বৃহস্পতিবার, ৯ জুলাই, ২০০৯

মীথবাজিঃ সিসিফাস ১

থানাটোসের ঘুম ভেঙেছে সেই ভোরে। সকালে দাঁত মাজতে মাজতে সে দেয়ালে সেঁটে রাখা লিস্টি দেখছিল। মুখ ভর্তি ফেনা থু করে ফেলে দিয়ে কুলি করতে করতে সে শিডিউল মিলিয়ে নেয়। সকালে কয়েকজনের আত্মা তুলে রাখতে হবে। এটা তেমন কোন ব্যাপার না, সকালে সবাই গভীর ঘুমে ডুবে থাকে। খুব সহজেই কাজ সারা যায়। বেলা বাড়লে ঝামেলার শুরু হয়, জান কবচ কি খেলা কথা?! কাজ শুরু করে থানাটোস বেশ অনায়াসের পাঁচ ছয়টা জান কবচ করে ফেললো বেশ তাড়াতাড়ি। এপোলোকে ধন্যবাদ, আজ দিনটা খুবই পয়মন্ত মনে হচ্ছে!


কিন্তু বিধি বাম। একটু পরে হঠাৎই জরুরি তলব পড়লো জিউসের দরবার প্যান্থিওনে। “এই সেরেছে! আবার কি ঘটলো?” ভড়কে গিয়ে ভাবে সে। যে মানুষটার বাসায় গিয়েছিল, তাকে কবচ না করেই ফিরে এল। ব্যাটা আরো কিছুসময় শ্বাস নিক, পরে দেখা যাবে। প্যান্থিওনে পৌঁছে দেখে জিউস দরবারে মাথা নিচু করে বসে আছেন। পুরো দরবার থমথমে।


ঢোকার মুখে কয়েকজন ফিসফাস করছিল, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। ভেতরে ঢোকার সাহস হচ্ছে না তাদের, ঘটনা গুরুতর! থানাটোস সেখানেই আগে থামল, ঘটনা না বুঝে জিউসের মুখোমুখি হওয়া ঠিক হবে না। যা শুনলো তাতে সে হাসবে না কাঁদবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। বেচারা জিউস! এতকিছু ঘটলো তাও স্বভাব বদলালো না হুজুরের।


জিউসের অনেক অভ্যাসের মাঝে নারীপ্রীতি ছিল একটা। হঠাৎ করেই জলাপ্সরা দেখলেই কাজকর্ম ফেলে পেছন পেছন রওনা দেন। এসব নিয়ে হেরার সাথে ঝগড়াঝাঁটিও মাঝে মাঝেই ঘটে। ইদানিং শোনা যাচ্ছিল তার এজিনার সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতা। এখন থানাটোস বুঝতে পারলো যা রটে, তার কিছুটা ঘটেও বটে! হয়েছে কি, জিউস কিছুদিন ধরেই এজিনা’কে পটাচ্ছে, আর এজিনাও সুযোগ বুঝে লাস্যময় হাস্য দিয়ে তাকে মজিয়ে রাখছে। কিন্তু এজিনার বাবা এসোপাসের এসব পছন্দ হয়নি। একদিন ধরতে পেরে জিউসকে তাড়া লাগিয়েছেন, পুরো দ্বীপ দাবড়ে ভাগিয়ে দিয়েছেন। জিউসেরও মাথা গরম, এজিনাকে উঠিয়ে নিয়ে অ্যাটিকার একটা দ্বীপে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তা বাবা, উড়িয়ে নিবি ভালো কথা, একটু বুঝে শুনে করবি তো, নাকি? সারা দুনিয়াকে দেখানোর কীইবা দরকার ছিল?


এদিকে এসোপাস মেয়ের শোকে খোঁজে বেরিয়েছিলেন। পথে কোরিন্থ রাজ্যে দেখা হলো সিসিফাসের সাথে। সিসিফাস সেখানকার রাজা। তাঁর মত বুদ্ধিমান এবং ধুরন্ধর রাজা খুব কমই ছিলেন সেসময়ে। তাবড় তাবড় দেবতারাও তাকে ডরাইতো! এসোপাস তাঁর কাছে ঘটনা বলা শেষ করেছেন কি করেননি, সিসিফাস বলে উঠলেন, “আরে! আমি তো দেখলাম সেদিন একটা ঈগল নখে করে এজিনাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে অ্যাটিকার দিকে! নিশ্চয়ই ওটা জিউসই ছিল!”
এসোপাসের চেহারা রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো, “বদমায়েশটাকে যদি আমি শিক্ষা না দিছি!”
সিসিফাস বললেন, “আঙ্কেল, দাঁড়ান। হুট করে এত রেগে গেলে তো বিপদ। বুঝেশুনে প্ল্যান করতে হবে, লোকটা জিউস।”


তারপরের কাহিনী পুরো জানা যায়নি, একটা নিঃশ্বাস ফেলে জানালো বক্তা। তবে থানাটোস শিওর যে নিজেকে বাঁচাতেই ব্যাটা সবকিছু বললো না। সেই জিউস ফিরে এসেছেন, এখন মাথা নিচু করে থম মেরে বসে আছেন দরবারে আর থানাটোসকে ডেকে পাঠিয়েছেন। সে ভিতরে ঢুকে কুর্নিশ করে দাড়ানোর পরে জিউস বলে উঠলেন, “থানাটোস! তোমাকে আমি খুবই পছন্দ করি। মর্ত্যের মানুষের জান-কবচের কাজ তুমি খুব নিষ্ঠার সাথে করছো।”
থানাটোস একটা বিগলিত বোকা বোকা হাসি দিল। “থ্যাঙ্কু জিউস!”
“হুম”, গম্ভীর হয়ে বললেন জিউস, “এখন একটা অন্য কাজে তোমাকে ডেকেছি। সিসিফাস নামের এক রাজা আছে কোরিন্থ রাজ্যে। তার উদ্ধত আচরণ আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তোমাকে একটা বিশেষ কাজ করতে হবে।”
থানাটোস বিগলিত হেসে বললো, “সিসিফাসের জান কবচ করতে হবে তো? কোন ব্যাপার না বস্‌!”
“থামো থামো। আগেই লাফ মেরে কথা বলো না।”, জিউস একটু বিরক্ত হলেন, এদেরকে একটু লাই দিলেই কথার মাঝখানে কথা বলে! “জান-কবচ করলে তো মামলা চুকেই গেল। তারপরে সে চলে যাবে প্লুটোর ডিপার্টমেন্টে, পাতালে। আমি চাই সিসিফাসকে আরো বড় শাস্তি দিতে।”, একটু থামলেন জিউস দম নেয়ার জন্য। তারপরে বললেন, “সিসিফাসকে টারটারাসে ফেলে দেয়া হউক। ওখানে তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হবে।”
দরবারের সবাই জিউসের কথা শুনে শিউরে উঠলো! টারটারাস পাতালেরও নিচে এক ভীষণ অন্ধকার আর ভয়ানক স্থান। সেখানে চিরশীতল অন্ধকার তাল তাল বরফের মত জমে থাকে। প্লুটো তো তবুও পাতাল দেখাশোনা করেন, টারটারাসে কেউই তদারকির দায়িত্বে নেই। কে যাবে ওখানে! সব ভয়ঙ্কর পাপীদের আখড়া।


কোন দুর্মুখ একটু সাহস করে বলে বসেছে, “কিন্তু এমন কী করলেন সিসিফাস, যে তাকে একেবারে টারটারাসেই…”
প্রশ্ন শেষ হবার আগেই জিউস পাঁই করে তার দিকে ঘুরে গেলেন। তার তীব্র দৃষ্টির সামনে প্রশ্নকর্তা আমতা আমতা করে চুপ হয়ে গেলেন।
“সে খুবই অন্যায় কাজ করছে পৃথিবীতে। আমার কাছে অভিযোগ এসেছে, সে এজিনাকে ধরে নিয়ে আটকে রেখেছিল। তা ছাড়াও সময়ে সময়ে সে অনেক দেবতারই গোপন কথা ফাঁস করে দিয়েছে। এমন ধুরন্ধর আর উদ্ধত বেয়াদবকে শাস্তি দেয়ার সময় চলে এসেছে। থানাটোস!”
–”জ্বি, জিউস।”
“এই নাও শিকল”, বলে জিউস একগোছা শেকল ছুঁড়ে দিলেন, “এখুনি গিয়ে সিসিফাসকে আটকে ফেলো টারটারাসে।”


শেকলের গোছাটা গুছিয়ে নিয়ে থানাটোস বেরিয়ে আসে। এখনই পৃথিবীতে ফিরতে হবে। বেলা প্রায় দুপুর এখন।


কোরিন্থে গিয়ে সিসিফাসকে পাকড়াও করতে থানাটোসের খুব একটা বেগ পোহাতে হলো না। সিসিফাস খুব সহজেই ধরা দিলেন। মনে মনে থানাটোস ভাবলো, “জিউস এই পাবলিকের কাছে কেমন করে ধরা খেল? মেয়ে মানুষের সঙ্গে থেকে থেকে জিউসের বুদ্ধিশুদ্ধি আসলেই গেছে!” সিসিফাসকে জাপটে ধরে একটানে পাতাল পেরিয়ে এলো থানাটোস, পরের স্টপেজেই টারটারাস। সেখানের ঠাণ্ডা বাতাসে তার নিজেরই হাড়ে কাঁপন ধরছে। তাড়াতাড়ি সিসিফাসকে বেঁধে রেখে ফিরতে হবে। “এর চেয়ে জান-কবচ কতো সোজা!”, একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভাবে থানাটোস, “ধরো তক্তা, মারো পেরেক! ঝামেলাবিহীন।”


টারটারাসের পরিবেশে সবকিছুই পাথুরে, পাহাড়ি। গাছপালা বা নরম মাটির কোন চিহ্নই নেই। পাথরগুলোও অসম্ভব রুক্ষ্ণ। হাঁটতে গিয়ে থানাটোসের নিজেরই পায়ে ব্যথা লাগছে। সিসিফাসের অবশ্য এদিকে টুঁ শব্দও নেই। “ঘটনা কী?”, ভাবে থানাটোস, “লোকটার কি কোন অনুভূতিই নেই নাকি?”


–”এই যে সিসিফাস!”, গলা খাঁকারি দিয়ে হাঁকে থানাটোস, “এখানে, এইখানে! এই পাথরের সাথে আপনাকে বেঁধে রাখা হবে। জিউসের নির্দেশ।”


এতক্ষণে সিসিফাস মুখ খোলে, “কেন? আমি কী করেছি? আমাকে কেন এই শাস্তি দেয়া হলো!! আমার তো কোন বিচারও হলো না!”


–”আমি কিছু জানি না। আমাকে যা নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আমি সেটাই করছি। হাইকমান্ড!”


“তা বলে আমি একবার আত্মপক্ষ সমর্থনও করতে পারবো না? আজব! প্লুটো কোথায়?”- সিসিফাস এদিকে ওদিকে তাকায়।


–”এটা প্লুটোর এরিয়া না। টারটারাসে প্লুটোর কোন জুরিসডিকশন নাই।” , থানাটোস বলে, “আপনি যা করেছেন তার জন্য আপনাকে মৃত্যুর অধিক শাস্তি দেয়া হয়েছে। এখানে টারটারাসে আপনাকে শেকলবন্দী করে রাখা হবে অনন্তকাল!”


“হায়!!” কাতর কণ্ঠে বলে ওঠে সিসিফাস, “এ কেমন বিচার! আমার দোষ প্রমাণের আগেই শাস্তি হয়ে গেল?”, ডুকরে কেঁদে ওঠে সে।
সিসিফাসের আর্তনাদে টারটারাসের শীতলতার জমাট বরফ ভেঙে যেতে থাকে। “অনন্তকাল! আমার এমন কী অপরাধ যার জন্য এই শাস্তি হলো? আমি তো কারো ক্ষতিই করিনি। কারো জীবননাশ করিনি! তাহলে কেনই-বা আমার এমন কঠোরতম শাস্তি! কেন? কেন?”


সিসিফাসের আহাজারিতে থানটোস ভীষণ বিপাকে পড়ে গেল। কী মুশকিল! এতক্ষণ ভাবছিল সিসিফাসই দোষী, এখন তার কান্নাকাটি দেখে তো মনে হচ্ছে কোথাও কোন গড়বড় আছে। থানাটোস আবার বেশি চিন্তাভাবনা করতে পারে না, মাথা ভার ভার লাগে। তাই সে তাড়াহুড়া করলো, “আমি অতশত জানি না। আপনি এই পাথরে বাঁধা শেকলটা গলায় পেঁচিয়ে নেন। তাড়াতাড়ি!”


সিসিফাস কান্না-জড়ানো স্বরে বলেন, “কোথায়?”


–”এই তো এখানেই। দেখতে পাচ্ছেন না?” অস্থির হয় থানাটোস।


“নাহ! এত অন্ধকার! আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।” হতাশ স্বরে বলেন সিসিফাস।


থানাটোস শেষমেশ সিসিফাসের হাত ধরে শেকলটা ধরিয়ে দিলো। “এই যে শেকল, এখন তাড়াতাড়ি গলায় বেঁধে ফেলেন।”


“কিন্তু এই শেকল এত ভারি! এটা আমি কীভাবে গলায় বাঁধবো? আমি যে পারি না!”


–”আচ্ছা মুশকিল হলো দেখি! এখন কি এটাও আমাকে দেখিয়ে দিতে হবে নাকি?”, রাগত স্বরে বলে ওঠে থানাটোস।


“প্লিজ! যদি আপনি একটু দেখিয়ে দিতেন, তাহলে খুব খুব উপকার হতো। আমার জীবন তো এমনিতেই শেষ। এই টারটারাসের অন্ধকারেই মাথা খুঁড়ে মরতে হবে। অন্তত শেকলটা ঠিকমত পরে নেয়া দরকার”, সিসিফাসের কাতর কণ্ঠের পেছনে যে সূক্ষ্ণ পরিহাস, তা থানাটোসের নজরে পড়ে না।


“আচ্ছা ঠিকাছে। আমি দেখাচ্ছি”, বলে থানাটোস ভারি শেকলের একপ্রান্ত হাতে তুলে নেয়, “এই দেখেন। এভাবে এক পাক, তারপরে উল্টোদিকে আরেক পাক। এভাবে।” বলে সেই শিকলটা পরে নেয় সে, “এইবার বুঝলেন?”


অন্ধকারে ঘটাং করে একটা শব্দ হলো। থানাটোস ঠিক বুঝে পেলো না ঠিক কোত্থেকে কী হয়ে গেল। কিন্তু হঠাৎ করেই সে শেকলের ভারে হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল। সাথে সাথে সিসিফাসের অট্টহাসি শোনা গেল অন্ধকার টারটারাস জুড়ে। শীতল পাতালেরও অধিক পাতালে, থানাটোস সহসাই বুঝতে পারলো কী হয়েছে। শেকলটা খুলে আনার জন্য যে কড়াটি দিয়ে ঠেস দিয়ে রেখেছিল সে, সিসিফাস এইমাত্র সেটা খুলে নিয়েছে। আর সে পাথরের সাথে শেকলবন্দী হয়ে গেছে!


“অর্বাচীন দেবতা!” হিসহিসিয়ে ওঠে সিসিফাস, “তোমাদের হুজুরের দোষ আমার ঘাড়ে চাপাতে চাইছো? তোমরা মর্ত্যে যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াবে, আর সেজন্যে ভুগবো আমরা! ভেবেছো কি? নির্বোধ অক্ষম মানব, তোমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কীইবা করতে পারবে!”


একটানে থানাটোসের রথে লাফিয়ে উঠলো সিসিফাস। তারপরে সাঁ সাঁ করে ছুটে যেতে লাগলো পৃথিবীর দিকে। তাঁর মুখে তখন ফুটে উঠছে বিজয়ের চতুর হাসি!


~*~*~*~*~*~
পরিশিষ্টঃ থানাটোসের অকস্মাৎ অন্তর্ধানে পৃথিবীতে জান-কবচের জন্য কেউ রইলো না। বেশ কিছুদিন ধরে মুমূর্ষু রোগীগুলোও কীভাবে জানি বেঁচেই রইলো। মর্ত্যবাসী অবশ্য এটাকে বিধাতার অসীম কৃপা ভেবে আরো বেশি প্রার্থনায় মশগুল হয়ে উঠলো। সেই খবর প্যান্থিওনে পৌঁছানোর পরেই সকলের টনক নড়লো, আসলেই তো! থানাটোস কোন চুলোয় গিয়ে মরেছে! জিউস অবশেষে খুনে জাঁদরেল অ্যারিসকেই পাঠালেন থানাটোসকে সেই টারটারাস থেকে ছাড়িয়ে আনতে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সিসিফাসকে শেষপর্যন্ত সেই টারটারাসেই এক কালজয়ী মীথের জন্ম দিয়ে নির্বাসিত হতে হয়েছিল। কিন্তু সে আরেক গল্প, আজকে বরং এখানেই থাক?
(ক্রমশ...)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন