্যা পৃথিবীর অন্য প্রজাতি এবং আমাদের জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। সেক্ষেত্রে পৃথিবীর বাইরে কলোনি/আবাস বানাতেই হবে। সেদিকেও কাজ হচ্ছে না। আমরা এই অসীমতুল্য মহাবিশ্বের নামমাত্র বিচরণ করেছি, অতোদূর আমাদের ক্ষমতাও হয় নি এখনো। কিন্তু যেটুকু দেখা হয়েছে, সেটাও পুরোপুরি সঠিকভাবে দেখা হচ্ছে না। সব মিলিয়ে একটা ভজঘট।

আর এই আলস্য এবং অপারগতার মূল প্রভাবক আমাদের আত্মতুষ্টি আর আত্মগরিমা। আমরা প্রজাতি হিসেবে ক্ষুদ্র ও সীমিত, এবং ধীরে ধীরে বিজ্ঞানের পথে আমাদের প্রয়াসগুলো ভুলদিকে যাচ্ছে। এটাকে চিহ্নিত করতে হবে, সত্য হিসেবে মেনে নিতে হবে। এর মাধ্যমেই হয়তো পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে এই চেতনা ছড়ানো সম্ভব।

[লেখাটা ডোরিওন স্যাগানের কথা দিয়ে শুরু হলেও শেষের অংশটুকু আমার নিজের চিন্তা চলে এসেছে। তার বই Cosmic Apprentice -এর প্রথম অধ্যায়টা এই লিংকে পাবেন।]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন