বুধবার, ১৮ আগস্ট, ২০২১

ক্যাটস অ্যান্ড ডগস



মঙ্গলবার সকাল থেকে বাংলাদেশের বর্ষাকাল পথ ভুলে চলে এসেছিল। আকাশ-ভরা থমথমে কালো মেঘ, আর নিরন্তর বৃষ্টি। কখনো একটু ধরে আসলেও পুরোপুরি থামে না। মাঠ-ঘাট থেকে রাস্তা-দালান সব ভিজে চুপচুপে। পানি ধোয়া গাছগুলো সবুজতম সবুজ - যেন চৌকস ভিজ্যুয়াল গ্রাফিক্সের অ্যানিমেটেড রঙ গুলিয়ে কেউ তাদের পাতায় পাতায় লেপে দিয়েছে। এমন দিনে গুটিশুটি মেরে বিছানায় পড়ে থাকতে ইচ্ছা করে। এদিনে কোথাও যেতে হবে না, জানালার ব্লাইন্ডগুলো খুলতে হবে না, জামায় চাদরে ঘুমের বাসি গন্ধ মেখে শুধু এপাশ-ওপাশ। কিন্তু এসব বিগত-বিলাস, এই জগতে তার স্থান নেই, এই মনে ওসব ইচ্ছা ঘুণাক্ষরেও উঁকি দেয় না। ঘর থেকে বেরিয়ে মহাসড়কে পৌঁছুতে পৌঁছুতে বৃষ্টির বেগ তীব্র হয়ে উঠলো। ওয়াইপার ব্লেড কর্মতৎপর; সর্বশক্তিতে এপাশ-ওপাশ করেও উইন্ডশিল্ডে আছড়ে পড়া বৃষ্টির বিন্দুগুলোকে সরিয়ে সারতে পারছে না। কড়কড় শব্দে বাজ পড়লো বোধহয় দূরে কোথাও। সেসবে ভ্রূক্ষেপ নেই আমাদের কারোরই, গাড়িগুলো সারি বেঁধে ছুটছে অন্ধ বাইসনের মতন, একটার পেছনে আরেকটা। প্রবল বৃষ্টি আর দমকা হাওয়া মিলে মনে হলো চারপাশে কেউ যেন শাদা চাদর টেনে দিয়েছে। সেই চাদর ফুঁড়ে জায়গায় জায়গায় লাল টেইল-লাইট বেরিয়ে এসে পথ দেখাচ্ছে। এসময় মহাসড়কের ওপর জমে থাকা পানি আর তেলে মিলে এক পিচ্ছিল মসৃণ পথ তৈরি করে ফেলে। কোথায় যেন শুনেছিলাম এর ব্যাখ্যাটা - গাড়ি থেকে একটু একটু করে চুঁইয়ে পড়া তেল রাস্তায় পড়ে রোদে শুকিয়ে থাকে। এমন বৃষ্টিতে সেই তেল পানি পেয়ে চাঙ্গা হয়ে ওঠে। কিন্তু তেল আর পানি তো আর মিশবে না, তাই পানি চলে যায় রাস্তার পিচের কাছাকাছি আর ওপরে ভেসে ওঠে তেল। এজন্যই গাড়ির চাকা পিছলে পিছলে যেতে থাকে। ব্যাখ্যাটা সত্যি নাকি মিথ্যা জানি না, কিন্তু এই প্রবল বর্ষণের সকালে লেইন বদলাতে গিয়ে টের পাই যে ব্যাখ্যা সঠিক। ছোটবেলায় খুব উঁচু কোনো স্লাইড থেকে পিছলে পড়ার মুহূর্তের ক্ষণিক ভরহীনতার স্মৃতি ফিরে আসে। স্টিয়ারিংয়ে হাতের আঙুল শক্ত হয়ে চেপে বসে। ভ্রূ কুঁচকে যায়, চোখের দৃষ্টি যেন সেই সামনের টেইল-লাইটের সাথে সাঁট করে আঠার মতো আটকে থাকে। জগতের সকল বস্তুই শক্তির নিম্নতম স্তরে থাকতে পছন্দ করে, তাই গাড়ির চাকার ঘূর্ণনশক্তির সাথে রাস্তার তেল-পানির সংলগ্নতার দ্বিপাক্ষীয় চুক্তি সম্পন্ন হয়। ধীরে ধীরে হাতের আঙুলও নিশ্চিন্ত হয়। দুর্ঘটনার গহ্বরের সীমানা দেখে ফিরে এসে মস্তিষ্কের কোষে কোষে অ্যাড্রিনালিনের জোয়ার বইতে থাকে। এই প্রবল বর্ষণকেও তখন সুন্দর মনে হয় - তীব্রবেগে আছড়ে পড়া পানির ফোঁটা সুন্দর, ওয়াইপারের ঘটঘট আসা-যাওয়া সুন্দর, গাড়ির ভেতরে ঈষদুষ্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাতাসের ঘ্রাণ সুন্দর, এমনকি চারপাশ শাদা করে দেয়ার অন্যতম কৃতিত্বের অধিকারী যে সামনের গাড়িটি, তার পানি-ছিটানো চাকাগুলোও ভীষণ সুন্দর। ভালো লাগতে থাকে পরিচিত এক্সিটের সাইনবোর্ড - এই তো, প্রায় এসে গেছি। আর মাত্র চার মিনিট। গ্যারেজ থেকে একটু ধরে আসা বৃষ্টিতে ছাতা ধরে গা বাঁচিয়ে সোজা দালানে ঢুকে পড়া। নিজের ডেস্কে গিয়ে জানালার পর্দা সরিয়ে দেই। কিছুটা সবুজ, কিছুটা সামনের লাল ইটের দালানের দেয়াল, আর কিছুটা কালচে ঘোলাটে মেঘ নিয়ে একটা বৈসাদৃশ্যময় কম্পোজিশন। বড্ড বেমানান। বড্ড খাপছাড়া। এখানেও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সুবাতাস। কিন্তু আমার দম আটকে আসে। মনে হয় নাকে-মুখে কেউ নল ঢুকিয়ে দিয়েছে। শ্বাস নিতে গেলে নলের প্লাস্টিকের ঘষা অনুভব করছি যেন। ঘরের আলোও পর্যাপ্ত, চারপাশে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। কিন্তু এই আলোকিত ঘরের চেয়েও শাদা চাদরে ঢেকে যাওয়া মহাসড়কের প্রাণপ্রাচুর্য আর গতিময়তাকে বেশি আকর্ষণীয় মনে হতে থাকে। এই নিস্তরঙ্গ শান্তিময় জীবন বা জীবনের ভাগ তো চাই-ই নি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন