রবিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১১

আমার বন্ধু রাশেদ

আমার বন্ধু রাশেদ একটি ভালো ছায়াছবি, মানে ফিল্ম। সিনেমাও বলা যায়। মোরশেদুল ইসলাম একজন ভালো পরিচালক। আমার বন্ধু রাশেদ বইটির লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল একজন ভালো লেখক।

এই তিন লাইনেই আসলে শুক্রবারের সিনেমা-দেখার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ফেলা যায়। কিন্তু তারপর আরো একটু বলতে গেলে আমি কিছুটা মুশকিলে পড়ি। বাক্য-বিন্যাস বা চিন্তা-প্রকাশের মুশকিল। অসুবিধা হয়ে দাঁড়িয়ে যায় কৈশোর ও প্রথম যৌবনের আবেগ। বাস্তবতার ভিতর থেকে অতি সহজেই সিনেমার ভেতরে প্রবেশ করেছি, এখন সেই বাস্তবতার মাঝে ফেরত আসতে ইচ্ছা করে না। সিনেপ্লেক্সের প্রায়ান্ধকার হলরুমটিকেই বাস্তব বলে মনে হতে থাকে। আর সামনে ওয়াইড-স্ক্রিন সিনেমার পর্দাটিকে আয়না বলে ভ্রম হয়। যে রাজশাহী শহরটিকে সেখানে দেখি, শহরতলীর মতো শান্ত, নিবিড়, রিকশার টুংটাং; সেই শহরটিকে সত্য বলে মনে হয়। সত্য বলে মনে হয় শফিক ভাই, অরু আপা কিংবা আজরফ রাজাকারকেও।

সম্ভবত এখানেই সিনেমার মুনশিয়ানা। পরিচালকের একক-দর্শন ছাপিয়ে তা হাজারো দর্শকের মন ছুঁয়ে দিতে পারে, কখনো তাদের হাসায়, কখনো তাদের কাঁদায়, কখনো তারা উল্লাস করে সিনেম্যাটিক বাস্তবতার দৃশ্য দেখে। এই সবকিছুর এক ঝলক পেয়ে গেলাম শুক্রবার বিকেলে।

যখন শহর ছেড়ে চলে গেলো প্রদীপরা, ইবু যখন দেখা করতে গেলো ভোর ভোর বেলায়, প্রদীপ যখন তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো, "আজকে থেকে আমরা বাস্তুহারা। আমাদের আর কোনো ভিটামাটি থাকলো না। আর কোনোদিন তোর সাথে দেখা হবে কি না জানি না!", তখন অজান্তেই চোখে পানি এলো। যুদ্ধের দমফাটা আর্তনাদের পিছনেও কতো লক্ষ মানুষের ঘরহারানোর কষ্ট একা একা গুমরে মরেছে! কেউ শোনে নি, কেউ জানতেও পারে নি। ভোর ফোটার আগেই তারা কষ্টগুলো পোটলা বেঁধে রিকশায় করে চলে গেছে সীমান্তের ওপারে। যেতে যেতে পাকিস্তানির গুলিতে মরেছে, বেয়োনেটে মরেছে, ধর্ষণ হয়েও আত্মহত্যা করেছে কতো শতো হিন্দু নারী, কিশোরী। এগুলো দলিলে আসে না। খালি শর্মিলা বসুরা থিসিস করে আর মেহেরজানরা প্রেম করে!

তারপর যখন দেখি, রাশেদ শার্ট খুলে মুখ ঢেকে আজরফ রাজাকারকে ভয় দেখায়। দুই চ্যালা রাজাকার আজরফকে খবর দিতে আসছিলো। রাশেদ আগেই গিয়ে বললো, "মুক্তিযোদ্ধারা এসে গেছে, তোমারে খুঁজতেছে", বলেই দ্রুত পালিয়ে গেলো। তখন আজরফের ভয় খাওয়া, পাতি রাজাকার দেখে মুক্তিযোদ্ধা ভেবে পড়িমড়ি করে দৌড় দেয়া আর রাজাকাররা তাকে ধরে ফেললে হড়বড় করে বলতে থাকা, "আমি বঙ্গবন্ধুর লোক, আমি জয়বাংলার লোক, আমারে মাইরেন না", শুনে হল ভরে তালি বেজে উঠলো। মনে হলো আত্মীয়ের মাঝে আছি, নিরাপদ আছি। এই হলরুমের বাইরেই একটা গোষ্ঠী আছে, যারা বাংলাদেশ চায় নি। তারা এখন বাংলাদেশের মন্ত্রী। দেশের অনেকখানি ক্ষমতা তাদের হাতে। সেই গোষ্ঠী একাত্তরের পরে "বঙ্গবন্ধুর লোক" হয়ে গিয়েছিলো চার বছরের জন্যে। আবার সময় এলে ঘাপটি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। সুবেশি এইসব রাজাকার ও রাজাকারমনা কেউ কি সেদিন হল-এ ছিলো? মনে হয় না।

আমার বন্ধু রাশেদ সিনেমা হিসেবে কেমন? এই বিচার কি আমি করতে পারি? মাঝে মাঝে কিছু সিনেমা নির্মিত হয়, যেগুলোকে সাদা চোখে বিচার করার ক্ষমতা দর্শকদের থাকে না। এর কারণ ছবিটির সাথে অনেক ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক আবেগ জড়িয়ে থাকে। এই আবেগ খারাপ কিছু নয়। আর বাংলাদেশিদের জন্যে এই আবেগ দুর্লভ হয়ে পড়ছে দিন দিন। আমরা এখন রিকনসিলিয়েশনের বাণী শুনি। মিরপুরে পাকিস্তানি পতাকা উড়তে দেখি। এই মিরপুরেই রাশেদের মতো চোখ বেঁধে কতো মানুষকে মেরে ফেলেছিলো আজরফের মতো রাজাকাররা, সেটা ভুলে যাই। অতীতের ভুলচুক!

"You fooled us once, shame on you. You fooled us twice, shame on us." - এই আপ্তবাক্যটি ভুলে যেতে আমাদের বেশি সময় লাগে না। হয়তো রাশেদদের কথাও আমরা ভুলেই গেছি। এখন সেগুলো প্যানপ্যানানি হয়ে গেছে। আমি সিনেমা দেখতে দেখতে খেয়াল করলাম, পিছনে এক ছোট্ট বাবু মায়ের সাথে ছবি দেখতে এসেছে। ক্লাস থ্রি কিংবা ফোর-এ পড়ে। ছবির ফাঁকে ফাঁকে তার প্রশ্নগুলো শুনছিলাম।

কী নির্দোষ, কি সরলমনে সে জিজ্ঞাসা করছে, "ওরা কেন গুলি নিয়ে যাচ্ছে?"
- "যুদ্ধ করার জন্যে, মা।"

"ওদের অনেক সাহস?"
- "হ্যাঁ, মা।"

"রাশেদকে কেন বেঁধে রেখেছে?"
- "মেরে ফেলবে, মা"

"কেন?"
...
...এর পরে আর বাবুটির মা জবাব দেয় না। কেন রাশেদকে মেরে ফেললো, কেনই বা আমরা রাশেদদের কথা বারবার বলি না, সেটা ওই ছোট বাবুটা এখন বুঝবে না। কিন্তু একদিন বুঝবে, সেদিন হয়তো আমাদেরকেই দোষ দিবে। আমরা কেন রাশেদদের কথা মনে রাখি নি, শিখাই নি বলে।

মোরশেদুল ইসলামকে ধন্যবাদ, যে ছবিগুলো নির্মিত হওয়া দরকার, সেগুলোর মাঝে একটি ছবি এত আন্তরিকতা দিয়ে তৈরি করার জন্যে। যে বিষয়গুলো জরুরি, যে কথাগুলো না বললেই না, সেগুলো বলার মানুষ খুব বেশি নেই। এই উপন্যাসটি কিশোর বয়সে কাঁদিয়েছে, ভাবিয়েছে। আর এতো বছর পরে এই ছবিটি আবারও কাঁদালো, ভাবালো। আর কী চাই!
রাশেদ আর ইবুর চরিত্রের অভিনেতা দু'জন চমৎকার অভিনয় করেছেন। হয়তো পেশাদার নয় তারা, কিন্তু যে আন্তরিকতা দিয়ে চেষ্টা করেছে, সেটা খুব ভালো লেগেছে। পাশাপাশি পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় (ইবুর বাবার চরিত্র) -এর গুজব নিয়ে কমিক রিলিফগুলো, কিংবা রাইসুল ইসলাম আসাদের (বড়ো বয়সের ইবু) স্মৃতিচারণের দৃশ্যগুলো মনে দাগ কেটে গেছে।
ছবির নির্মাণ বা কারিগরি দিকের বোদ্ধা আমি নই। কিন্তু এটুকু বলতে পারি যে সিনেমা কতো দ্রুত ও সহজে দর্শকের সাথে জুড়ে যেতে পারে, সেই বিচারে "আমার বন্ধু রাশেদ" অনেক এগিয়ে থাকবে। কিশোরদের জন্যে কিশোরদের অভিনীত ছবি সব-বয়সী দর্শকের চোখে জল আনছে, এই দৃশ্যটি চমৎকার। হল থেকে বেরিয়ে তাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
এখনও সময় যায় নি, এখনও সব ফুরিয়ে যায় নি। টিমটিম করে হলেও আশার প্রদীপ জ্বলছে। বাংলাদেশের সকল কিশোর-কিশোরীর এই ছবিটি দেখা দরকার। তাহলে হয়তো আমরা এমন একটি প্রজন্ম গড়ে তুলতে পারবো, যারা অশ্লীল পাকি-পতাকা নিয়ে অর্ধনগ্ন হয়ে 'খেলার নামে' পাকিস্তান পাকিস্তান জপবে না। যারা রাজাকারদের চিহ্নিত করতে পারবে - দলমত নির্বিশেষে। যারা বাংলাদেশের সঠিক জন্মেতিহাস জানবে। যারা এই দেশের নায়ক ও খলনায়কদের সত্য-পরিচয় জানবে। সেই দিন আসবেই।
রাশেদদের জন্যে রইলো অন্তরতর ভালোবাসা!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন