মঙ্গলবার, ৭ জুলাই, ২০০৯

মুরতাজা বিষয়ক সিদ্ধান্ত

সন্ধ্যা নেমে আসার একটু আগে থেকেই, মুরতাজা বার বার পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল বের করে আনার অনুশীলন করতে থাকে। ডান হাতের সয়ংক্রিয় চলনে, পকেটের দু’পাশের দুই লাইন সেলাই ঘষা খায়, সেখানে হাতের অদৃশ্য ধুলো আর ঘাম মিশে মিশে কালচে-খয়েরি দাগ পড়তে থাকে। মুরতাজার সেদিকে খেয়াল থাকে না, বলাই বাহুল্য। পকেটে হাত দিয়ে মোবাইলের ধাতব শরীর স্পর্শ করে, কিছুটা উল্টে পাল্টে দেখে হাত বের করে আনে সে। এই অস্বাভাবিক মুদ্রাদোষের কারণ আমাদের অজানা, পুরনো কোন ঘটনা, অভিজ্ঞতা বা স্মৃতি হতে পারে; ঠিক সন্ধ্যার আগে আগে এমন অস্থিরতা কী করে তার যাপনবিদ্যায় ঢুকে গেছে, সেটা জানার কৌতূহলটাকে আমি ভক্‌ করে উঠে আসা বমির প্রথম ঢেউয়ের মতই চাপার চেষ্টা করি। মুরতাজা এবং তার মোবাইলের মাঝে মিলন ঘটে না- অন্তত প্রকাশ্যে, পকেটের বাইরে নয়; অবশ্যই। সে বিষয়ে এমন নিশ্চিত হতে পারা যায়, আমার জবান সেখানে নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য, কারণ আমি মুরতাজার কাছে বিকেলে আসি। তারপরে বসে থাকি তার পাশে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত অবধি। এ’সময়ের অস্থির পাখির মতই ঘরে ফেরার তাড়া কি সে বোধ করে? আমি জানি না।


ঘরে ফেরার তাড়ার সাথে আমি অপরিচিত। কথাটা ঠিক হলো না। যার ঘর আছে, সেই ব্যক্তিমাত্রই ঘরে ফিরে যাবার জন্য সদা উৎসুক, উন্মুখ। আমার জন্যে তার ব্যতিক্রম হবে কেন? অথবা মুরতাজার জন্যে? মুরতাজার ঘর কোথায় তাও আমার জানা নেই। কোন ক্রিয়ার আগ্রহের মাত্রা একটা সীমার বাইরে না গেলে, আমরা সাধারণত সেটা ঘটাই না। এই নিয়ম শুনে শুনে আমি প্রতিদিনই, নিজের কৌতূহল নিবৃত করি। মুরতাজাকে আমার প্রশ্ন করা হয় না, তার সাথে ব্যক্তিগত হয়ে ওঠা হয় না। প্রশ্নগুলো গভীর পানিতে জন্মানো বুদবুদের মত উঠে আসতে চায়। তবে সেই ক্রিয়াশীলতার সূত্রের জলজ আগাছায় আটকে যায় বলে, আমার প্রশ্ন করা হয় না। মুরতাজার ডান হাত, আমার না-করে-ফেলা প্রশ্ন সম্বন্ধে পুরোপুরি অজ্ঞাত থেকেই নিষ্পাপ ভঙ্গিতে, পকেটের বুঁজে থাকা দুই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দ্রুত চলাচল করে।


জায়গা’টা ডাক্তারের চেম্বার। ডা. সুলায়মান শিকদার (কতিপয় ডিগ্রি, লণ্ডন, সাইপ্রাস ইত্যাদি) এখানে বিকেল চারটা থেকে রাত নয়টা অবধি বসেন। তার বিশেষত্ব তিনি নাক, কান ও গলার ডাক্তার, বৈশিষ্ট্য তিনি একজন সময়হীন চামার। আমি তার মুখ-বাঁধা ড্রাইভার। বিকেলে তার কিশোর ছেলেটিকে কোচিং থেকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে, আমি ধানমণ্ডির আটে এসে বসে থাকি। গাড়ির ভিতরের ক্রমোষ্ণ গুমোট ছেড়ে আমি চেম্বারের লবিতে সময়টুকু কাটাই। ছ’টা থেকে ন’টা। সন্ধ্যা থেকে রাত। তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে, আমি হেঁটে হেঁটে ঘরে ফিরি। ঘর। ঘরে অনেকেই আমার অপেক্ষায় থাকে বা থাকে না। সেটাও তেমন জরুরি না, যেমন জরুরি না মুরতাজা বা সুলায়মান শিকদারের ঘরেও কেউ কেউ অপেক্ষায় থাকে সেই বিষয়টা। সকলের ঘরেই কেউ না কেউ অপেক্ষা করে, এবং সেটা মোটেই আমাদের মনোযোগের বিষয় হতে পারে না। আমি তাই চোখ কুঁচকে মুরতাজার দিকে তাকিয়ে থাকি।


মুরতাজা এই চেম্বারের কম্পাউণ্ডার। ডাক্তারের চেম্বারের দরজার বাইরে তার ডিসপেন্সারি। রোগকাতর, কান-নাক-গলাজুড়ে কীটের অত্যাচারে যারা নাজেহাল, সোলায়মানের কাছে ভিজিট দিয়ে ও পথ্য নিয়ে যারা খানিক নিঃস্ব, তাদেরকে নিঃস্বতর করতেই মুরতাজা বসে থাকে। গুনে গুনে পাতার পর পাতা ওষুধ দিয়ে সে টাকাগুলো গুছিয়ে রাখে। আমি সেটা খেয়াল করে দেখি। রোগী চলে গেলেও আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি অস্বস্তিদায়ক স্বস্তিতে। চেম্বারের দেয়ালে, তেমন কোন আকর্ষণীয় ছবি, পোস্টার, ক্যালেন্ডার নেই। অথবা প্রথম আসার পরে হয়ত সেগুলোকে আকর্ষণীয়ই লাগে, আমি রোজ রোজ চোখের জিহ্বায় চেটে চেটে সেগুলোকে ছিবড়ে করে ফেলেছি। আমার কাছে সেগুলো এখন বিবর্ণ ও পুরাতন। তাই ঘুরে ফিরে আমি মুরতাজার দিকেই তাকিয়ে থাকি। রোগী হিসেবে কোন যুবতী এলে আমার মনোযোগ তাদের দিকে যায়। তারা চলে গেলে পুরনো মুরতাজা, এবং সন্ধ্যার আগে আগে, তার ডান হাতের ক্রিয়াকলাপ আমাকে বেশ কৌতূহলী করে তোলে।


মাঝে মাঝে তার এবং আমার মাঝে তরল থেকে কঠিন হতে থাকা নীরবতা ও বাক্যহীনতা কাটিয়ে আমরা অর্থহীন শব্দ উচ্চারণ করি। সেগুলো না বললেও চলে, শামুকের মত পড়ে থাকতে আমার সমস্যা নেই, ড্রাইভারির অবশ্য-পালনীয় অভ্যাস। তবে মুরতাজার হয়তো ভালো লাগে না, তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে কথা চালাচালি শুরু করে। শুরুতে ঠুক-ঠাক, ভাববাচ্যেঃ


“কি খবর?”
–”এই তো, চলে।”
“কেমন চলে?”
–”আ-র চলা! যাইতেছে একরকম।”
“আছো সুখে”
মুরতাজা আপন হতে চায়; অথবা মুরতাজা প্রভুসুলভ মুরুব্বি হতে চায়। কোনটা সেটা নিয়ে আমার দ্বিধা কাটে না। তাই আমি আবার নীরব হই। একটু ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকি। ‘কেমন চলে’- এই প্রশ্নে আমার গতিসম্পর্কীয় উল্লেখ মুরতাজার বোঝা উচিত ছিল। অথচ তার পরপরই ‘আমি সুখে আছি’- এই সিদ্ধান্তে সে কী করে গেল সেটাই বিস্ময়ের। আমি যে সুখে নাই সেটা প্রমাণ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। বা, মুরতাজা ভাবছে আমি সুখে আছি আর সেটা ভেবে ভেবে ওর খারাপ লাগছে, ও দুঃখ পাচ্ছে, এই চিন্তাটা আমাকে খুশি করে দেয়। তুমি সম্বোধনে নেমে আসার, আপন হবার বা মুরুব্বি বনে যাবার প্রচেষ্টায় ‘মুরতাজার উপরে শোধ নেয়া গেছে’, এই খুশিভাবকে কি সুখ বলা যায়? আমি মুরতাজার কাছে কৃতজ্ঞবোধ করি।


“কী গরম পড়ছে দেখছ!”
– “হ”
“কয়দিন বৃষ্টি হইল, এখন আবার গরম। কী যে হইতেছে বুজতেছি না। বিরাট গ্যাঞ্জাম!”
– “আপনার মুবাইল বাজে?”


আমার কথাটা নির্ভেজাল প্রশ্ন ছিল। বুদবুদগুলো কোন এক ফাঁকে সট্‌কে পড়েছে। তাদের মধ্যে একটা সব আগাছা পাড়ি দিয়ে উপরে এসে ঠাশ করে ফেটেছে। সে শব্দ, আমাদের অর্থহীন কথোপকথনের মাঝে অতিকায় ঝুলন্ত সেতু হয়ে ঝুলতে থাকে। মুরতাজা ইতস্তত কেঁপে ওঠে। সে সম্ভবত এখনও শহরে খাপ খায়নি। আমি ওর মুখে সাঁকোর কাঁপন দেখি, লম্বা বাঁশের গোড়ার পানির মতই ঢেউ মুরতাজার চেহারায় ভুস ভুস ভেসে ওঠে।


– “কি। বাজতেছে নাকি?”
এবারে আমি একটু সরব হই, সপ্রতিভ হই। কৌতূহলী বিড়ালের বাড় বেড়ে গছে। মুরতাজার নীরবতা আমাকে উৎসুক করে। গুজব। গল্প। পাতা উল্টানোর মত মানুষের জীবন। গন্ধ। আমি প্লাস্টিকের কষ্টকর চেয়ারে সোজা হয়ে বসি; বিড়ালের মতোই, সতর্ক। মুরতাজা ঘাম মোছে; সাঁকো স্থির হয়।


“না, মুবাইল বাজে না। এমনেই দেখতেছিলাম।”
–”বাইর না কইরা বুঝেন কেমনে? সাইলেন করা নাকি?”
“না। বাজলে আওয়াজ-ঐ হইত।”
–”তাইলে? মুবাইল তো বাইরও করেন না। কাউরে কল্‌ করবেন নাকি ওস্তাদ?”


ওস্তাদ! হায়! আমি হাসি পেয়ে যায়। গল্পের লোভে আমাকে এই এরকম সাঁকোর মত পল্‌কা মুরতাজাকেও ওস্তাদ বলতে হচ্ছে! মুরতাজা মুখ খোলে না। তাকে বাঁচিয়ে দেয়ার জন্যেই সোলায়মান বেরিয়ে আসে। ডাক্তারি শেষ, রোগী নেই, সাড়ে নয়টা বাজে। আমি তড়াক করে উঠে যাই। দৌড়ে গাড়ি; প্যাডেল; রিয়ার-ভিউ মিরর; হর্ণ; স্টিয়ারিং; ব্রেক। সুলায়মানের বাসা। কালকে সকালে পুরনো সময়ে আসতে হবে বলে সুলায়মান উঠে যায় সিঁড়ি দিয়ে। আমি গাড়ি গ্যারেজে ভরে তালা দেই। চাবি জমা দিয়ে ফিরে চলি ঘরে, হেঁটে হেঁটে। ঘর। আমার মাথায় মুরতাজা গিজগিজ করে। মুরতাজার ডান হাত আর কম্পমান সাঁকোর মত মুখ নির্বিবাদে ঝুলে থাকে।



গাড়ি চালানোর সময়ে মাথায় অনেক অনেক চিন্তা ঘুরতেই থাকে, চাকার সাথে সমদ্রুতিতে। স্টিয়ারিঙের টানে একেকটা বাঁকে আমার চিন্তাগুলো আটকা পড়ে যায়, আবার আটকাবস্থা থেকে ছুটেও যায়। আমি মুরতাজাকে নিয়ে ভাবি, মুরতাজার মোবাইল আমার মগজে, হাতে, মুখে বিঁধে ভাইব্রেট করতে থাকে।
‘কল করতে গিয়েও কেন কেউ দ্বিধায় পড়বে? কেন বারবার মোবাইল বের করতে গিয়েও থেমে যাবে এবং সাঁকোর মত কাঁপতে থাকবে?’
বিড়ালের মত আমার চিন্তা সচল হয়। মুরতাজা বিবাহিত, কারণ এই বয়স পর্যন্ত কেউ অবিবাহিত থাকে না। ঘরে ফেরার জন্য ন’টা পেরোলেই তার সঘন ঘড়ি দেখা সেটাকেই সমর্থন করে। বিবাহিতের সন্ধ্যা অস্থির হয়ে ওঠার কোন সূত্র আছে কি না আমি জানি না। গাড়িটা দুপুরের রোদে মগবাজারের জ্যামে ঠেলে দিয়ে আমি ভাবনায় মুখ গুঁজে দেই। পেছনে সোলায়মানের বউ, ভিতরে এসি। শীতল শান্তি। পেছনের কোথাও তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর দরকার, অহেতুক জ্যামে তাই সে অস্থির। আমার কোথাও যাবার তাড়া নেই।


মুরতাজার বউ কেমন? সে নিজে কিছুটা হ্যাংলাটে, সাড়ে পাঁচের উপরে উঠেছে কি ওঠেনি। শুকনো ও মচমচে পাঁপড়ের মত শরীর। তার বউ নিশ্চয়ই মোটা। থলথলে শ্যামল। মুরতাজা কত পরিশ্রম করে, কিংবা কতটা হাঁপিয়ে ওঠে? শুকনো মানুষের ক্ষিদে বেশি হয় বলেই জানি। তাহলে তার বউ কেমন হবে।- এসব বিশৃঙ্খল সুড়সুড়ে চিন্তার জট লেগে যায় ভ্যান আর রিকশার মত। হ্যাঁ, মুরতাজার বউ একটু মোটা হলেই ভালো। গমন আরামের, সেরকম শরীরে খাঁইও বেশি। ‘মুরতাজা তো সারাদিন বসেই থাকে টুলের ওপর, আমার মত গাড়ি চালাইলে বুঝতো- কাহিল কারে কয়!’ এই সবের পরে কি রাত জাগতে ভাল লাগে? লাগে না। মুরতাজা ওষুধ বেচে আর নয়টার পরে বাসায় ফিরে মোটা বউয়ের কাছে। সারাদিন মুরতাজার বউ একা একা থাকে। কী করে? জ্যাম ছুটে যাচ্ছে মগবাজারের, আমার হাত সচল হয়। মুরতাজা ও তার বউ আমার সাথে বাঁক ঘুরে যায়। তার বাসা যেই গলিতে, সেই গলির মতই একটা গলিতে আমি ঢুকে পড়ি মেইনরোড ছেড়ে। এখানে ঘিঞ্জি বাসা, গাড়ি ছাড়াই চলাচলে সুবিধা। আবারও আটকে যাই। সন্ধ্যাবেলা মুরতাজা অস্থির হয়ে ওঠে, তিরতির করে সেই অস্থিরতা আমার মাঝেও কিছুটা ছড়িয়ে যায় এখন। মুরতাজার বউ সারাদিন বাসায় একা একা থাকে। শ্যামলা বউয়ের জন্য সারাদিন ওষুধ বেচার ফাঁকে ফাঁকে মুরতাজার কেমন লাগে?


দুপুরের রোদের ঝাঁজ মাথায় নিয়ে সেই গলিতে আমি সোলায়মানের বউয়ের জন্য অপেক্ষা করি। তার কাজ শেষ হওয়ার পরে, আবারও মগবাজার মোড় ঠেলে বাসায় পৌঁছে দিই। বাসাতেই খাওয়ার ব্যবস্থা, আমি খেতে বসে মুরতাজার কথা ভাবি। দুপুরে মুরতাজা একটা টিফিন বক্সে করে খায়। হলুদ রঙের বক্সের গায়ে, তরকারিতে দেয়া আরো গাঢ় হলুদের দাগ লেগে থাকে। ঐ দাগের মধ্যে মুরতাজার বউয়ের গন্ধ পাই। শ্যামল হলুদ ও মোটা। নাহ, ভাতের মাখানো লোকমা মুখে পুরে আমি চিবাতে চিবাতে মুরতাজার খাওয়া কল্পনা করি। হলুদ টিফিন বক্সধারী মুরতাজা তার বউ নিয়ে এত চিন্তিত নয়। এরকম সিদ্ধান্ত ও অনুসিদ্ধান্তে দুলতে দুলতে আমি গাড়িতে ফিরি। সোলায়মান-পুত্রের কোচিং, তারপরে আবারও চেম্বার। চেম্বারে পুরনো অস্থির মুরতাজা।


ঢুকে যে হাসিটা আমি মুখে ঝুলিয়ে রাখলাম, সেটা দেখে মুরতাজা কিছুটা নরম হলো। হাসি সংক্রামক, এবং সর্বত্র ক্রিয়াশীল।
–”কী খবর, মিয়া?” আমি কিছুটা ভান ধরি।
“এই চলতেছে” মুরতাজা গতকালকের আমি’র মত নির্লিপ্ত।
–”আপনের মুবাইল বাজে না?” বলে আমি ‘হে হে হে’ করে বিরক্তিকর ঠ্যাস দেয়া হাসি দেই। দাঁতের সহাস্য প্রকাশ মুরতাজার ভালো লাগে বা লাগে না, তার ডানহাত অনায়াসে পকেটে ঢুকে যায়। মোবাইলের শরীর ধরে বের করে সে আমাদের সামনের টেবিলে রাখে।
“সন্দ্যা হইলে মাঝে মাঝে চেক করতে হয়। একটা কল করতে ইচ্ছা হয়।”
–”কারে?”, আমি গলা তিন ধাপ নামিয়ে ফেলি।
“কাউরে না”
–”ধুর মিয়া, বলেন দি।”
“কইলাম তো কাউরে না।” মুরতাজার স্বরে বিপন্নতা।
–”এসব কইলে হবে? বলেন না, রোজ দেখি আপনে সন্দ্যা আইলেই ব্যস্ত হইয়া পড়েন।”
মুরতাজার নীরবতায় আমি অসহিষ্ণু হয়ে উঠি, “ভাবিসাব’রে ফোন করবার চান নাকি?”
মুরতাজা চমকে বলে, “না, তারে ক্যান করুম?”
– “তাইলে!”, আমি ঝেড়ে ফেলে দিলাম দুপুরের জটালো-চিন্তাটা।


মুরতাজার মুখে কথা এসেও, এক টুকরা হাসির আড়ালে ভেসে যায়। মুখ বাঁকা করে হেসে দিয়ে সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সোলায়মান ডাক্তারের ঘর থেকে বেরিয়ে, রোগী ওষুধ কিনে চলে যায়। আমি তখনও কাউন্টারে ঠায় দাঁড়ানো!
হাতের কাজটুকু সেরে মুরতাজা আবারও মুখে সেই বাঁকা হাসিটা ঝুলায়।
–”হাসেন ক্যান?”, চাপাস্বরে কাজ হয়। মুরতাজা বলে, “যারে ফোন করতে চাই তার নাম রেশমা।”


রেশমা। রেশমা নামটিকে আমি চিনি। ঘিঞ্জি গলির ভীড়ের মধ্যে থেকে আলাদা করে টের পাওয়া যায় এমন এম্বুলেন্সের সাইরেন হয়ে ওঠে রেশমার নামটা। অথচ আমার বা মুরতাজার জানা আছে যে ‘রেশমা’ নামটাও রেশমার আসল নাম নয়। সেই নামের সুতোয় মুরতাজা বাঁধা পড়ে গেছে।
সে বলতে শুরু করে, “রেশমার কাছে অনেকদিন ধইরাই আমি যাই। রেশমারে আপনি চিনবেন না। না চিনোনই ভালো। এরে একবার চিনলে কি বিপদ, তা আমি বুজতাছি।”, একটু দম নেয় মুরতাজা, “এইখানে আসোনের আগে থেইকা, আমি রেশমারে চিনি। রেশমা আমার বহুত ভালা লাগে। বুঝলেন?”


আমি বুঝি।


–”তো আপনি সন্দ্যায় এরাম করেন ক্যান?”
“রেশমারে ফোন করতে ইচ্ছা করে। আগে আমি ঐ টাইমৈ যাইতাম হের কাছে। এখন যাইতে পারি না। মাঝে মইদে দুপোরে যাই। যে গরম!”
মুরতাজার গরম লাগার কষ্ট আমি বুঝতে পারি। আমার গরম লাগতে থাকে। রেশমার যাবতীয় অতিথিদের গরম লাগার বেদনা টের পাই শরীরে।
“সুলাইমান সা’ব আগে সন্দ্যায় ছুটি দিত। এখন দেয়না।”, চাপা গলায় বলে মুরতাজা, “বেডার খাই বাড়ছে, এত রাইত পর্যন্ত ব্যবসা আর ব্যবসা।”


এগুলো কথা যে আসল কথার প্রস্তাবনা, সেটা আমি বুঝি। আর সেজন্যেই অপেক্ষা করি মূল কারণটা জানার জন্য। আমার পায়ের ধরে আসা ঝিঁঝিঁটাকে আমি পাত্তা দেই না।
মুরতাজা বলে, “আগে সন্দ্যায় যাইতাম, অহন দুপোরে। এইটা কোনো বিষয় না আসলে। তয় খারাপ লাগে। কি করি কন?”


মুরতাজা যে আমাকে আপনি বলছে সেটা আমি খেয়াল করি না। অভিজ্ঞ কারো কাছেই পরামর্শ নিতে হয় বলে এই সম্বোধন। আমি মাথা নেড়ে বুঝে ওঠার চেষ্টা করি, “আপনের সমস্যা কি? সন্দ্যায় ফাঁকা ফাঁকা লাগে?”
আমার শ্লেষটা গায়ে মাখে না সে, “না রে ভাই, আমার খালি অস্থির লাগে। সন্দ্যায় আমি বইতাম। তখন দেখছি রেশমা মুবাইল বন্‌ কইরা দিত। এখন সন্দ্যায় হের মুবাইল বন্‌ পাইলে আমার খালি অস্থির লাগে।”


ঝিঁঝিঁ কেটে আমার পায়ে সাড় ফিরে আসতে চায়। পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে সাঁই সাঁই করে রক্তকণা ছুটে যাচ্ছে, মগবাজারের ঘিঞ্জি গলির মতো ভীড় ঠেলে। স্নায়ুর ঝড় পা থেকে পেটের দিকে গুলিয়ে উঠে আসছে। রেশমার মোবাইলের ডায়াল টোনের কাছে বাঁধা পড়া মুরতাজা আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। আমি চোখ সরিয়ে নেই। কাউন্টারের ভিতরে, একটু কোনার দিকে, সরলমনে বসে থাকা হলুদ টিফিন বক্সটা মুখ ব্যাদান করে চেয়ে থাকে।




***
নোটঃ এই লেখাটার আংশিক পরিবর্তিত রূপ দৈনিক সমকাল পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় ৩০ মার্চ, ২০১২। প্রকাশিত লেখাটির লিঙ্ক এখানে। 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন