শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০০৮

কবিতাপাঠের বায়োপ্‌সি

ইদানীং কবিতা বেশ রক্তে ঢুকে যাচ্ছে। অথবা রক্তে আগেই ঢুকে গিয়েছিল কোনও এক অসতর্ক মুহুর্তে, এখন নালী জুড়ে তার চলন টের পাচ্ছি। সেই চলনে অস্থিরতা নেই। এলিয়েন বস্তু শুনেছি- শরীর বেশিদিন টিঁকতে দেয়না, বের করে দেয়। আর বের করে দিতে না পারলে তার রিঅ্যাকশন শুরু হয় জ্বর-জারি, ইনফেকশন, অ্যালার্জি এসবের মধ্যে দিয়ে। তবে আশার কথা আমার শরীর এখনও কবিতাকে অতটা উটকো ভাবছে না। হয়তো কালের সাথে তার সহনশীলতাও বেড়েছে!


দীর্ঘ উপক্রমণিকার কারণ বলে নিই, এটা আসলে সততই আমার মধ্যে খেলা করছে। লেখালেখি গুরুত্ব দিয়ে শুরু করেছি অনেকটা সময় পরে এসে। সেখানে গুরুত্বটুকু প্রথমে শুধুই আত্মকেন্দ্রিক শখ বা সুখবিলাসজাত ছিল। কিন্তু যেহেতু ক্রিয়ার অপর পিঠেই প্রতিক্রিয়া জন্মায় ঈস্টের মতোন, সেহেতু আমার লেখাতেও নানান অনুভব তৈরি হয় আর আমার কাছে ফিরে আসে। তখন আসলে একটা আলোচনার প্ল্যাটফর্ম তৈরি হয়। ক্রমশ টের পাই, কবি আমি ছাড়িয়ে ব্যক্তি আমি জায়গা করে নিচ্ছি। সেটা পাঠককেও হয়তো আরো স্বচ্ছতা দিচ্ছে।


তবে এই মিথস্ক্রিয়ার মাঝে আমি এটাও টের পাই একটা ভিন্নসুর জেগে ওঠে। হয়তো মানব বৈচিত্র্যের কারণেই। সেখানে নিজের মতটাই প্রকাশ করার মাধ্যমে অংশ নিতে পারি। কবিতার ভাষা নিয়ে ফরহাদ উিদ্দন স্বপনের একটা পোস্ট দেখলাম। সেখানে প্রচুর আলোচনা হয়েছে। সে আলোচনায় আমি খেয়াল করিনি আগে বলে অংশ নিতে পারিনি। তবে সেই লেখাটিই কিছু কথা আমার ভেতর থেকে বের করে আনছে। সেগুলো একে একে বলি।


প্রথমেই লেখক-পাঠকের যোগাযোগের ক্ষেত্রটি নিয়ে কিছু কথা বলি। আমি যখন লেখক, তখন একটা কবিতা আমার হাত দিয়ে বেরিয়ে আসার সময়ে অনেক জন্ম-প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে যায়। সেটা এক এক কবির এক এক রকম। সেই প্রক্রিয়া নিঃসন্দেহে চমকপ্রদ, সৃজনশীল লেখালেখির প্রতিটা ক্ষেত্রেই হয়তো তা খাটে। তবে অনেক জাদু দেখে যেমন মনে একটা প্রশ্ন জাগে জাদুর পেছনে রহস্যটা কী, তেমনি কবিতাপাঠের পরেও পাঠক হিসেবে অনেকেরই হয়তো মনে আসে, লেখক এই কবিতা কী ভেবে লিখেছেন? তার চিন্তা আর মস্তিষ্কে কী রসায়ন চলেছে? শব্দ আর পংক্তিগুলো দিয়ে তিনি কী বুঝিয়েছেন? এই স্বভাবিক প্রশ্নগুলোকে আমি একটু ভিন্ন চোখে দেখি।


আমি যেকোনও কবিতাকে মনে করি একটা চশমা-র মতোন। সে চশমার মধ্য দিয়ে কবি কিছু একটা দেখেছেন, লিখেছেন। সেই লেখাটি আমি পাঠক যখন পড়বো, আমি একটা বা ভিন্ন ভিন্ন কিছু দৃশ্য পাবো। আমার মধ্যে একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয়। কিন্তু সেটা কতটুকু কবির সাথে মিললো, তা আমি কখনোই বিচার করতে যাবো না। তার পিছনে কারণ বহুবিধ। কবির চিন্তার পাটাতন আর আমার চিন্তার পাটাতন এক হবার কোন কারণ বা সুযোগ নাই। আবার আমার দেখনভঙ্গি কবির চেয়ে স্বতন্ত্র হোক এটাও আমি চাইবো।


এই দেখাটা জরুরি। বা এই মনোভাবটা কবিতার উদ্দেশ্য পূরণে পাঠকের দৃষ্টিকোণ থেকে জরুরি। পাঠকের উদ্যোগ এক্ষেত্রে লেখকের চাইতেও বেশি।


সমসাময়িক একটা বিষয় চলে আসে। কোন কবিতাকে বিচার করার বা পাঠ করার ক্ষেত্রে আমরা খুব বেশি বিভাগ করে ফেলিঃ ভালো, খারাপ, মন্দ, নতুন, ফালতু, চমৎকার, অপ-, কু- ইত্যাদি নানান বিশেষণ, প্রত্যয় যোগ করে। এটা নিয়ে এখানে একটা মোটামুটি তোলপাড়ও চলেছে কিছুদিন আগে। তবে সেটা অন্য কথা।


এখানে এই বিভাগকরনের বিপক্ষে অনেককিছুই বলা যায়। আবার পক্ষেও অনেক কিছু টেনে আনা যায়। তবে আমি এই স্বতস্ফূর্ত শ্রেণীবিভাগের কারণটি বের করতে একটু তৎপর হই। জিজ্ঞাসার পেছনে উত্তরটা অনেকটাই এসে পড়ে এরকম যে আমরা কোনকিছু, সেটা যে রচনাই হোক না কেন, তাকে বিশেষায়িত করতে পারলে স্বস্তিবোধ করি। একটা ফরম্যাট দাঁড়িয়ে গেছে বা দাঁড় করানো হয়েছেঃ গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, কবিতা, ছড়া এরকমের কিছু প্রধানভাগ; অণু-পরমাণু-বড়-ছোট এরকম শব্দ প্রধানভাগের আগে জুড়ে দিয়ে সেকেন্ডারি ভাগ; তারপরেও আরো নানা রকম ভাগ করা হচ্ছে আলাদা আলাদা ক্ষেত্রে।


কবিতার জন্যে সেই ভাগ দশকভিত্তিক, শতকভিত্তিক হয়ে থাকে। রোমান্টিক, আধুনিক, উত্তরাধুনিক এরকম হয়ে থাকে। আবার নানা মতবাদ ভিত্তিকও হয়ে থাকে। এতোদূর যারা পড়ে ফেলেছেন, তারা যেমন, তেমনি আমি নিজেও হাঁপিয়ে উঠেছি। সংজ্ঞাভারে মাথা নুয়ে আসছে, কাঁধ ব্যথা করছে, চোখ জ্বলছে এবং কান ভোঁভোঁ করছে। আর সব পাঠকের মতোন আমিও এই সবকিছু জঞ্জাল হিসেবে ছুঁড়ে ফেলে দিতে চাই। কী দরকার অনর্থক বিভক্তির? একটা কবিতা, তা সে যেমনই হোক না কেন, যার দ্বারাই লিখিত হোক না কেন, সেটা শেষপর্যন্ত একটা কবিতাই! সেই কবিতার কোনও বাস্তব উপযোগ নাই, কর্মসম্পাদনে সহায়কও নয় কবিতা। নেহায়েত কোনও গূঢ় "পেছনের কথা" না থাকলে সেটা আদৌ কোন অর্থবোধকও হয় না।


তাহলে আমি একজন পাঠক হিসেবে কি কবিতাপাঠ করতে পারি? যদি পারি, তাহলে তা কতটা দরকারি? বা কবিতা নিজে আমাকে কতটা তার পাঠক হিসেবে গ্রহণ করবে সেটাও আনুষঙ্গিক প্রশ্ন। আমি মনে করি একজন গল্প বা প্রবন্ধপাঠকের চেয়ে কবিতা পাঠককে অনেক বেশি মাত্রাসম্পন্ন হতে হয়। সেখানে তার জন্যে কিছু সংবেদনশীলতা স্বভাবতই কবিতা দাবি করে। সেকারণেই কোনও দ্রুত প্রকরণেও যেতে চাইনা। ঘুরে ফিরে সেই প্রথম কথাটুকুর কার্যকারণ বের করে ফেলতে পারি। শরীরে মননে আসলেই কবিতা বিস্তারী ভালোবাসার মতোন ছড়িয়ে পড়ছে।


***
[ছাড়া ছাড়াভাবে কিছু কথা বেশ অনেকদিন বা কিছুদিন ধরে জমেছে। সেগুলোকে প্রক্রিয়াজাত না করলে অস্বস্তিবোধ... এবং ক্রমান্বয়ে অস্থিরতা। সে অস্থিরতার গলা টিপতেই এই লেখা!]

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন