শুক্রবার, ২০ আগস্ট, ২০২১

স্লো রাইড

অনেক আগে একবার এক নাম-না-জানা পথে পথ হারিয়ে ফেলেছিলাম। বিকেল পড়ে আসছিল দ্রুত। গন্তব্যে ফেরার তাড়া কাজ করছিল কিন্তু যার সাথে এসেছিলাম তাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। ভাবছিলাম সে হয়তো অন্য কোনো পথে চলে গেছে। চারপাশে ত্রস্ত দু'চোখে তাকে খুঁজছিলাম, কোনো এক পথের ফাঁকে বা বাঁকে তাকে দেখা যাবে এই আশায়। এভাবে দিগভ্রান্ত ঘোরাঘুরির এক পর্যায়ে দেখলাম এক লোক রাস্তার পাশে উবু হয়ে বসে হাপুস নয়নে কাঁদছে। সে যেখানে বসে আছে সেটা একটা তিন-মাথার মুখ - তিন দিক থেকে তিনটা রাস্তা এসে মিলেছে। আর লোকটা বসে ছিল তিন পথের দিকে পিঠ দিয়ে চতুর্থ দিকে মুখ করে। সেদিকে কোনো পথ নেই, শুধু রাস্তার ঢাল খাড়া নেমে গেছে অনেক গভীরে। অনেক দূরে দেখা যাচ্ছিল অমনই আরেক তে-মাথা জাংশন। সেইখানে বসে ছিল আরো একজন। আলো কমে আসায় তার মুখাবয়ব ঠিক ঠাহর করা যাচ্ছিল না। শুধু বোঝা যাচ্ছিল এই লোকের মতনই সে বসে আছে, ঠিক যেন আয়নার প্রতিবিম্ব। সে কি নারী নাকি পুরুষ সেটাও বুঝতে পারছিলাম না। শুধু দূর থেকে ভেসে আসছিল তার একটানা নাকি কান্নার অস্পষ্ট শব্দের ঢেউ। দেখতে দেখতে আমার দেখাদেখি পাশে আরো গুটিকয়েকজন জড়ো হয়ে গেল। একজন বলাবলি করছিল, দ্যাখেন পাগলের অবস্থা। চাল নাই চুলা নাই, ভর-বিকালে বইসা বইসা কানতেছে। কীসের জন্য কানতেছে কে জানে?! 

আরেকজন শুনে বলে উঠল, কানতেছে ওই যে, ওই পাগলটার জন্য। এই দুইটারে এক করে দেয়া গেলে ভাল হইতো। দুই পাগলে মিলেমিশেই থাকতো। 

এ'কথা শুনে প্রথম জন আবার বলল, কিয়ের মিলমিশ? দেখা হইলে এই দুইটা নখ দিয়ে আঁচড়ায়া মাইরা কাইটা শেষ কইরা দেয়। ভালোই হইছে দুইটারে দুই জায়গায় সরায় দেয়া হইছে। 


পাতলা চাদরের মতন ভিড়টা কিছুক্ষণ পর পাতলা হতে শুরু করে। সেই চাদর ফুঁড়ে একজন আমার কাছাকাছি এসে দাঁড়ায়। হয়তো আমার জিজ্ঞাসু চোখ দেখে তার কিছু বলতে ইচ্ছা করেছে। সে বললো, আসলে যা শুনলেন অমন কিছু না। এইখানে একটা মেঠো রাস্তা ছিল। যখন ইটের ভাঁটায় কাঁচামাল দরকার হলো তখন সেই রাস্তাটা উঠিয়ে ফেলা হল। দুই অংশের মধ্যে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। যোগাযোগ বন্ধ, মানে কথা বলা, একে অপরের বাসায় যাওয়া, আনন্দ-বিষাদ সব প্রতিবেশির সঙ্গে ভাগ করে নেয়া - এসবই এক নিমিষে খতম। হয়তো পাগলটা, থুক্কু, স্যরি ভুল বলেছি, হয়তো মানুষটা এই বিচ্ছেদ মেনে নিতে পারে নি। 


এই লোকটার ব্যাখ্যা শুনে কিছুটা উত্তর পেলাম আর বাকিটা নিজে নিজে বানিয়ে নিলাম। তে-মাথায় বসা একাকী অপ্রকৃতস্থ লোকটা হয়তো আমাদের চেয়ে বেশি ভারসাম্য-পূর্ণ। দুই অঞ্চলের মধ্যে এই অকস্মাৎ বিচ্ছেদ সে মেনে নিতেই পারে নি। দূরে বসে বসে আবছা হয়ে আসা মানুষটার দিকেও তাকালাম। যোগাযোগ-হীনতায় পীড়নে-যন্ত্রণায় দু'জনই কাঁপছে। কিন্তু মুখে কিছু শব্দ করা ছাড়া তাদের কোনো ভাষা নেই। ঠিকমত খেয়াল করলেও মনে হয় এসব শব্দের কোনো অর্থ হয় না। দুই বিন্দুর মাঝে ক্ষুদ্রতম দূরত্ব একটি সরলরেখা। সেই রেখার দুই প্রান্তে বসে দু'জন - যাদের মুখে কথা নেই - শুধু অস্পষ্ট কান্না, প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে না পারার ব্যর্থতা। তারা কি এই বিচ্ছেদের জন্য কাঁদছে? নাকি এই যে মাঝখান থেকে ব্রিজটা তুলে নিয়ে গেল, সেই ব্রিজের তিরোধানের শোক পালন করছে? লোকটির যন্ত্রণাক্লিষ্ট, অশ্রু-ভেজা ভেঙেচুরে আসতে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হলো, কেন কাঁদছে সেটা জরুরি না একেবারেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন