শনিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১১

গেরিলা দেখতে গিয়ে

নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত ছবি ‘গেরিলা’ মুক্তি পেলো ১৪ এপ্রিল, নববর্ষের দিন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর বানানো ছবি। গল্প নেয়া হয়েছে সৈয়দ শামসুল হকের উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ থেকে। চিত্রনাট্যে উপন্যাসের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধা পরিচালকের নিজস্ব অভিজ্ঞতা থেকেও গল্প নেয়া হয়েছে। মুক্তি পাওয়ার পরে আমার ছবিটা দেখতে যেতে একটু দেরি হলো। প্রথম সপ্তাহে পারলাম না, দ্বিতীয় সপ্তাহের মাঝামাঝিতে একদিন স্টার সিনেপ্লেক্সে গিয়ে টিকেট কাটলাম। এক সপ্তাহ আগেই ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ দেখেছি। পরপর অল্প ব্যবধানে দু’টা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছবি দেখা আমার জন্য আনন্দের ব্যাপার। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশে খুব বেশি ভালো মানের ছবি বানানো হয় নি। কারিগরি ও আর্থিক সীমাবদ্ধতা একটা বড়ো কারণ। বিষয় হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপ্তি আরেকটি বড়ো কারণ। এছাড়াও ছোটখাটো কিছু কারণ আছে। অন্যতম প্রধান কারণ আমার মতে মুক্তিযুদ্ধকে পরিবেশন করার ভঙ্গি। ছোটবেলা থেকে আমাদেরকে যে মুক্তিযুদ্ধ শেখানো হয়, যা আমরা বইপুস্তক থেকে শিখি, মিডিয়া দেখে জানি, এটা চরম বিরক্তিকর পরিবেশনা। ভাঙা রেকর্ডের মতো কিছু বুলি আওড়ে মুক্তিযুদ্ধকে বর্ণনা করা হয়। দিন-তারিখ, মৃতের সংখ্যা, পক্ষ-বিপক্ষ এগুলো নিরসভাবে বলে দেয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধের স্থিরচিত্রগুলো সে তুলনায় অনেক বাঙ্ময়। ছবিগুলো কেবল কথা বলে না, যেন চিৎকার করে। স্থিরচিত্রের একটা বড়ো অংশ নির্যাতিত বাঙালির ছবি। ২৫ মার্চের কালরাতের গণহত্যা থেকে শুরু করে ১৪ ডিসেম্বরের বুদ্ধিজীবী হত্যার ছবিগুলো বহুল প্রচারিত। বন্দুক কাঁধে মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি গুটিকতক দেখতে পাই, মিছিল-আন্দোলনের কিছু স্ন্যাপশট দেখতে পাই। কিন্তু সম্মুখ যুদ্ধের ছবি তোলার উপায় ছিলো না, কিংবা পাকিস্তানিদের ছবি, তাদের সরাসরি অত্যাচার করার ছবি বাস্তব কারণেই নেই। সরাসরি না দেখে, কেবল আফটার-ম্যাথ দেখে আমরা মুক্তিযুদ্ধকে জেনেছি। এবং শূন্যস্থানগুলোতে নিজ নিজ কল্পনার আশ্রয়ে বসিয়ে দিয়েছি পাকিস্তানি খুনী বা রাজাকার ধর্ষণকারীদের চেহারা। কর্মকাণ্ডগুলো হয়তো ভিনদেশি মুভি দেখে বসিয়েও নিতে পারি আমরা কেউ কেউ। কিন্তু মূল চিত্রের ধারে-কাছে যাওয়ার সম্ভাবনা তাতে কম।

মনে রাখতে হবে, এটা পৃথিবীর বৃহত্তম গণহত্যা ঘটা যুদ্ধ, গিনেজ বুকের হিসাবে , উনবিংশ শতকের প্রথম পাঁচটি গণহত্যার মধ্যে বাংলাদেশের গণহত্যা একটি। সময়ের হিসাবে মাত্র নয় মাসে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে। অংশ নিয়েছে পাকিস্তানের আর্মি, বাঙালি ও বিহারি সিভিলিয়ান রাজাকার। এই পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডের বিচ্ছিন্ন এবং তাৎপর্যহীন চিত্র সিনেমায় দেখেছি। আমাদের মধ্যবিত্তীয় ও গড়পড়তা মননে প্রশ্ন জাগে নি কেন এই হত্যাকাণ্ড। এতো বড়ো গণহত্যা এতো কম সময়ে করার পিছনে নিশ্চয়ই বড়ো কোন উদ্দীপনা ছিল! খুব স্বাভাবিক এই প্রশ্নের কারণ অনুসন্ধান ঘটে না মুক্তিযুদ্ধের গল্প-কবিতা-সিনেমা-তে। সেই কারণ অনুসন্ধান দেখতে পেলাম গেরিলায়। গোলাগুলি, মৃত্যু, রক্ত, সিনেমাটিক দৃশ্যাবলী ও সংলাপ, গান, সব কিছু ছাপিয়ে সিনেমা-শেষের পরে আমার প্রাপ্তি হলো এই প্রশ্নের উত্তর! একটু পরে বলছি এ নিয়ে বিস্তারিত।

মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে রাজনৈতিক পটভূমি জরুরি। একাত্তরের রাজনীতিতে, সমসাময়িক পাকিস্তানি দলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে সক্রিয় ছিলো জামায়াতে ইসলামী। এই দলের অবস্থান স্বভাবতই মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে। পাকিস্তান-রক্ষাকল্পে তারা দৃঢ় বলীয়ান। শেখ মুজিব একজন দুষ্কৃতিকারী, দেশে গণ্ডগোল লাগাতে চায়। মুজিবের চ্যালা-চামুণ্ডারা হলো নাশকতাবাদী। পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রকারী। তাই এদের রুখতে দলে দলে জামাতে ইসলামীতে যোগ দিন, রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিন। পাকিস্তান আর্মির হাত সবল করুন। এই সত্য-শ্লোগানগুলো এতোদিন সিনেমায় ঠারেঠুরে দেখানো হতো। যেন ভাশুরের নাম, সরাসরি মুখে নিতে নেই! নাসির উদ্দিন সেই পথে যান নি। ছবির প্রায় পুরোটা জুড়েই এরকম শ্লোগান লেখা ব্যানার চোখে পড়েছে। গলিতে গলিতে, স্টেশনে স্টেশনে,পাকিস্তানি ক্যাম্পে, স্কুল-কলেজের সামনেও এমন ব্যানার ঝুলতো। ঘরে ঘরে গিয়ে দাওয়াত দিতো শান্তি কমিটির চেয়ারম্যানরা, এলাকার প্রভাবশালীদের কাছে। এরা শান্তি কমিটিতে যোগ দিলে তাদের প্রভূত লাভ, গুপ্তচরবৃত্তিতে সুবিধা, লুঠতরাজেও সুবিধা। রাজাকার চরিত্রগুলো সর্বোচ্চ-সৎ অভিনয় দেখিয়েছেন। পরিচালকসহ এই সকল অভিনেতাকে ধন্যবাদ জানাই! অভিনয়ের দিক থেকে জয়া আহসানের অভিনয় সম্ভবত নিখুঁতের কাছাকাছি। এতোটা প্রাণবন্ত, এতোটা ‘ভিভিড’ অভিনয় আমি অনেকদিন দেখি না। বাংলাদেশের নায়িকাদের মধ্যে তো না-ই। যেখানে মেলোড্রামার অভিনয় আর ছলোছলো নির্যাতিত অবলা নারীর বাইরে বাংলা সিনেমার নায়িকাদের কিছু করার থাকে না এবং এটুকু মোটামুটি পারলেই আমরা বাহবা দিয়ে ভাসিয়ে দেই, সেখানে, সেই চর্চার জায়গায় জয়া আহসান একটা উল্লম্ফিত পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। সিনেমার আড়াই ঘন্টায় তার চরিত্রের যে প্রগ্রেশন, যেভাবে তার অনুভূতিগুলো বদলে বদলে যাচ্ছিলো, সেটা অভিনব। বিশেষ করে, ছবির শেষ আধাঘন্টার অভিনয় দেখার মতো, চমকে যাওয়ার মতো, পুরষ্কার দেয়ার মতো।

সিনেমা শেষ হয়ে যাওয়ার পরে কিছুদিন সময় লাগে আমার ধাতস্থ হতে। সিনেমার ক্ষমতা সম্বন্ধে আমি সততই খুব আশাবাদী, কারণ এই অডিও-ভিজুয়্যাল মিডিয়া আমাদেরকে এক অদ্ভুত বাস্তবতার জগতে নিয়ে যায়। বেশিরভাগ সময় তা কেবলই নিছক কল্পনা, কিংবা নৈর্ব্যক্তিক শিল্প। মাঝে মাঝে এই সিনেমার জগত কেবল কল্পনার বাস্তবতা বা শিল্পের পট ছেড়ে আমাদের বাস্তব জগতে ছড়িয়ে পড়ে। ফিরে আসি ওই প্রশ্নের কথায়। নাসির উদ্দীনের সিনেমা গেরিলা এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে। উত্তরটি সত্য ও সৎ উত্তর, একইসাথে প্রচণ্ড বাস্তব ঘনিষ্ঠও বটে। এতোটাই যে হতভম্ব ও বিস্মিত হয়ে গিয়েছি, ধাতস্থ হতে কিছুদিন সময় লেগেছে। আবছা আবছা ‘চেতনা’র ধারণা থেকে এক টানে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে গেছে অনেকগুলো ধোঁয়াশা। সিনেমা কতো শক্তিশালি হতে পারে, কতো গাঢ়ভাবে দার্শনিক হতে পারে, সেটার প্রমাণ পেলাম। প্রশ্নটি ছিলো, এই এতো অল্প সময়ে এতো ভয়ঙ্কর হত্যাকাণ্ড ঘটার কারণ কী? সাথে সম্পূরক প্রশ্ন হলো মুক্তিযুদ্ধের দার্শনিক, বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্দেশ্য কী ছিলো? এই দুটো প্রশ্নের উত্তরে অনেক মুক্তিযোদ্ধাও একটু থতমত খান। যুদ্ধ করার প্রকট উদ্দেশ্য (অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ইত্যাদি) এবং হত্যাকাণ্ডের প্রকট কারণ (বাঙালি-পাকিস্তান জাতিগত বিরোধ, লোভ ইত্যাদি) ছাপিয়ে প্রচ্ছন্ন ও গুরুত্বপূর্ণ কারণটি কারো চোখে পড়ে না। মুখেও সরে না। মুক্তিযুদ্ধে এতো বড়ো হত্যাকাণ্ড ঘটানোর সময় বারবার বলা হয়েছে এই “দুষ্কৃতিকারী”রা পাকিস্তানের শত্রু, ইসলামের শত্রু। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো ইসলামিক রাষ্ট্র ভাঙার পাঁয়তারা করছে। সাহায্য নিচ্ছে পার্শ্ববর্তী ভারত থেকে, হিন্দুদের থেকে। বাঙালি হিন্দুদেরকেও মারা হয়েছে, তা তিনি যতোবড়ো গুণী ব্যক্তিই হন না কেন, মেরে রায়েরবাজারে ফেলে রাখা হয়েছে। ধর্মের পরিচয়ে এতো বড়ো হত্যাযজ্ঞ আর ঘটে নি।

এই উত্তর শুনে অনেকেই মাথা নাড়ছেন। বিরোধিতা করতে চাইছেন। দোষ আপনার নয়। আমাদের পাঠ্যপুস্তক থেকে সামাজিক সকল প্রতিষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে গেলে এই উত্তরটি এড়িয়ে যান। মুসলিম মুসলিম ভাই বলে একটা কথা খুব ফোটে আমাদের মুখে, সেটা একাত্তরের বর্ণনায় গিয়ে উচ্চারিত হয় না। খালি পাকিস্তানের খেলা থাকলে শুনতে পাই শ্লোগানের মতো। বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ধর্ম-রাজনীতির আফিম খেয়ে খেয়ে এখন আমরা এটাই মানি, এটাই জানি। নাসির উদ্দীন ইউসুফ সেই জানা ও মানার তোয়াক্কা করেন নি, সরাসরি দেখিয়েছেন কীভাবে মানুষ কোরবানি দেয়া হয়েছে। গরু কোরবানির সময় যেমন আমরা গর্ত করি, মাঠে নিয়ে সেভাবে একের পর এক মুক্তিযোদ্ধাদের কোরবানি করা হয়েছে ইসলামের নামে। এই ইসলাম ‘প্রকৃত’ কী ‘স্খলিত’, ‘ঠিক’ কী ‘অন্যায়’ সেটা তখনও জরুরি ছিলো না, এখনও না। জরুরি হলো এই খুনিরা, তাদের খুনের বিচার। আমরা যদি এখনও এপোলোজেটিক হয়ে থাকি, ধর্ম-রাজনীতির ফাঁপা বুলিতে বিশ্বাস করে “ভাইয়ে ভাইয়ে ভুল করে মারামারি হয়ে গেছে” ভেবে “মরেই তো যাবে কয়েকদিন পরে” বলে এদেরকে ছেড়ে দেই, তাহলে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, বাংলাদেশ একদিন আবার পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠবে। ধর্মরাষ্ট্রের কুটিল ভোজালি এসে মানুষের গলা কাটবে। এগুলো কোন ‘ফিয়ার-পলিটিক্স’ না, এগুলো ‘এক তরফা দৃষ্টিভঙ্গি’ না। এই ভবিষ্যদ্বাণী অঙ্কের হিসাবের মতো সরল, অবশ্যম্ভাবী। যদি মানতে না চায় মন, গত মাসে আমিনীর হরতালের সময় বলা কথাগুলো স্মরণ করুন। “পানিবৎতরলং” হয়ে যাবে। নাসির উদ্দীন ইউসুফকে ধন্যবাদ। সৈয়দ শামসুল হককে ধন্যবাদ। কলাকুশলীদের ধন্যবাদ। গেরিলাকে ধন্যবাদ।

সিনেমা হল-এ আলো ফুটে উঠলে দেখলাম, আমার পাশে দুই বয়স্কা নারী শাড়ির আঁচল চাপা দিয়ে কাঁদছেন। চোখ মুছছেন। আমি তাদের দিকে একবার তাকিয়ে বেরিয়ে এলাম। আমারও চোখ ভেজা। নিঃশব্দে দুয়েকফোঁটা অশ্রু না হয় পড়ুক তাঁদের জন্যে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন