শনিবার, ২১ মার্চ, ২০০৯

ভোরের একটু আগে


রাত শেষ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। আকাশের দিকে তাকালে এখনও সময়টা আন্দাজ করা যায় না। আমি উঠে পড়ি। এপাশ ওপাশ অনেকক্ষণ তো হলো! বিছানাবালিশ ধীরে ধীরে উষ্ণ মনে হচ্ছে। আর কতোক্ষণ এভাবে গড়াগড়ি করা যায়?
আমি উঠে পড়ি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি কিছু পরিষ্কার হয় না। তাও কী মনে করে তাকিয়েই থাকলাম। হালকা কুঁজো হয়ে বসলাম। আমি সবসময় এভাবে বসি। ছোটবেলায় নানী রেগে যেত, বলতো "পিঠ সোজা কইরা বয়। ব্যাঁকা হইয়া যাইবো জন্মের লাহান।"
আমার নানী একেবারেই অল্পশিক্ষিতা। মনে হয় তাঁর ছোটবেলার বড়োবোন বা গুরুজন শিখিয়ে দিয়েছিল, পিঠ বাঁকা করে বসলে ওরকমই হয়ে যায়। ভীতু মনে সেটা নিশ্চয়ই গেঁথে গেছে! তাঁর ধমকে আমি তখন তড়িঘড়ি পিঠ সোজা করে বসতাম।
কিন্তু এখন তো আর আমাকে কেউ দেখছে না। তাই আমি জবুথবু হয়েই বসে থাকি। এভাবে থাকতে আমার ভাল লাগে। বৃদ্ধবয়সের অনুশীলন করছি বলে মনে হয়।
পাখিরা ঝাপ-ঝাপ করে উড়তে শুরু করেছে। আকাশ ফর্শা হওয়ার আগেই ওরা উঠে যায়। রাত যে তাড়াতাড়ি এসেছিল ওদের ঘরে, সন্ধ্যে নামতেই। আমি সন্ধ্যের পরে ওদের দেখি নাই। খড়বুননের পেলব সংসার! নিশ্চয়ই অতোটুকুন জায়গার মধ্যে তিন-চারটা জীবন। এখন পাখা ঝাপটে রাতঘুম ভেঙে উঠে পড়ছে। অথচ আমি কেন ঘুমাতেই পারলাম না! ওরা তো এখন হাই তুলবে, পাখা টানটান করে আড়মোড়া ভাঙবে। তারপরে উড়তে বেরুলেই আমাকে দেখে অবাক হবে।
মানুষ-ছানা কেন লাল চোখে, ধনুকের মতো বাঁকা হয়ে বসে আছে! ওরা তো সারাক্ষণ কথা বলে। হৈহুল্লোড় করে। শব্দ করে গান শোনে।এখন কেন এমন নির্বাক, চুপচাপ? নিশ্চয়ই এসব ভেবে মাথা নেড়ে ওরা চলে যাবে উড়ে। ওদের তো সময় নেই আমার মতো।


“কালকে কয়েকটা চিঠি সকালেই পাঠাতে হবে বাইরে।”
“ক্লায়েন্ট আসবে, অথবা ফোন করবে, কবে আসতে পারে সেকথা জানাতে। টেকনিক্যাল টীমগুলো খুবই চামারের মতোন। এসেই নাক শুঁকতে থাকবে।”
“বসের গত পরশু থেকে মন মেজাজ দেখছি চড়া, কালকে আমার উপরে না ঝাড়লেই হয়।”
এইরকম নানাবিধ চিন্তাগুলো পাখির পাখা ঝাপ্টার সাথে মাথায় ঢুকে পড়ে। কিন্তু এগুলো আমি ভাবতেই চাই না। সারাদিনই তো এসব নিয়ে থাকি। আজকে ফেরার পথেও তো এসব ভাবছিলাম। প্রতিদিনই ভাবি। মানুষ কেমন প্রাণী! একটা সময়ে, যখন শিশুর মতো ভাবতাম, তখন সারাদিনের চিন্তাগুলো কতোই না অন্যরকম ছিল।


“আজকে কি আম্মা আইসক্রিম কিনে দিবে?” (পলিথিনের লাঠির ভেতরে কমলা রঙের আইসক্রিম পাওয়া যেত। ওটা খেলেই মুখে ঠাণ্ডা লাগতো! আর ঠোঁট-জিহ্বা সব লা…ল হয়ে যেতো!) “দিবে তো?”
“কালকেই আমার রাবারটা ফেরৎ নিতে হবে নাজমুলের কাছ থেকে। ওর ভাবভঙ্গি সুবিধার না। নিয়ে নিলে আমি অতো সুন্দর রাবার কোথায় পাব?”
“ইস! খেয়াল করি নাই। জুতাটা ময়লা হয়ে গেল! এখন? আম্মা তো চেইতা ফায়ার হয়ে যাবে। কী বিপদ!!”
এরকম নিরন্তর-দুশ্চিন্তাগুলো কেন হারিয়ে গেল? কবে এভাবে ভাবা বন্ধ করেছি মনে নাই। কোন নোটিশ এসেছিল কি? "অদ্য রবিবার হইতে এই সকল অনুৎপাদনশীল বিচ্ছিন্ন চিন্তাক্রিয়া রদ করিতে নির্দেশ দেয়া হইলো। আদেশক্রমে, কর্তৃপক্ষ।"
কই, আসে নাই তো এমন কিছু। তাহলে আমি কেন এভাবে সব বদলে ফেলেছি? এখন সেগুলো চিন্তা করে হঠাৎ বিষাদ কামড়ে ধরলো। ঘুনঘুনে কাশির মতো দলা দলা দুঃখ বুকের মধ্যিখানে জমে রইলো।
আমি আজকাল কেবলই অফিসের কথা ভাবি। বাবা-মা'র কথা ভাবি, বুড়ো হয়ে গেছেন ওঁরা। মাঝে মাঝেই অসুখ-বিসুখ। বয়স হলে মানুষ একটু ঘ্যানঘ্যান করা শুরু করে। খুব ক্লান্ত থাকলে আমিও হয়তো কটু কথা বলে ফেলি আর একটু পরেই সেজন্যে খারাপ লাগে। তাঁরা তো কিছু বলেন না, অভিমান চেপে রাখার একটা সিন্দুক আছে ওঁদের দু'জনেরই...
আমার বন্ধুগুলোকেও দেখি সবাই ব্যস্ত। চাকরি, সংসার, ছেলে-মেয়ের স্কুল আর বেতন, চাল-ডালের দাম, সরকার, ট্যাক্স, ফ্ল্যাট-লোন এসবেরই চিন্তা করে সারাদিন। কেউ কেউ আরেকটু সময় পেলে ব্যক্তিগত হয়। “মাথার চুল পড়ে যাচ্ছে, রাতে ঘুম হয় না” ( শুনে আমি তাকে আপন ভাবি, আমার মতোই তো!)। কেউ কেউ “অফিসের সহকর্মীর সাথে...” “বাসায় বনিবনা নাই। ছোট ছেলেটা...” বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে থেমে থেমে। আমি বুঝি, আর দেখি ওদের শার্টে, কামিজে লেগে থাকা শৈশবের সব রঙ, ঝিমধরা দুপুরের ফেরিওয়ালারা নিরাশ হয়ে নিরুদ্দেশ হয়।
আমিও কি ওদের মতোই হয়ে গেছি না কিছুটা? এই জীবনটা, এভাবেই পেরিয়ে যাচ্ছি সব সেকেন্ড-মিনিট-দিন-সপ্তাহ। সারাদিনের একটাই কার্যকর চিন্তা, তা হলো অফিসের কাজগুলো ঠিকঠাক করছি কী না। এমনকি এই ফর্শা হয়ে ওঠা ভোরের কাছাকাছি সময়েও আমি তাই ভাবছিলাম! এখনও?
পাশে হঠাৎ নড়াচড়া শুরু হয়। কাঁথার নিচে পরিচিত শরীর নড়ে। পা দুটো বুঝতে পারি। এমনকি চওড়া পিঠের আদলটাও স্পষ্ট। ক্রমশ ঝটপটানো। পাখির পাখার চেয়েও দ্রুত। ছোটবেলায় একটা খোঁড়া পাখি ধরেছিলাম দু'হাতের মাঝে। সেই ধুকপুকানির মতো বিছানা দুলে ওঠে! কী হচ্ছে! কী ঘটছে! প্রবল আশঙ্কায় আমি আমূল কেঁপে উঠি।
আমি বিছানা থেকে সরে গিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি। মনে হচ্ছে ধপ করে পড়ে গেলাম। পায়ের মাঝে একেবারেই সাড় নাই। দ্রুত ভাবার চেষ্টা করি, হয়তো অনেকক্ষণ বসে থেকে ঝিঁঝিঁ ধরে গেছে। এখনই আবার এটাও টের পাই যে আমার পুরো শরীরেই আর কোন ভারবোধ নাই। একটু আগেও যে কুঁজো হয়ে বসে ছিলাম, সেই ওজনটা টের পাই না আর। ফর্শা চাদরের নিচে শরীরটা ততক্ষণে নিথর। বাইরের আকাশটাও চাদরের মতোই... ফর্শা ধাঁধানো রঙ নিচ্ছে। জানালার সামনে তারজালি। মাঝখানে কাঁচ। তার বাইরে গরাদ। ওপাশে দূরে, অনেক দূরে, আকাশের শেষমাথায় নিঃশব্দ দুদ্দাড়ে কমলা ভোর আসছে। ঠিক স্কুলের বাইরের সেই আইসক্রীমের মতোন। আমি ভরহীন হয়ে আশৈশব আকাঙ্ক্ষার কমলা আইসক্রীমের দিকে তাকিয়েই থাকি!




***

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন