রবিবার, ২ আগস্ট, ২০০৯

দৃশ্যকল্প


ড্রয়ার
দৃশ্যকল্পের কয়েকটা গাছ বুনেছিলাম ঘরের কোণে রাখা পুরনো আলমারির ভেতরের
চাবি দেয়া ড্রয়ারে। ঘষাছাল চামড়া থেকে অনুমেয়ঃ আমার বয়সের দ্বিগুণ বয়সী কাঠের
আলমারি প্রায়শঃ বৃদ্ধ শরীরে বহু টানাপোড়েন, টানাহ্যাঁচড়া, বাসাবদলের স্মৃতি ধরে
রাখেন। মূলত গৃহস্থের ঘরে অন্য সবার সাথে জায়গা না হওয়ায় তার অবস্থান এ ঘরে
ঘটেছে, এমন তথ্য মনে সৌহার্দ্যের জন্ম দেয়। আর্দ্রতা ও শৈত্যপ্রভাবে কাঠের শরীরে
প্রসারণ-সংকোচন, ফলতঃ ড্রয়ারের খোল ও কাঠামো ঢিলে, নড়বড়ে করে হয়ে গেছে,
তাই চাবি দেয়া ড্রয়ার যথেষ্ট অগোপন- মৃদু আন্দোলনেই প্রতিরোধ তার, ভেঙে পড়ে।
তবু গোপনীয়তা ফাঁসের এই সমূহ সম্ভাবনা মাথায় রেখে যাবতীয় সম্পদ, সম্পত্তি,
অর্থবাচক স্থাবর আবেগ সেই কুঠুরিতেই নিরীহ ঘুম-মগ্ন। এবং সম্পদের ভাঁজে কিছু
দৃশ্যকল্পের গাছ ন্যাপথলিনের পোকারোধক-ভূমিকা পালন করে, স্মৃতিজাত গবেষণায়
প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সম্পদের সুষ্ঠু বিতরণ না ঘটিয়ে পুরনো আলমারির ড্রয়ারে চাবি
দেয়া থাকলে আমাদের এই তৃতীয় বিশ্বেও মন্দা দেখা দিবে। দৃশ্যকল্পের গাছেরা তাই
আলোহীন কুঠুরিতে স্মিতমুখে আগাছার জনন দ্রুততায় বেড়ে ওঠে। দিনমান ব্যস্ততায়
তাদের ভুলে থাকা যায়, ড্রয়ারটি অমনোযোগে ভারি থেকে ভারি হতে থাকে, হায়
সকল বনসাই দৃশ্যকল্পের ফুল, নরম গালিচা স্মৃতির শবাধারে বিমুগ্ধ শ্রোতা- আর দেখো
আমাদের সকল বসবাস জুড়ে কী ভীষণ জমকালো শোক। অনাদিব্যাপী বনসাই চিত্রলেখ।




অজগর
প্রতিটি শকটে জ্বলন্ত লাল ও হলুদ চোখ, স্থবির অজগর বাঁকানো কালো শরীরে
পড়ে আছে। নদীতটে বা ঘাটে জমানো নৌকার মত দুলছে, নিভছে, ধীরে, ধীরে
এই আধুনিক বাহনে ছইয়ের মত উঁচু হয়ে থাকা পেটের ভেতর শীতল বাতাস
তোমাদের অন্তর্বাসে হিম বরফকণা চেটে শুয়ে থাকে। সূক্ষ পুলকসমূহ দীর্ঘশ্বাস
হয়ে চোরাগোপ্তা পথে তুলোর পোশাক চুঁয়ে চুঁয়ে শকটের পাঁজরে লেগে থাকে,
এবং ভিক্ষাপ্রার্থীর খোঁড়ল-জমা দৃষ্টিতে কয়েকটি চাঁদে-পাওয়া আহ্বানের ফাঁকে
সেগুলো চুপিসারে পাচার হয়ে যায়- শকটবন্দীর অন্তর্বাস হতে পুলকচুরি অহরহ
ঘটছেই। জনপদ বিধাতার সভাসদের শয্যা থেকে ক্রমশ বিলীন নিম্নবিত্ত বিরহ!




গলনাঙ্ক
একটি বিষণ্ণ কাচের গেলাস উষ্ণজুনের তাপদাহে ঘামের শীতলবিন্দু বুকে মেখে
গোলাপি টিস্যুর পোশাক পরে আকুল কাঁদছে। দেখো কী সহজে সে কান্না দেখে
আমি স্ট্র দিয়ে টেনে নিচ্ছি হরিৎ তরল পানীয়। মনে পড়ে কুহকী অ্যাবসিন্থ আহা
জিহ্বার কোষ খুঁড়ে স্বাদের নেশা তুঙ্গে ধাপে ধাপে উঠতে থাকে। গলিত লোহা-
গোলানো পানিতে আমাদের প্রেম ও পাপ, বিবিধ গলনাঙ্কে মিশে যেতে থাকে
গেলাসের শীতলবিন্দুর প্যাভিলিয়ন হতে উষ্ণতার জুন কেবল চোখ মেলে রাখে।




সিঁড়ি
সন্ধ্যের পরে যেমন আঁধার নামছে, সভ্য নগরে
ওভারব্রীজ বেয়ে তুলোবোনা ওড়নাগুলো গিঁট বেঁধে
উঠে আসে
............আশে পাশে
.........................নেমে আসে
......................................ধাপে ধাপে


লোহার সিঁড়িতে ধুলোবন্দী মূল্যমানে তাদের
......................কৌমার্য
...............................বেণির ধৈর্য
............................................সাহচর্য
........................মিশে যেতে থাকে-
.....................শ্চ....................র্য


পেছনের পথে নুয়ে পড়া স্ট্রীটলাইটের জিহ্বা ও শিশ্ন থরথরে কাঁপন ধরে রাখে
লোহার পেছনে
দাঁতের পেছনে
রেলিঙের গায়ে
সিঁড়িদের পায়ে


বিগত সন্ধ্যার লালাভ দীপ্তি জ্বলজ্বলে হাসি হয়ে ঝরে পড়তে থাকে।


***






উৎসর্গঃ প্রণব আচার্য, প্রচ্ছদ এবং "প্রতিধ্বনি, তুমিতো"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন