সোমবার, ২ মার্চ, ২০০৯

স্কুল ভ্যান, শোকমোচনের অপর পাতা

প্রতিদিন আমার যাত্রাপথের সময়টুকু আমি খুব অনুভব করি।


কিছুদিন আগেও ঝাঁ ঝাঁ রোদ ছিল না, বেশ মোলায়েম একটা বাতাস থাকতো, অনেক সময় আকাশ ঘন ধূসর হয়ে থাকতো আর সাথে একটা শীতল বাতাসও বইতো, আমার খুব ভাল লাগতো। এখন সেরকম নাই, শুষ্ক বাতাস ডাইনির মতো উড়ে বেড়ায়, সাথে চড়চড়ে রোদ! চামড়া পুড়িয়ে রোদের ঝাঁজ মাংশে গেঁথে যায় বলে আমি শিহরিত হই, যদিও এমন শিহরণে ক্রমশ মজে থাকা যায় না! নেশা ছুটে যাবার মত জেগেও উঠি।

তারপরে একটা সময়ে আমি হাঁটতে শুরু করি। আমার চলার পথে দুটো স্কুল পড়ে। সেখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের স্কুল শেষ হয়, একদম দশটা এগারোটার দিকেই। হয়তো তাদের কাছে দিনের ক্লান্তি তখনও ধরা দেয়নি, তাই রেলিং দেয়া ফুটপাতে তাদের ছোটাছুটি থামে না! আমার ভাল লাগতে থাকে, ধীরে ধীরে আমি ক্ষতহীন, শোকহীন হয়ে উঠতে থাকি।



এখানে সেই রোদে আমার কেবলই তাদের মতো হয়ে যেতে মন আঁকুপাঁকু করে। এখন জীবনের হিসেবগুলো বদলে গেছে, জটিল হয়ে গেছে সরল অঙ্ক। এখন আমাকেও কথা বলার আগে দু'বার ভাবতে হয়, যাকে বলছি, যে শুনছে সে কীভাবে নিতে পারে। আমার কথার ভিত্তিতে আমাকে সে যাচাই করবে যেহেতু আমাকে সে পুরোটা চেনেনা। এই জীবন এতো গতিময় হয়েছে আর আমরা গতির ঘূর্ণনে ক্রমশই অপরিচিত হয়ে উঠছি একে অপরের কাছে। এখন ক্ষণিকেই আমরা মিলিত হই, সহবাসেও সম্ভবত ক্ষণিক-পুলকই সার! আমরা বিজ্ঞাপন পছন্দ করি, রোজ রোজ ২০ মিনিটের ডেলি-সোপ চুষে চুষে খাই। খবরের মাঝেও বিরতি দেখি। তিন ঘন্টা মুভি এখন বিরক্তিকর একঘেয়েঁমি।
তাই আমার ওদের মতো হতে ইচ্ছা করে। ওরা নিশ্চয়ই এখনও দীর্ঘ দিন কাটায়! একটু এগুতেই দেখি দু'জনে মিলে একটা ফাঁকা স্কুলভ্যান ঠেলছেন। সামনের জন বালক, পেছনের জন বালিকা। ক্লাশ ওয়ান, কি টু। কী একাগ্রতায়, নিবিষ্ট আগ্রহে ঠেলা ঠেলি চলছে, কোথায় নেবেন তারা স্কুল ভ্যানটিকে? চালক নাই, এই ফাঁকে 'চল, ঐটা ঠেলি!' বলে হয়তো দু'জনে জুটে গেছেন। যূথবদ্ধ খেলায় হয়তো তারা মজা পাচ্ছেন না আজ। বালিকাটিও বেণি সরলদোলকের মত দুলিয়ে পিছু নিয়েছেন। আমার মনের ভেতর কোমল হয়ে গেল...



কিন্তু আর সকল চলমানতার সূত্রানুযায়ী, আমি একটু পরেই স্কুলভ্যান ঠেলক-ঠেলিকাদ্বয়ের দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে এলাম। সামনের রেলক্রসিংয়ে আটকে আছি। ঘট ঘট করে দানবীয় ট্রেন যাচ্ছে। সাথে চারকোণা ফ্রেমে মুখেদের আটকে নিয়ে চলে যাচ্ছে দূরে। আমি দেখতেই ভাবি, অনেকদিন ট্রেনে চড়ি না! কতদিন? বুঝতে পারলাম যে আমিই হয়তো ট্রেনের কাছ থেকে দূরে সরে গেছি। ও তো আগের মতোই একই রেলের ওপর দিয়ে দিন রাত দৌড়ে চলছে। আমিই খালি তার চলপথের আড়াআড়ি যেতে চাই, সমান্তরালে নয়!


একটা পর্যায়ে গুলশান চলে আসে। আমার কাছে গুলশানের ফুটপাত খুবই উদ্ভিন্ন যৌবনা মনে হয়। আমি তখন ধীরে ধীরে রেলিং দেয়া সেই শিশুসমারোহী ফুটপাত ভুলে যেতে থাকি। কিংবা হয়তো তারা আমার সাথেই চলে এসেছে, শার্টে, জামায়, হাতায় অণু-পরমাণু হয়ে মিশে মিশে? কেননা অফিসে বসেও আমি ভুলি না। ক্লাশ নিতে নিতেও আমি ভুলি না। সহকর্মীর সাথে লাঞ্চ করতে করতেও ভুলি না। আমার করোটির মাঝে স্কুলভ্যানের চাকার মন্থর ঘূর্ণন জমে পাথর হয়ে থাকে!
***

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন