বুধবার, ২৯ জুলাই, ২০০৯

মধ্যমাস জর্নাল


সকলের মত সকাল আসে না আমার
জানালায়
ভোর কিংবা সকালের রোদসকল দানাবাঁধা
সিলুয়েট
ছবিহীন দুপুর আঁকতে থাকে নিরলস শ্রমে।


২.
আমাদের শহরে বছরের মাঝের মাস দু'টা ঘুণপোকার মতো একাগ্রতায় বিঁধে থাকে। কাঠের শরীর কুরে কুরে খাওয়ার সুখ পেতে থাকে মধ্যমাসের ঘন্টাগুলো। তারা শ্লথ এবং নির্বিকার, সেই কারণে অনেকাংশেই নিঃসংশয়ে আমাদের শহরের ইতিহাস থেকে মধ্যমাসের ঘটনাবলি ঝরে যায়। জুন ও জুলাই মধ্যমাসের টানাহ্যাঁচড়ায় পড়ে বাদী-বিবাদী অথবা বাঁদী হয়ে আদালত চৌকাঠে আছড়ে পড়ে। কোমল নিঠুর শহরের রাজপথে জুন ও জুলাই যেভাবে বিস্মৃত হয় সেই দুর্ধর্ষ ঘটনার বিচার চাই-- আমরা নীরব জনগণ এবং ধর্মালয়ের জাগ্রত পিতা! জুন ও জুলাইয়ের খিন্ন-বসনা শরীরের দিকে আমরা জুলজুল করে তাকিয়ে থাকি। আরে ভিখারীর শরীর এমন ডগমগে! কোথায় খায়, কোথায় পরে? জানা গেছে কি মোক্তারের নথিতে সে'সকল আখ্যান? আমাদের মননে জুন ও জুলাইয়ের ভাঁজ ঢুকে যেতে থাকে নিরন্তর ঘামের সাথে। আদালত কক্ষের বাইরে সকাল বা বিকাল গড়িয়ে যেতে যেতে মধ্যমাসের শরীর শীর্ণ ও জীর্ণ হয়ে যাবে এমন প্রত্যাশা বুকে পুষে রাখি আমরা।


৩.
আমার যন্ত্রণাদায়ক যন্ত্রের রোগে ভোগা শরীর থেকে গত পরশু জীবন বেরিয়ে গেছে। নিথর, নিস্পন্দ বুক দেখেও আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই, আশার নিভন্ত সল্‌তে তখনও দপদপাচ্ছে যে এক্ষুনি ঈষৎ ফুলে উঠবে নির্ঘাত। এই জীবন বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাটিতে যেরকম আন্দোলন ও প্রতিক্রিয়া আশা করা যায়, তার কোনটিই আমি অনুভব করি না বলে আশ্চর্য লাগে। মৃতের প্রস্থানের চাইতে জীবিতের ভাবলেশহীনতা আমাকে পীড়িত করে। সেইসাথে মৃতের প্রভাব কেটে গেছে, আমি তার তাবৎ স্মৃতি ও কান্নার শেকল থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পেরেছি, এমন মহাতৃপ্তিতে আমি কোমল ও আকুল হর্ষবোধ করি। যুগপৎ হর্ষ ও পীড়া, যুগপৎ শান্তি ও শ্রান্তি আমাকে ঝাঁঝরা করে দিতে থাকে।


৪.
খেলাপ্রেমের বেলা গেল
সেই সাথে উল্লসিত বন্ধু
আর উচ্ছ্বসিত বাতাস এল
আমাদের মাঝ থেকে আমি
ছুটে ছিটকে পড়লাম
বুঝলাম-- এই বাতিঘরে
আমাদের দিনাতিপাত
ফুরিয়েছে সকল চাহিদা,
বৃথা খেলা বৃথা অশ্রুপাত!


৫.
গতরাতে সংকুচিত বিছানায় শীতের বাতাস
বৃষ্টিছাঁটের সাথে এসে আশ্রয় নিলো
শাদা চাদরের কোঁচকানো ত্বকে ধীরে ধীরে
ব্যাপিত শৈত্য ও সিক্ততা
রোমান লিজিওনের মত ক্ষিপ্র দ্রুততায়
আমাকে স্পর্শাকুল করলো।
আমি নিঃসন্দেহ হলাম, এটা শ্রাবণ।
জুন ও জুলাইয়ের চক্করে, চিৎকারে আমাদের দিনপঞ্জি থেকে শ্রাবণ মুছে গেছে। যেভাবে পাতায় শুকনো কালির দাগ ম্রিয়মাণ স্রোতের পিঠে করে হারিয়ে যায়, শ্রাবণ ও বর্ষণ সেভাবেই পশ্চাতে হটে গেছে। রোমান লিজিওনের মত কেবল স্মৃতিময় দৈন্যতায় তারা আমার বিছানায়, সংকুচিত পরিসরে ঘুরে বেড়ায়। হায়!
আমি সরে যাবার বদলে একটু নিবিড় হই।
যন্ত্রের শীতল শরীরের মত শৈত্য
আমার ত্বক ও হাড়ে প্রবেশ করলে
একাত্ম হয়ে ওঠার সুখ সুখ কোমল আগুন
আমাকে পোড়াতে থাকে।




***
[গত দু'মাসের টুকরো টুকরো চিন্তাগুলো জুড়ে বাঁধাইয়ের চেষ্টা। আমার কারিগরি খারাপ নিশ্চয়ই, না'হলে এমন বেখাপ্পা লেখা নিয়ে দুঃসাহস কীভাবে দেখাচ্ছি!]

বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই, ২০০৯

আরেকটিবার আয়রে সখা!

আজকে বড় অসময়ে ঘুমালাম। কয়েকদিন ধরে কাজের চাপ বাড়ছে। সাথে পাল্লা দিয়ে আমার আলস্যও বাড়ছে। সাধারণত যে সময়ে আমি লিখতাম, লেখার চিন্তাগুলো পিঁপড়ার মত আসত, সেই সময়গুলো হারিয়ে গেছে। অথবা সময় সময়ের জায়গাতেই আছে, আমি ব্যস্ত হয়ে পড়ছি। বা হয়তো আমি আরো আলসে হয়ে পড়ছি। ঠিক জানি না, বিষয়গুলো ঘোরালো প্যাঁচালো।


তো, আজকে আমি অনেক সকালে উঠেছি, প্রায় সাতটার দিকে। এটা আমার জন্য অস্বাভাবিক, কারণ বেশি রাত জাগি। সকালের সময়টায় গাঢ় ঘুম হয়। কিছুদিন ধরে সেই শিডিউলটা ভাঙার চেষ্টা করছি। কিন্তু প্রায় দুই বছরের অনায়াসে গড়ে তোলা অভ্যাস বাগ মানছে না। রেগে ওঠা বেপরোয়া ঘোড়ার মত ফোঁস ফোঁস করে দাপাদাপি করছে। হয়তো শুয়ে পড়লাম বারোটা বাজতেই, কিন্তু হালকা ঘুম ঘুম ভাবটা কর্পুরের মত উড়ে গেল। মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তি উপেক্ষা করে আমি কড়কড়ে চোখ নিয়ে জেগে থাকি! তাই ঘুমটা ঝাপিয়ে আসে ভোরের কাছাকাছি সময়ে।


কিন্তু আজকে আমার ক্লাস ছিল নয়টায়, তাই উঠতেই হলো। ক্লাসের মধ্যে বিজ্‌বিজে এ.সি.র কারণে শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে, আমি হেঁটে হেঁটে ঘুম আর জড়তা কাটানোর চেষ্টা করতে থাকি। তারপরে লম্বা, একঘেঁয়ে ক্লাস শেষ হয়। দুপুরে বের হয়ে বাসায় ফিরছি যখন, তখন কোষে কোষে ঘুমের প্লাবন! মোটামুটি জামা-কাপড় না ছেড়েই, আমি তলিয়ে যেতে থাকি। আমার ভালো লাগে এভাবে ঘুমিয়ে পড়তে। মনে পড়ে রাতের বেলা জেগে থাকা মুহূর্তগুলো। আর সেটা মনে করতে করতেই আমার মনে আর কোন চিন্তা চলে না!


ঘুম যখন ভাঙলো, তখন প্রায় পাঁচটা বাজে। সারা বাসা নিঝুম। যখন ঘুমিয়েছি তখনও কেউ ছিল না। এর মাঝে সবাই ফিরেছে, আমাকে ডাকাডাকি করে তোলার চেষ্টাও করেছে খাবার জন্য। কিন্তু কী অতলঘুমে ডুবেছিলাম আমি! এখন আবার 'সারা-পাড়া-শুনশান'! ঘুম ভেঙে এমন একা লাগলে আমার মন বিষণ্ণ হয়ে যায়। মনে হয় আমার কাছেপিঠে কেউ নেই। একটা নীরব পাথর বুকের উপরে চেপে বসে থাকে, আমি শ্বাস নিতে পারি না। উঠে দেখি টেবিলা খাবার ঢাকা রয়েছে। টের পেলাম সাথে সাথেই যে কী ভীষণ ক্ষিদে পেয়েছে! খেতে খেতেই ড্যানির ফোন আসে।


আগামিকাল (ইতিমধ্যে সেদিনটা শুরু হয়ে গেছে) আমাদের ব্যাচের রিইউনিয়ন/গেট-টুগেদার। বুয়েট ছাড়ার প্রায় দু'বছর হতে চললো। এবারে মোটামুটি ঢাকা আর বাংলাদেশ খালি করে আমাদের ব্যাচের ভালো ভালো ছাত্র-ছাত্রীগুলো, প্রকৌশলীগুলো মার্কিন নয়তো কানাডা মুল্লুকে চলে যাচ্ছে। চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি, ধীরে ধীরে পরিচিত মুখ, চেনাশোনা মানুষগুলো ছুঁড়ে দেয়া গুলতির ঢিল হয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। আমি জানি তারা সবাই জড়িয়ে থাকবে... কিন্তু আবার কবে এভাবে একসাথে হওয়া হবে, কে জানে! সেজন্য একটা জড়ো হওয়ার প্রচেষ্টা কালকে দুপুরের পর থেকে। দুপুরের রোদ নেমে গেলে আমার তাদের অনেকের সাথে সম্ভাব্য শেষ দেখা হচ্ছে-- এটা ভাবতে মন অযথাই খারাপ হচ্ছে। এটাই জীবন, যাপন কষ্টকর এবং অনস্বীকার্য রকমের বাস্তব!


সেই গেট-টুগেদার উপলক্ষে গান-বাজনা হবে, গেঞ্জি-বিতরণ হবে, খাওয়া-দাওয়া তো হবেই। গান-বাজনা'র অংশে আমার একটুখানি কাজ। সেই প্র্যাকটিসের জন্যেই ড্যানির ফোন। দুপুরে পেরিয়ে বিকেল পাঁচটার সময়ে আমি বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ি। গাড়িতে করে বিরক্তিকর জমাট বরফের মত জ্যাম ঠেলে ঠেলে যাবার সময় আমার দু'বছর আগে র‌্যাগের কথা মনে পড়ে যেতে থাকে। কী সময়ই না ছিল, আনন্দবিষাদের ঘোলাটে স্মৃতিগুলো বোয়াল মাছের মত ঘাই তুলতে থাকে। অনুভূতি প্রকাশের সময়ে আমার জড়তা বেড়ে যায়। গ্র্যাজুয়েশন পার্টিতে ভিডিওতে সবার পুরনো চেহারাগুলো দেখে সবাই যখন একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করছে, আমি তখন হাজার চেষ্টা করেও এক ফোঁটা পানি আনতে পারিনি। শুধু গলার ভিতরে, ঠিক বুকের উপরে একটা দলা-পাকানো বাষ্প জমে ছিল পাহাড়ের মত ভারি হয়ে! আমি বার বার ঢোঁক গিলে সেটাকে পেটের ভেতর পাচার করতে কতই না চেষ্টা করলাম। জড়িয়ে ধরে বন্ধু কয়েকজন যখন ফোঁপাচ্ছে বা কাঁদছে, আমি অনুভব করি আমার ভেতরে দলার বাষ্পটা সারা শরীরে হিমবাহের মত ছড়িয়ে গেছে, তারপরেও বর্ষণ হয়নি! আজকে এই ক্ষয়া-বিকেলে জ্যামের মধ্যে সেই বাষ্প আমার কাছে ফিরে এলো।


মগবাজারের গলির ভেতরটা পরিচিত আগে থেকেই। সেটার মুখে চা-ওলার কাছ থেকে গরমের মধ্যেও এক কাপ চা খেলাম। মুখে চিনি'র ঘন স্বাদ মিশে গেল। ভিতরে ঢুকে একটু পরে গানের প্র্যাকটিসও কোনমতেই সেই স্বাদটাকে কমাতে পারলো না। প্রায় দু'বছরের আড়ষ্টতা এসে গলায় চেপে বসলো। আমার সময় লাগছিল সামলে নিতে। শেষপর্যন্ত একেবারে খারাপ হয়নি পুরোটা। কালকে সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানের আগে হয়তো আরেকটু মহড়া করা যাবে। রাতে বেরিয়ে এসে আরেক-কাপ চা পেটে পুরে নিলাম। জানি, এই মোড়ে দাঁড়িয়ে সবার সাথে আর চা-খাওয়া হবে না। কিছু চিনির মিষ্টি গরম তরলের মূল্য কত তা হয়তো জীবন পেরিয়ে গেলে আমি বুঝে উঠবো!


ফেরার পথেও সপ্তা'শেষের ভীড়। গাড়ি, ট্রাক, বাস, টেম্পো, সিএনজি এগুলোকে আমার আচমকাই ভালো লেগে গেল! কী নিদারুণ ঘামেভেজা, ধুলোমাখা জীবন আমাদের। ধুলোতেই মিশে যাবে নিশ্চিত ভাবেই। আমাদের এই স্মৃতি মৃত্যুবধি বয়ে নিয়ে বেড়ানোর দায় থেকে একটা সময়ে আমরা মুক্তি পাবো, তারপরে এই সব অতীত ও তুচ্ছ। তার আগে আমি এগুলো জড়িয়ে থাকতে চাই, এদের প্রয়োজন আমার কাছে অসীমের চেয়েও বেশি।

বৃহস্পতিবার, ১৬ জুলাই, ২০০৯

মেলাঙ্কলিয়া

প্রতিটা মানুষ একেকটা গহন টানেল
ঘরের ওপরের ছাদে তাদের বিম্ব জমে থাকে শিশিরের সাথে


টানেলের মত
ঘিয়েরঙের কয়েক
টুকরো নিঃশব্দ
বিকেল পকেটে
গলিয়ে রাখা যায়


পুলিশী তল্লাসি চলে তল্লাটে যখন, পকেটে জমানো বিকেলের রোদ
ফেলে দেয়া যায় ফুটপাতে, ভিখারির পাতে
খুশি খুব সে'ও আমার মতোইঃ "জিতে গ্যাসি হৈ" ভেবে
আমি এক অচল বিকেল গছিয়ে টানেলে লুকালাম শেষে
সেকথা পুলিশ বা ভিখারি না-ও জানতে পারে
গহন টানেলের ভেতর আরেক টানেল আড়াআড়ি!


টানেলের ওপারে গ্রীনহাউজ
কাচের ঘরের নাম সবুজ, তাপের সরবরাহ অহরহ
তাপঘরে টেবিল পাতা চোখের রশ্মির চে' তীক্ষ্ণ তীর
আলোক আলোক মাখা। সাজানো শরোৎসব জুড়েছে নৃত্যগান
ছুরি চামচ প্লেট মেলে লোকমা লোকমা মুখের ভেতর হেমন্ত শরৎ
জিহ্বা, চোয়াল, কড়কড়, কাশফুল!


প্রতিটা মানুষরূপী টানেলের ছায়া পড়ে থাকে ভিখারির পাতে।

রবিবার, ১২ জুলাই, ২০০৯

মীথবাজিঃ সিসিফাস ২

আজকাল ডে-লাইট সেভিঙয়ের কারণে বেলা বোঝা যায় না। আমরা, যারা এই বিষুবের কাছাকাছি বাস করে অভ্যস্ত, আমাদের কাছে ছয়টা মানে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা এসে যাওয়া। ধীরে ধীরে আলো কমে আসা। জুলাই মানে বর্ষাকাল, আকাশে গুমগুমে মেঘ বা ঝিরঝির বৃষ্টিতে আরো আগে থেকেই আঁধার ঘনিয়ে আসে। কিন্তু আজকে কাচের দেয়ালে তৈরি অফিস থেকে বের হয়ে সুমনের মনেই হয় না যে ছয়টা বাজে! বাইরে ঝকঝকে রোদ। বাতাস হুটোপুটি খেলছে। কোথাও অনেকদূরে বৃষ্টি নেচে গেছে, তাই বাতাসে গাছের বাকল ভেজা গন্ধ, মাটির ভাপের সুবাস। সুমন নাক একটু উঁচু করে জোরে শ্বাস টেনে নেয়। ছয়টায় তার অফিস শেষ হয়। আগে সন্ধ্যার অন্ধকারে বাসের লাইনে দাঁড়াতে হত, এখন এই ঝকঝকে বিকেলে বাতাসের মাঝে দাঁড়িয়ে সুমন কী করবে বুঝে পায় না!


সে এই চাকরিটা করছে প্রায় সাত বছর ধরে। ফিলোসফিতে পড়াশোনা করে এমন চাকরি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। তাই প্রথমে সুমনের মনে হয়েছিল এমন ভাগ্য কয়জনের ঘটে! দুইবছরের মধ্যেই চাকরি পার্মানেন্ট হলো, একটা বিয়েও করে ফেললো সে মায়ের পছন্দের মেয়েটিকে, নাম মৃন্ময়ী। এখন তাদের সাড়ে তিন বছরের একটা ছেলে আছে। সুমনের এই চাকরিতে এখন আর আগের মত ভালো লাগে না। মায়ের শরীর খারাপ থাকে ইদানীং- বয়সের কারণে নানান রোগ-বালাই। মৃন্ময়ীর সাথে সুমনের মানসিক দূরত্ব কয়েকটা ড্রয়িং রুমের সমান। প্রথম প্রথম সে পাত্তা দিতো না ব্যাপারটা, কিন্তু এখন অনেক কিছুতেই খুটখাট লেগে যায়। বিশেষত মায়ের ব্যাপারে (ঘরে কী হয়েছে কে জানে!) ইদানীং মৃন্ময়ী ভীষণ অসহিষ্ণু আচরণ করে। ছেলে বড়ো হচ্ছে তাই চাপা গলায় রাতের বেলা ঝগড়া চলে।


মাঝে মাঝে এই চাকরিটাও অসহ্য লাগে সুমনের। নয়টা-ছয়টা অফিস। সকালে এসে কার্ড পাঞ্চ করে ঢুকে যেতে হয় এই টাওয়ারে। সেভেন্থ ফ্লোরে তার অফিস। আশেপাশের বিল্ডিঙগুলো এমনভাবে ঘিরে রাখে যে দিনের বেলাতেও কোন আলো ঢুকে না। পুরো অফিসে তাই সারি সারি টিউবলাইট দিনরাত জ্বলে। সেন্ট্রাল এ.সি.। এই কারণে কলেজের প্রিয় শখ ধূমপানটাও ছাড়তে হয়েছে ধীরে ধীরে! সুমনের মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে কাচের দেয়াল ভেঙে ঝাঁপিয়ে পড়তে। কিন্তু সেই পথও খোলা নেই, ঝাঁপিয়ে পড়ার মত ফাঁকা জায়গাই তো নেই! অফিসের এক একঘেঁয়ে কাজেও সুমন আর আনন্দ পায় না। একই স্প্রেডশীট, একই রুটিন একই ধরাবাঁধা জীবন। মাঝে মাঝে লাঞ্চের পরে সুমনের দমবন্ধ হয়ে আসে। সে নিজের ভবিষ্যৎ স্পষ্ট দেখতে পায়, এই অফিসের বন্ধ কেবিনের মধ্যে তার সামনের বছরগুলো একে একে কেটে যাবে। তারপরে একদিন চুলে পাক ধরবে, শরীর অশক্ত হবে। রিটায়ারমেন্টের পরে ছেলেমেয়ের আশ্রয়, তারপরে একদিন ধুপ করে মরে যাওয়া। কয়েকদিন কেউ কেউ কান্নাকাটি করবে। তারপরে সব শেষ!


সেন্ট্রাল এ.সি.র ঠাণ্ডা ঘরটাকে সুমনের কাছে পাতালপুরীর কবর বলে ভ্রম হয়।


***


সুমনের সাথে, আমি নিজের মিল পাই। আমার চারপাশে যারা প্রতিদিন ঘুরে বেড়ান, তাদের সাথেও আমি এই একটা জায়গায় মিল খুঁজে পাই। আমারও হঠাৎ করেই নিজের বাস্তবতাকে ভয়াবহতম অ্যাবসার্ড বলে মনে হতে থাকে। একেবারে নিরর্থক এবং নিষ্ফল সংগ্রামের সমষ্টি বলে মনে হয়। আর তখনই মনে পড়ে সিসিফাসকে। হায় পরাক্রান্ত মহারাজ! দেবতাদের সাথে তার ক্রমাগত যুদ্ধ চলেছে। সীমাবদ্ধ মানুষ হবার পরেও সে কোন দেবতাকেই পূজনীয় মনে করেনি। জিউসের সাথে তো অনেক বোঝাপড়া হয়ে গেল, থানাটোসকেও চরম দুঃসময়ে ঘোল খাইয়েছে সে। কিন্তু অমোঘ নিয়তি তার ভবিষ্যত সেই টারটারাসের গহীনেই লিখে রেখেছিল, যা থেকে তার কোন পরিত্রাণ নেই।


নাহলে কিসের জন্য সে তার স্ত্রীর ভালোবাসার পরীক্ষা নিবে? যাকে সে এত ভালোবাসে, যার সাথে তার এতদিনের সংসার, তাকে কেনই-বা মিছে সন্দেহ? সিসিফাসের স্ত্রীর নাম মেরিওপি। খুব সাধারণ নারী, সিসিফাসের চৌকস বুদ্ধির তুলনায় সে কিছুটা আটপৌরেই। তাই যখন সিসিফাস তাকে বললো, "তুমি আমাকে পাবলিক স্কয়ারে জীবন্ত কবর দিয়ে দাও।", তখন সে হয়তো সেটাকে স্বামীর বিচিত্র খেয়ালের বেশি ভাবেইনি। সরলমনে করে ফেলা সেই ভয়ঙ্কর কাজের মানেই হলো সিসিফাস আর কখনোই পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবে না। মৃতের নগর থেকে কে কবে ফিরে এসেছে!


সিসিফাসের যখন জ্ঞান ফিরলো তখন সে পাতালপুরীতে। বিচার শেষে তার জায়গা হয়েছে অন্ধকার কুঠুরি। সবকিছউ বুঝে উঠতে তার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো, "নির্বোধ নারী!", ভাবলো সে, "আমাকে এভাবে কবরে নিক্ষেপ করতে তার এতটুকুনও বাঁধলো না! এই তার ভালোবাসার নমুনা?" ভয়ঙ্কর রাগে সিসিফাসের মাথায় আগুন ধরে গেল। পাতালের দেবতা হলেন প্লুটো আর দেবী পার্সিফোনি, তাদের কাছে সমানে সে ধর্না দিতে লাগলো। কত তার কথামালা, কত কাতর অনুনয়, বিনয়, আহাজারি। বেশি কিছু নয়, প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর সাথে আর একটি বার দেখা করতে চায় সে। তার সাথে মৃত্যুর আগে ঠিকমত বিদায়ও নেয়া হয়নি তার। প্লুটো ইতোমধ্যে জানেন টারটারাসে কীভাবে থানাটোসকে ঘোল খাইয়েছে সিসিফাস, তাই এইসব কথায় তাই একটুও চিঁড়ে ভিজলো না। কিন্তু পার্সিফোনি তো নারী, তায় আবার অপরূপ রূপসী। সিসিফাসের ক্রমাগত 'তেল' তাকে মোটামুটি পিচ্ছিল করে দিল। রাতের বেলা শুয়ে তিনি প্লুটোকে বলেন, "ওগো, বেচারাকে একটু সুযোগ তো দাও। কেমন কাতরকণ্ঠে আবেদন জানাচ্ছে!"


শেষ পর্যন্ত সিসিফাসের অনুমতি এলো। সে আবারও ফিরে এলো পৃথিবীতে। সেদিন তার যে আনন্দ, তা কী কোনভাবে প্রকাশ করা সম্ভব? একজন মানুষ মৃত্যুর পরের জগৎ থেকে ফিরে এসেছে আবারও এই নশ্বর কিন্তু সদাপ্রাচুর্যময় সুন্দর ভুবনে। সিসিফাস ভুলেই গেল তার স্ত্রীর কথা, যে নারী তাকে জীবন্ত কবর দিয়ে দিল, তার জন্য আর কান্না নয়। সে মহানন্দে ঘুরে বেড়াতে লাগলো পৃথিবীতে। এদিকে পাতালেও খবর পৌঁছে গেছে। প্লুটোর মনে হচ্ছে সিসিফাস আবারও তাকে বোকা বানিয়েছে। কিছুদিন পরপরই তাকে খবর পাঠানো শুরু হলো, "ফিরে এসো পাতালে। পৃথিবীর জীবন তোমার জন্যে শেষ হয়ে গেছে। সেখানে তোমার আর কোন স্থান নেই। এখন সেই পার্থিব জীবনের উপহারস্বরূপ তোমাকে আরেক জীবন দেয়া হয়েছে। তাকে গ্রহণ করো।"


সিসিফাসের এসব এত্তেলায় কিছু যায় আসলো না। সে তার নিজের সুখে মজে আছে। কে বলেছে যে উপহারস্বরূপ দেয়া জীবন উত্তম? তার কাছে তীব্রসুখের মর্ত্যজীবনই ভালো লাগে। সে এখানেই থাকবে। টারটারাস থেকে ধোঁকাবাজি করে ফিরে আসলাম, হুঁহ, আর এখন কোন প্লুটো এসেছে মাইকিং করতে!


এরকম ঔদ্ধত্যের সাথে উচ্চারণ খুব কম উদাহরণ হিসেবে পাওয়া যায়। তার কারণ সম্ভবত পরবর্তী ফলাফলে এই উদ্ধতাচরণ খুব নৃশংসভাবেই দমন করা হয়। সিসিফাসের পরিণতিও হলো সেরকম কিছুটা। সমন জারি হলো, তার শাস্তি হবে টারটারাসে, যেখানে মারাত্মক পাপীদের নির্বাসন দেয়া হয়। যেহেতু সিসিফাস ইতোমধ্যেই "মৃত", সুতরাং তার মৃত্যুর পরবর্তী বিচার করার কোন ব্যবস্থা নেই! তাই সে কখনোই নির্বানলাভ করবে না। টারটারাসে তাকে অনন্তকাল ধরে একটা পাথর ঠেলে ঠেলে পাহাড়ে তুলতে হবে। তারপরে চূড়ায় পৌঁছানোর পরে সেই পাথরটি আবার গড়িয়ে পড়ে যাবে পাদদেশে। সিসিফাসের কাজ সেটাকে আবারও চূড়ায় তোলা। এই অন্তহীন, অর্থহীন শাস্তিতেই তার পরিণতি!


***


যে কোন গল্পের শেষে আমরা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পছন্দ করি, সহজবোধ করি। "অতঃপর তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করিতে লাগিলো" বা "তাদের এই আত্মত্যাগ চিরঅম্লান হয়ে রইলো", এমন উপসংহারে আমরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। এবং গল্পের নায়ক, নায়িকার সাথে একাত্মবোধের স্থানটিও আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়। কিন্তু এই সিসিফাসের গল্পে তো তেমন কোন পরিণতি নেই। সিসিফাসের মরণ নেই, জীবনও নেই সেইভাবে। শীতল, রুক্ষ্ণ এক পাহাড়ের পিঠে ছড়ে ছড়ে তাকে এক জগদ্দল পাথর ঠেলে ঠেলে তুলতে হচ্ছে। এই একঘেঁয়ে পুনরাবৃত্তিমূলকতায় আমরা কী করে খাপ খেতে পারি? এখন সুমনের মত, বাসস্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে আমি শতশত সিসিফাসের মুখ দেখি। শ্রমবিভাগের কুহকে পড়ে আমরা এক একজন পাথর ঠেলা মানুষ হয়ে গেছি। সীমাবদ্ধ, গতিহীন, মূক, জান্তব, একাকী। নিজের পাথরভার নিজেই বয়ে চলেছি একা একা। এত কষ্টকর যাত্রায় আমাদের খেয়ালও হয় না যে আমাদের আশেপাশে কেউ নেই! যারা আছে, তারাও আমাদের মতোই স্বীয় পাথরের ভারে ন্যূজ।


সিসিফাসের মুখোমুখি হয়ে, আমি অবাক হই যখন পাথরটি চূড়ো থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যেতে থাকে। তখনকার চেহারাটি আমি কল্পনা করতে পারি। সেই মুখের রেখায় কি একফোঁটা হাসিও চোখে পড়ে? টারটারাসে অনেক আঁধার, ঠিক বুঝেও উঠি না আমি। তবে আমি টের পাই, নিজের চরম অ্যাবসার্ড বাস্তবতায় সিসিফাসের মুখ কেন হাসি ফুটে ওঠে। আমাদের জীবন এতটাই নিরর্থক যে সেখানে নিজের অস্তিত্ব নিয়ে আমরা খুব বেশিই মগ্ন। জীবনের গূঢ় অর্থ বুঝে ওঠার জন্য আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা, পাথর ঠেলার মতোই। আবার সকল চেষ্টার পরিণতিও আমরা জানি, জানি যে সকল উত্তোরণও এক পলকেই প্রবল পতনের সাথে সাথে আমাদেরকে শুরুতে নিয়ে যাবে। সব অনুসন্ধানেই আমাদের এই প্রয়াস মৌলিকভাবে ব্যর্থ হবে।


তাহলেই কেন এই জীবনযাপন? এই কষ্টকর, ক্লান্তিকর, অর্থহীন বয়ে চলা কি কেবল পরকালের লোভেই? সেই নিশ্চিন্তিই বা আমরা কোথায় পাবো? যদি তা অবশ্যম্ভাবীই হবে, তাহলে এত বিভ্রান্তি কেন?


সিসিফাস তো খুব সহজেই পারত আত্মহত্যা করতে। এমন পাশবিক শাস্তিপালনের চাইতে, নিজের জীবন শেষ করে দেয়াটাই তো বুদ্ধিমানের কাজ হতো, তাই না? এই প্রশ্নের জবাবও আমি পেয়ে যাইঃ হতো না। অ্যাবসার্ড অপশন বলে একটা ব্যাপার আছে। সেখানে আমাদের নিরর্থক জীবনের জন্য আমরা তিনটা আলাদা পথ পেতে পারি। এক. আত্মহত্যা, দুই. নিজের চেয়ে বৃহত্তর কোন শক্তির কাছে আত্মসমর্পণ, তিন. নিজের বাস্তবতার মাঝে অর্থ ফুটিয়ে তোলার নিরন্তর প্রয়াস।


সিসিফাস প্রথম দুটি পথকে খুব অবলীলায় ত্যাগ করেছে, অনেকটা তাচ্ছিল্যভরেই। দেবতাদের অনুগ্রহ, ক্ষমা কোনটাই সে নিজের জন্য প্রার্থনা করেনি। বরং এই অমানবিক শাস্তি, এই অপরিমেয় জীবনকে পাথেয় করে নিয়েছে। শীতল পাতালের অন্ধকারে সিসিফাস পাথর ঠেলছে। তার চোয়াল শক্ত, পেশী দৃঢ়, এবং আলোহীনতায়ও আমার চোখে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয় তার ঘামে ভেজা মুখ! আমি বুঝে যাই সিসিফাসের অর্থ। আমার মুখেও তখন তেমনই এক হাসি ফুটে ওঠে কি?




****

বৃহস্পতিবার, ৯ জুলাই, ২০০৯

মীথবাজিঃ সিসিফাস ১

থানাটোসের ঘুম ভেঙেছে সেই ভোরে। সকালে দাঁত মাজতে মাজতে সে দেয়ালে সেঁটে রাখা লিস্টি দেখছিল। মুখ ভর্তি ফেনা থু করে ফেলে দিয়ে কুলি করতে করতে সে শিডিউল মিলিয়ে নেয়। সকালে কয়েকজনের আত্মা তুলে রাখতে হবে। এটা তেমন কোন ব্যাপার না, সকালে সবাই গভীর ঘুমে ডুবে থাকে। খুব সহজেই কাজ সারা যায়। বেলা বাড়লে ঝামেলার শুরু হয়, জান কবচ কি খেলা কথা?! কাজ শুরু করে থানাটোস বেশ অনায়াসের পাঁচ ছয়টা জান কবচ করে ফেললো বেশ তাড়াতাড়ি। এপোলোকে ধন্যবাদ, আজ দিনটা খুবই পয়মন্ত মনে হচ্ছে!


কিন্তু বিধি বাম। একটু পরে হঠাৎই জরুরি তলব পড়লো জিউসের দরবার প্যান্থিওনে। “এই সেরেছে! আবার কি ঘটলো?” ভড়কে গিয়ে ভাবে সে। যে মানুষটার বাসায় গিয়েছিল, তাকে কবচ না করেই ফিরে এল। ব্যাটা আরো কিছুসময় শ্বাস নিক, পরে দেখা যাবে। প্যান্থিওনে পৌঁছে দেখে জিউস দরবারে মাথা নিচু করে বসে আছেন। পুরো দরবার থমথমে।


ঢোকার মুখে কয়েকজন ফিসফাস করছিল, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে। ভেতরে ঢোকার সাহস হচ্ছে না তাদের, ঘটনা গুরুতর! থানাটোস সেখানেই আগে থামল, ঘটনা না বুঝে জিউসের মুখোমুখি হওয়া ঠিক হবে না। যা শুনলো তাতে সে হাসবে না কাঁদবে ঠিক বুঝে উঠতে পারলো না। বেচারা জিউস! এতকিছু ঘটলো তাও স্বভাব বদলালো না হুজুরের।


জিউসের অনেক অভ্যাসের মাঝে নারীপ্রীতি ছিল একটা। হঠাৎ করেই জলাপ্সরা দেখলেই কাজকর্ম ফেলে পেছন পেছন রওনা দেন। এসব নিয়ে হেরার সাথে ঝগড়াঝাঁটিও মাঝে মাঝেই ঘটে। ইদানিং শোনা যাচ্ছিল তার এজিনার সাথে বেশ ঘনিষ্ঠতা। এখন থানাটোস বুঝতে পারলো যা রটে, তার কিছুটা ঘটেও বটে! হয়েছে কি, জিউস কিছুদিন ধরেই এজিনা’কে পটাচ্ছে, আর এজিনাও সুযোগ বুঝে লাস্যময় হাস্য দিয়ে তাকে মজিয়ে রাখছে। কিন্তু এজিনার বাবা এসোপাসের এসব পছন্দ হয়নি। একদিন ধরতে পেরে জিউসকে তাড়া লাগিয়েছেন, পুরো দ্বীপ দাবড়ে ভাগিয়ে দিয়েছেন। জিউসেরও মাথা গরম, এজিনাকে উঠিয়ে নিয়ে অ্যাটিকার একটা দ্বীপে লুকিয়ে রেখেছিলেন। তা বাবা, উড়িয়ে নিবি ভালো কথা, একটু বুঝে শুনে করবি তো, নাকি? সারা দুনিয়াকে দেখানোর কীইবা দরকার ছিল?


এদিকে এসোপাস মেয়ের শোকে খোঁজে বেরিয়েছিলেন। পথে কোরিন্থ রাজ্যে দেখা হলো সিসিফাসের সাথে। সিসিফাস সেখানকার রাজা। তাঁর মত বুদ্ধিমান এবং ধুরন্ধর রাজা খুব কমই ছিলেন সেসময়ে। তাবড় তাবড় দেবতারাও তাকে ডরাইতো! এসোপাস তাঁর কাছে ঘটনা বলা শেষ করেছেন কি করেননি, সিসিফাস বলে উঠলেন, “আরে! আমি তো দেখলাম সেদিন একটা ঈগল নখে করে এজিনাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে অ্যাটিকার দিকে! নিশ্চয়ই ওটা জিউসই ছিল!”
এসোপাসের চেহারা রাগে অগ্নিমূর্তি ধারণ করলো, “বদমায়েশটাকে যদি আমি শিক্ষা না দিছি!”
সিসিফাস বললেন, “আঙ্কেল, দাঁড়ান। হুট করে এত রেগে গেলে তো বিপদ। বুঝেশুনে প্ল্যান করতে হবে, লোকটা জিউস।”


তারপরের কাহিনী পুরো জানা যায়নি, একটা নিঃশ্বাস ফেলে জানালো বক্তা। তবে থানাটোস শিওর যে নিজেকে বাঁচাতেই ব্যাটা সবকিছু বললো না। সেই জিউস ফিরে এসেছেন, এখন মাথা নিচু করে থম মেরে বসে আছেন দরবারে আর থানাটোসকে ডেকে পাঠিয়েছেন। সে ভিতরে ঢুকে কুর্নিশ করে দাড়ানোর পরে জিউস বলে উঠলেন, “থানাটোস! তোমাকে আমি খুবই পছন্দ করি। মর্ত্যের মানুষের জান-কবচের কাজ তুমি খুব নিষ্ঠার সাথে করছো।”
থানাটোস একটা বিগলিত বোকা বোকা হাসি দিল। “থ্যাঙ্কু জিউস!”
“হুম”, গম্ভীর হয়ে বললেন জিউস, “এখন একটা অন্য কাজে তোমাকে ডেকেছি। সিসিফাস নামের এক রাজা আছে কোরিন্থ রাজ্যে। তার উদ্ধত আচরণ আমার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তোমাকে একটা বিশেষ কাজ করতে হবে।”
থানাটোস বিগলিত হেসে বললো, “সিসিফাসের জান কবচ করতে হবে তো? কোন ব্যাপার না বস্‌!”
“থামো থামো। আগেই লাফ মেরে কথা বলো না।”, জিউস একটু বিরক্ত হলেন, এদেরকে একটু লাই দিলেই কথার মাঝখানে কথা বলে! “জান-কবচ করলে তো মামলা চুকেই গেল। তারপরে সে চলে যাবে প্লুটোর ডিপার্টমেন্টে, পাতালে। আমি চাই সিসিফাসকে আরো বড় শাস্তি দিতে।”, একটু থামলেন জিউস দম নেয়ার জন্য। তারপরে বললেন, “সিসিফাসকে টারটারাসে ফেলে দেয়া হউক। ওখানে তাকে শেকল দিয়ে বেঁধে রাখা হবে।”
দরবারের সবাই জিউসের কথা শুনে শিউরে উঠলো! টারটারাস পাতালেরও নিচে এক ভীষণ অন্ধকার আর ভয়ানক স্থান। সেখানে চিরশীতল অন্ধকার তাল তাল বরফের মত জমে থাকে। প্লুটো তো তবুও পাতাল দেখাশোনা করেন, টারটারাসে কেউই তদারকির দায়িত্বে নেই। কে যাবে ওখানে! সব ভয়ঙ্কর পাপীদের আখড়া।


কোন দুর্মুখ একটু সাহস করে বলে বসেছে, “কিন্তু এমন কী করলেন সিসিফাস, যে তাকে একেবারে টারটারাসেই…”
প্রশ্ন শেষ হবার আগেই জিউস পাঁই করে তার দিকে ঘুরে গেলেন। তার তীব্র দৃষ্টির সামনে প্রশ্নকর্তা আমতা আমতা করে চুপ হয়ে গেলেন।
“সে খুবই অন্যায় কাজ করছে পৃথিবীতে। আমার কাছে অভিযোগ এসেছে, সে এজিনাকে ধরে নিয়ে আটকে রেখেছিল। তা ছাড়াও সময়ে সময়ে সে অনেক দেবতারই গোপন কথা ফাঁস করে দিয়েছে। এমন ধুরন্ধর আর উদ্ধত বেয়াদবকে শাস্তি দেয়ার সময় চলে এসেছে। থানাটোস!”
–”জ্বি, জিউস।”
“এই নাও শিকল”, বলে জিউস একগোছা শেকল ছুঁড়ে দিলেন, “এখুনি গিয়ে সিসিফাসকে আটকে ফেলো টারটারাসে।”


শেকলের গোছাটা গুছিয়ে নিয়ে থানাটোস বেরিয়ে আসে। এখনই পৃথিবীতে ফিরতে হবে। বেলা প্রায় দুপুর এখন।


কোরিন্থে গিয়ে সিসিফাসকে পাকড়াও করতে থানাটোসের খুব একটা বেগ পোহাতে হলো না। সিসিফাস খুব সহজেই ধরা দিলেন। মনে মনে থানাটোস ভাবলো, “জিউস এই পাবলিকের কাছে কেমন করে ধরা খেল? মেয়ে মানুষের সঙ্গে থেকে থেকে জিউসের বুদ্ধিশুদ্ধি আসলেই গেছে!” সিসিফাসকে জাপটে ধরে একটানে পাতাল পেরিয়ে এলো থানাটোস, পরের স্টপেজেই টারটারাস। সেখানের ঠাণ্ডা বাতাসে তার নিজেরই হাড়ে কাঁপন ধরছে। তাড়াতাড়ি সিসিফাসকে বেঁধে রেখে ফিরতে হবে। “এর চেয়ে জান-কবচ কতো সোজা!”, একটা নিঃশ্বাস ফেলে ভাবে থানাটোস, “ধরো তক্তা, মারো পেরেক! ঝামেলাবিহীন।”


টারটারাসের পরিবেশে সবকিছুই পাথুরে, পাহাড়ি। গাছপালা বা নরম মাটির কোন চিহ্নই নেই। পাথরগুলোও অসম্ভব রুক্ষ্ণ। হাঁটতে গিয়ে থানাটোসের নিজেরই পায়ে ব্যথা লাগছে। সিসিফাসের অবশ্য এদিকে টুঁ শব্দও নেই। “ঘটনা কী?”, ভাবে থানাটোস, “লোকটার কি কোন অনুভূতিই নেই নাকি?”


–”এই যে সিসিফাস!”, গলা খাঁকারি দিয়ে হাঁকে থানাটোস, “এখানে, এইখানে! এই পাথরের সাথে আপনাকে বেঁধে রাখা হবে। জিউসের নির্দেশ।”


এতক্ষণে সিসিফাস মুখ খোলে, “কেন? আমি কী করেছি? আমাকে কেন এই শাস্তি দেয়া হলো!! আমার তো কোন বিচারও হলো না!”


–”আমি কিছু জানি না। আমাকে যা নির্দেশ দেয়া হয়েছে, আমি সেটাই করছি। হাইকমান্ড!”


“তা বলে আমি একবার আত্মপক্ষ সমর্থনও করতে পারবো না? আজব! প্লুটো কোথায়?”- সিসিফাস এদিকে ওদিকে তাকায়।


–”এটা প্লুটোর এরিয়া না। টারটারাসে প্লুটোর কোন জুরিসডিকশন নাই।” , থানাটোস বলে, “আপনি যা করেছেন তার জন্য আপনাকে মৃত্যুর অধিক শাস্তি দেয়া হয়েছে। এখানে টারটারাসে আপনাকে শেকলবন্দী করে রাখা হবে অনন্তকাল!”


“হায়!!” কাতর কণ্ঠে বলে ওঠে সিসিফাস, “এ কেমন বিচার! আমার দোষ প্রমাণের আগেই শাস্তি হয়ে গেল?”, ডুকরে কেঁদে ওঠে সে।
সিসিফাসের আর্তনাদে টারটারাসের শীতলতার জমাট বরফ ভেঙে যেতে থাকে। “অনন্তকাল! আমার এমন কী অপরাধ যার জন্য এই শাস্তি হলো? আমি তো কারো ক্ষতিই করিনি। কারো জীবননাশ করিনি! তাহলে কেনই-বা আমার এমন কঠোরতম শাস্তি! কেন? কেন?”


সিসিফাসের আহাজারিতে থানটোস ভীষণ বিপাকে পড়ে গেল। কী মুশকিল! এতক্ষণ ভাবছিল সিসিফাসই দোষী, এখন তার কান্নাকাটি দেখে তো মনে হচ্ছে কোথাও কোন গড়বড় আছে। থানাটোস আবার বেশি চিন্তাভাবনা করতে পারে না, মাথা ভার ভার লাগে। তাই সে তাড়াহুড়া করলো, “আমি অতশত জানি না। আপনি এই পাথরে বাঁধা শেকলটা গলায় পেঁচিয়ে নেন। তাড়াতাড়ি!”


সিসিফাস কান্না-জড়ানো স্বরে বলেন, “কোথায়?”


–”এই তো এখানেই। দেখতে পাচ্ছেন না?” অস্থির হয় থানাটোস।


“নাহ! এত অন্ধকার! আমি কিছুই দেখতে পাচ্ছি না।” হতাশ স্বরে বলেন সিসিফাস।


থানাটোস শেষমেশ সিসিফাসের হাত ধরে শেকলটা ধরিয়ে দিলো। “এই যে শেকল, এখন তাড়াতাড়ি গলায় বেঁধে ফেলেন।”


“কিন্তু এই শেকল এত ভারি! এটা আমি কীভাবে গলায় বাঁধবো? আমি যে পারি না!”


–”আচ্ছা মুশকিল হলো দেখি! এখন কি এটাও আমাকে দেখিয়ে দিতে হবে নাকি?”, রাগত স্বরে বলে ওঠে থানাটোস।


“প্লিজ! যদি আপনি একটু দেখিয়ে দিতেন, তাহলে খুব খুব উপকার হতো। আমার জীবন তো এমনিতেই শেষ। এই টারটারাসের অন্ধকারেই মাথা খুঁড়ে মরতে হবে। অন্তত শেকলটা ঠিকমত পরে নেয়া দরকার”, সিসিফাসের কাতর কণ্ঠের পেছনে যে সূক্ষ্ণ পরিহাস, তা থানাটোসের নজরে পড়ে না।


“আচ্ছা ঠিকাছে। আমি দেখাচ্ছি”, বলে থানাটোস ভারি শেকলের একপ্রান্ত হাতে তুলে নেয়, “এই দেখেন। এভাবে এক পাক, তারপরে উল্টোদিকে আরেক পাক। এভাবে।” বলে সেই শিকলটা পরে নেয় সে, “এইবার বুঝলেন?”


অন্ধকারে ঘটাং করে একটা শব্দ হলো। থানাটোস ঠিক বুঝে পেলো না ঠিক কোত্থেকে কী হয়ে গেল। কিন্তু হঠাৎ করেই সে শেকলের ভারে হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল। সাথে সাথে সিসিফাসের অট্টহাসি শোনা গেল অন্ধকার টারটারাস জুড়ে। শীতল পাতালেরও অধিক পাতালে, থানাটোস সহসাই বুঝতে পারলো কী হয়েছে। শেকলটা খুলে আনার জন্য যে কড়াটি দিয়ে ঠেস দিয়ে রেখেছিল সে, সিসিফাস এইমাত্র সেটা খুলে নিয়েছে। আর সে পাথরের সাথে শেকলবন্দী হয়ে গেছে!


“অর্বাচীন দেবতা!” হিসহিসিয়ে ওঠে সিসিফাস, “তোমাদের হুজুরের দোষ আমার ঘাড়ে চাপাতে চাইছো? তোমরা মর্ত্যে যা ইচ্ছা তাই করে বেড়াবে, আর সেজন্যে ভুগবো আমরা! ভেবেছো কি? নির্বোধ অক্ষম মানব, তোমাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কীইবা করতে পারবে!”


একটানে থানাটোসের রথে লাফিয়ে উঠলো সিসিফাস। তারপরে সাঁ সাঁ করে ছুটে যেতে লাগলো পৃথিবীর দিকে। তাঁর মুখে তখন ফুটে উঠছে বিজয়ের চতুর হাসি!


~*~*~*~*~*~
পরিশিষ্টঃ থানাটোসের অকস্মাৎ অন্তর্ধানে পৃথিবীতে জান-কবচের জন্য কেউ রইলো না। বেশ কিছুদিন ধরে মুমূর্ষু রোগীগুলোও কীভাবে জানি বেঁচেই রইলো। মর্ত্যবাসী অবশ্য এটাকে বিধাতার অসীম কৃপা ভেবে আরো বেশি প্রার্থনায় মশগুল হয়ে উঠলো। সেই খবর প্যান্থিওনে পৌঁছানোর পরেই সকলের টনক নড়লো, আসলেই তো! থানাটোস কোন চুলোয় গিয়ে মরেছে! জিউস অবশেষে খুনে জাঁদরেল অ্যারিসকেই পাঠালেন থানাটোসকে সেই টারটারাস থেকে ছাড়িয়ে আনতে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সিসিফাসকে শেষপর্যন্ত সেই টারটারাসেই এক কালজয়ী মীথের জন্ম দিয়ে নির্বাসিত হতে হয়েছিল। কিন্তু সে আরেক গল্প, আজকে বরং এখানেই থাক?
(ক্রমশ...)

মঙ্গলবার, ৭ জুলাই, ২০০৯

মুরতাজা বিষয়ক সিদ্ধান্ত

সন্ধ্যা নেমে আসার একটু আগে থেকেই, মুরতাজা বার বার পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল বের করে আনার অনুশীলন করতে থাকে। ডান হাতের সয়ংক্রিয় চলনে, পকেটের দু’পাশের দুই লাইন সেলাই ঘষা খায়, সেখানে হাতের অদৃশ্য ধুলো আর ঘাম মিশে মিশে কালচে-খয়েরি দাগ পড়তে থাকে। মুরতাজার সেদিকে খেয়াল থাকে না, বলাই বাহুল্য। পকেটে হাত দিয়ে মোবাইলের ধাতব শরীর স্পর্শ করে, কিছুটা উল্টে পাল্টে দেখে হাত বের করে আনে সে। এই অস্বাভাবিক মুদ্রাদোষের কারণ আমাদের অজানা, পুরনো কোন ঘটনা, অভিজ্ঞতা বা স্মৃতি হতে পারে; ঠিক সন্ধ্যার আগে আগে এমন অস্থিরতা কী করে তার যাপনবিদ্যায় ঢুকে গেছে, সেটা জানার কৌতূহলটাকে আমি ভক্‌ করে উঠে আসা বমির প্রথম ঢেউয়ের মতই চাপার চেষ্টা করি। মুরতাজা এবং তার মোবাইলের মাঝে মিলন ঘটে না- অন্তত প্রকাশ্যে, পকেটের বাইরে নয়; অবশ্যই। সে বিষয়ে এমন নিশ্চিত হতে পারা যায়, আমার জবান সেখানে নিরাপদ ও গ্রহণযোগ্য, কারণ আমি মুরতাজার কাছে বিকেলে আসি। তারপরে বসে থাকি তার পাশে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত অবধি। এ’সময়ের অস্থির পাখির মতই ঘরে ফেরার তাড়া কি সে বোধ করে? আমি জানি না।


ঘরে ফেরার তাড়ার সাথে আমি অপরিচিত। কথাটা ঠিক হলো না। যার ঘর আছে, সেই ব্যক্তিমাত্রই ঘরে ফিরে যাবার জন্য সদা উৎসুক, উন্মুখ। আমার জন্যে তার ব্যতিক্রম হবে কেন? অথবা মুরতাজার জন্যে? মুরতাজার ঘর কোথায় তাও আমার জানা নেই। কোন ক্রিয়ার আগ্রহের মাত্রা একটা সীমার বাইরে না গেলে, আমরা সাধারণত সেটা ঘটাই না। এই নিয়ম শুনে শুনে আমি প্রতিদিনই, নিজের কৌতূহল নিবৃত করি। মুরতাজাকে আমার প্রশ্ন করা হয় না, তার সাথে ব্যক্তিগত হয়ে ওঠা হয় না। প্রশ্নগুলো গভীর পানিতে জন্মানো বুদবুদের মত উঠে আসতে চায়। তবে সেই ক্রিয়াশীলতার সূত্রের জলজ আগাছায় আটকে যায় বলে, আমার প্রশ্ন করা হয় না। মুরতাজার ডান হাত, আমার না-করে-ফেলা প্রশ্ন সম্বন্ধে পুরোপুরি অজ্ঞাত থেকেই নিষ্পাপ ভঙ্গিতে, পকেটের বুঁজে থাকা দুই ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে দ্রুত চলাচল করে।


জায়গা’টা ডাক্তারের চেম্বার। ডা. সুলায়মান শিকদার (কতিপয় ডিগ্রি, লণ্ডন, সাইপ্রাস ইত্যাদি) এখানে বিকেল চারটা থেকে রাত নয়টা অবধি বসেন। তার বিশেষত্ব তিনি নাক, কান ও গলার ডাক্তার, বৈশিষ্ট্য তিনি একজন সময়হীন চামার। আমি তার মুখ-বাঁধা ড্রাইভার। বিকেলে তার কিশোর ছেলেটিকে কোচিং থেকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে, আমি ধানমণ্ডির আটে এসে বসে থাকি। গাড়ির ভিতরের ক্রমোষ্ণ গুমোট ছেড়ে আমি চেম্বারের লবিতে সময়টুকু কাটাই। ছ’টা থেকে ন’টা। সন্ধ্যা থেকে রাত। তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে, আমি হেঁটে হেঁটে ঘরে ফিরি। ঘর। ঘরে অনেকেই আমার অপেক্ষায় থাকে বা থাকে না। সেটাও তেমন জরুরি না, যেমন জরুরি না মুরতাজা বা সুলায়মান শিকদারের ঘরেও কেউ কেউ অপেক্ষায় থাকে সেই বিষয়টা। সকলের ঘরেই কেউ না কেউ অপেক্ষা করে, এবং সেটা মোটেই আমাদের মনোযোগের বিষয় হতে পারে না। আমি তাই চোখ কুঁচকে মুরতাজার দিকে তাকিয়ে থাকি।


মুরতাজা এই চেম্বারের কম্পাউণ্ডার। ডাক্তারের চেম্বারের দরজার বাইরে তার ডিসপেন্সারি। রোগকাতর, কান-নাক-গলাজুড়ে কীটের অত্যাচারে যারা নাজেহাল, সোলায়মানের কাছে ভিজিট দিয়ে ও পথ্য নিয়ে যারা খানিক নিঃস্ব, তাদেরকে নিঃস্বতর করতেই মুরতাজা বসে থাকে। গুনে গুনে পাতার পর পাতা ওষুধ দিয়ে সে টাকাগুলো গুছিয়ে রাখে। আমি সেটা খেয়াল করে দেখি। রোগী চলে গেলেও আমি তার দিকে তাকিয়ে থাকি অস্বস্তিদায়ক স্বস্তিতে। চেম্বারের দেয়ালে, তেমন কোন আকর্ষণীয় ছবি, পোস্টার, ক্যালেন্ডার নেই। অথবা প্রথম আসার পরে হয়ত সেগুলোকে আকর্ষণীয়ই লাগে, আমি রোজ রোজ চোখের জিহ্বায় চেটে চেটে সেগুলোকে ছিবড়ে করে ফেলেছি। আমার কাছে সেগুলো এখন বিবর্ণ ও পুরাতন। তাই ঘুরে ফিরে আমি মুরতাজার দিকেই তাকিয়ে থাকি। রোগী হিসেবে কোন যুবতী এলে আমার মনোযোগ তাদের দিকে যায়। তারা চলে গেলে পুরনো মুরতাজা, এবং সন্ধ্যার আগে আগে, তার ডান হাতের ক্রিয়াকলাপ আমাকে বেশ কৌতূহলী করে তোলে।


মাঝে মাঝে তার এবং আমার মাঝে তরল থেকে কঠিন হতে থাকা নীরবতা ও বাক্যহীনতা কাটিয়ে আমরা অর্থহীন শব্দ উচ্চারণ করি। সেগুলো না বললেও চলে, শামুকের মত পড়ে থাকতে আমার সমস্যা নেই, ড্রাইভারির অবশ্য-পালনীয় অভ্যাস। তবে মুরতাজার হয়তো ভালো লাগে না, তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সে কথা চালাচালি শুরু করে। শুরুতে ঠুক-ঠাক, ভাববাচ্যেঃ


“কি খবর?”
–”এই তো, চলে।”
“কেমন চলে?”
–”আ-র চলা! যাইতেছে একরকম।”
“আছো সুখে”
মুরতাজা আপন হতে চায়; অথবা মুরতাজা প্রভুসুলভ মুরুব্বি হতে চায়। কোনটা সেটা নিয়ে আমার দ্বিধা কাটে না। তাই আমি আবার নীরব হই। একটু ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থাকি। ‘কেমন চলে’- এই প্রশ্নে আমার গতিসম্পর্কীয় উল্লেখ মুরতাজার বোঝা উচিত ছিল। অথচ তার পরপরই ‘আমি সুখে আছি’- এই সিদ্ধান্তে সে কী করে গেল সেটাই বিস্ময়ের। আমি যে সুখে নাই সেটা প্রমাণ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। বা, মুরতাজা ভাবছে আমি সুখে আছি আর সেটা ভেবে ভেবে ওর খারাপ লাগছে, ও দুঃখ পাচ্ছে, এই চিন্তাটা আমাকে খুশি করে দেয়। তুমি সম্বোধনে নেমে আসার, আপন হবার বা মুরুব্বি বনে যাবার প্রচেষ্টায় ‘মুরতাজার উপরে শোধ নেয়া গেছে’, এই খুশিভাবকে কি সুখ বলা যায়? আমি মুরতাজার কাছে কৃতজ্ঞবোধ করি।


“কী গরম পড়ছে দেখছ!”
– “হ”
“কয়দিন বৃষ্টি হইল, এখন আবার গরম। কী যে হইতেছে বুজতেছি না। বিরাট গ্যাঞ্জাম!”
– “আপনার মুবাইল বাজে?”


আমার কথাটা নির্ভেজাল প্রশ্ন ছিল। বুদবুদগুলো কোন এক ফাঁকে সট্‌কে পড়েছে। তাদের মধ্যে একটা সব আগাছা পাড়ি দিয়ে উপরে এসে ঠাশ করে ফেটেছে। সে শব্দ, আমাদের অর্থহীন কথোপকথনের মাঝে অতিকায় ঝুলন্ত সেতু হয়ে ঝুলতে থাকে। মুরতাজা ইতস্তত কেঁপে ওঠে। সে সম্ভবত এখনও শহরে খাপ খায়নি। আমি ওর মুখে সাঁকোর কাঁপন দেখি, লম্বা বাঁশের গোড়ার পানির মতই ঢেউ মুরতাজার চেহারায় ভুস ভুস ভেসে ওঠে।


– “কি। বাজতেছে নাকি?”
এবারে আমি একটু সরব হই, সপ্রতিভ হই। কৌতূহলী বিড়ালের বাড় বেড়ে গছে। মুরতাজার নীরবতা আমাকে উৎসুক করে। গুজব। গল্প। পাতা উল্টানোর মত মানুষের জীবন। গন্ধ। আমি প্লাস্টিকের কষ্টকর চেয়ারে সোজা হয়ে বসি; বিড়ালের মতোই, সতর্ক। মুরতাজা ঘাম মোছে; সাঁকো স্থির হয়।


“না, মুবাইল বাজে না। এমনেই দেখতেছিলাম।”
–”বাইর না কইরা বুঝেন কেমনে? সাইলেন করা নাকি?”
“না। বাজলে আওয়াজ-ঐ হইত।”
–”তাইলে? মুবাইল তো বাইরও করেন না। কাউরে কল্‌ করবেন নাকি ওস্তাদ?”


ওস্তাদ! হায়! আমি হাসি পেয়ে যায়। গল্পের লোভে আমাকে এই এরকম সাঁকোর মত পল্‌কা মুরতাজাকেও ওস্তাদ বলতে হচ্ছে! মুরতাজা মুখ খোলে না। তাকে বাঁচিয়ে দেয়ার জন্যেই সোলায়মান বেরিয়ে আসে। ডাক্তারি শেষ, রোগী নেই, সাড়ে নয়টা বাজে। আমি তড়াক করে উঠে যাই। দৌড়ে গাড়ি; প্যাডেল; রিয়ার-ভিউ মিরর; হর্ণ; স্টিয়ারিং; ব্রেক। সুলায়মানের বাসা। কালকে সকালে পুরনো সময়ে আসতে হবে বলে সুলায়মান উঠে যায় সিঁড়ি দিয়ে। আমি গাড়ি গ্যারেজে ভরে তালা দেই। চাবি জমা দিয়ে ফিরে চলি ঘরে, হেঁটে হেঁটে। ঘর। আমার মাথায় মুরতাজা গিজগিজ করে। মুরতাজার ডান হাত আর কম্পমান সাঁকোর মত মুখ নির্বিবাদে ঝুলে থাকে।



গাড়ি চালানোর সময়ে মাথায় অনেক অনেক চিন্তা ঘুরতেই থাকে, চাকার সাথে সমদ্রুতিতে। স্টিয়ারিঙের টানে একেকটা বাঁকে আমার চিন্তাগুলো আটকা পড়ে যায়, আবার আটকাবস্থা থেকে ছুটেও যায়। আমি মুরতাজাকে নিয়ে ভাবি, মুরতাজার মোবাইল আমার মগজে, হাতে, মুখে বিঁধে ভাইব্রেট করতে থাকে।
‘কল করতে গিয়েও কেন কেউ দ্বিধায় পড়বে? কেন বারবার মোবাইল বের করতে গিয়েও থেমে যাবে এবং সাঁকোর মত কাঁপতে থাকবে?’
বিড়ালের মত আমার চিন্তা সচল হয়। মুরতাজা বিবাহিত, কারণ এই বয়স পর্যন্ত কেউ অবিবাহিত থাকে না। ঘরে ফেরার জন্য ন’টা পেরোলেই তার সঘন ঘড়ি দেখা সেটাকেই সমর্থন করে। বিবাহিতের সন্ধ্যা অস্থির হয়ে ওঠার কোন সূত্র আছে কি না আমি জানি না। গাড়িটা দুপুরের রোদে মগবাজারের জ্যামে ঠেলে দিয়ে আমি ভাবনায় মুখ গুঁজে দেই। পেছনে সোলায়মানের বউ, ভিতরে এসি। শীতল শান্তি। পেছনের কোথাও তাড়াতাড়ি পৌঁছানোর দরকার, অহেতুক জ্যামে তাই সে অস্থির। আমার কোথাও যাবার তাড়া নেই।


মুরতাজার বউ কেমন? সে নিজে কিছুটা হ্যাংলাটে, সাড়ে পাঁচের উপরে উঠেছে কি ওঠেনি। শুকনো ও মচমচে পাঁপড়ের মত শরীর। তার বউ নিশ্চয়ই মোটা। থলথলে শ্যামল। মুরতাজা কত পরিশ্রম করে, কিংবা কতটা হাঁপিয়ে ওঠে? শুকনো মানুষের ক্ষিদে বেশি হয় বলেই জানি। তাহলে তার বউ কেমন হবে।- এসব বিশৃঙ্খল সুড়সুড়ে চিন্তার জট লেগে যায় ভ্যান আর রিকশার মত। হ্যাঁ, মুরতাজার বউ একটু মোটা হলেই ভালো। গমন আরামের, সেরকম শরীরে খাঁইও বেশি। ‘মুরতাজা তো সারাদিন বসেই থাকে টুলের ওপর, আমার মত গাড়ি চালাইলে বুঝতো- কাহিল কারে কয়!’ এই সবের পরে কি রাত জাগতে ভাল লাগে? লাগে না। মুরতাজা ওষুধ বেচে আর নয়টার পরে বাসায় ফিরে মোটা বউয়ের কাছে। সারাদিন মুরতাজার বউ একা একা থাকে। কী করে? জ্যাম ছুটে যাচ্ছে মগবাজারের, আমার হাত সচল হয়। মুরতাজা ও তার বউ আমার সাথে বাঁক ঘুরে যায়। তার বাসা যেই গলিতে, সেই গলির মতই একটা গলিতে আমি ঢুকে পড়ি মেইনরোড ছেড়ে। এখানে ঘিঞ্জি বাসা, গাড়ি ছাড়াই চলাচলে সুবিধা। আবারও আটকে যাই। সন্ধ্যাবেলা মুরতাজা অস্থির হয়ে ওঠে, তিরতির করে সেই অস্থিরতা আমার মাঝেও কিছুটা ছড়িয়ে যায় এখন। মুরতাজার বউ সারাদিন বাসায় একা একা থাকে। শ্যামলা বউয়ের জন্য সারাদিন ওষুধ বেচার ফাঁকে ফাঁকে মুরতাজার কেমন লাগে?


দুপুরের রোদের ঝাঁজ মাথায় নিয়ে সেই গলিতে আমি সোলায়মানের বউয়ের জন্য অপেক্ষা করি। তার কাজ শেষ হওয়ার পরে, আবারও মগবাজার মোড় ঠেলে বাসায় পৌঁছে দিই। বাসাতেই খাওয়ার ব্যবস্থা, আমি খেতে বসে মুরতাজার কথা ভাবি। দুপুরে মুরতাজা একটা টিফিন বক্সে করে খায়। হলুদ রঙের বক্সের গায়ে, তরকারিতে দেয়া আরো গাঢ় হলুদের দাগ লেগে থাকে। ঐ দাগের মধ্যে মুরতাজার বউয়ের গন্ধ পাই। শ্যামল হলুদ ও মোটা। নাহ, ভাতের মাখানো লোকমা মুখে পুরে আমি চিবাতে চিবাতে মুরতাজার খাওয়া কল্পনা করি। হলুদ টিফিন বক্সধারী মুরতাজা তার বউ নিয়ে এত চিন্তিত নয়। এরকম সিদ্ধান্ত ও অনুসিদ্ধান্তে দুলতে দুলতে আমি গাড়িতে ফিরি। সোলায়মান-পুত্রের কোচিং, তারপরে আবারও চেম্বার। চেম্বারে পুরনো অস্থির মুরতাজা।


ঢুকে যে হাসিটা আমি মুখে ঝুলিয়ে রাখলাম, সেটা দেখে মুরতাজা কিছুটা নরম হলো। হাসি সংক্রামক, এবং সর্বত্র ক্রিয়াশীল।
–”কী খবর, মিয়া?” আমি কিছুটা ভান ধরি।
“এই চলতেছে” মুরতাজা গতকালকের আমি’র মত নির্লিপ্ত।
–”আপনের মুবাইল বাজে না?” বলে আমি ‘হে হে হে’ করে বিরক্তিকর ঠ্যাস দেয়া হাসি দেই। দাঁতের সহাস্য প্রকাশ মুরতাজার ভালো লাগে বা লাগে না, তার ডানহাত অনায়াসে পকেটে ঢুকে যায়। মোবাইলের শরীর ধরে বের করে সে আমাদের সামনের টেবিলে রাখে।
“সন্দ্যা হইলে মাঝে মাঝে চেক করতে হয়। একটা কল করতে ইচ্ছা হয়।”
–”কারে?”, আমি গলা তিন ধাপ নামিয়ে ফেলি।
“কাউরে না”
–”ধুর মিয়া, বলেন দি।”
“কইলাম তো কাউরে না।” মুরতাজার স্বরে বিপন্নতা।
–”এসব কইলে হবে? বলেন না, রোজ দেখি আপনে সন্দ্যা আইলেই ব্যস্ত হইয়া পড়েন।”
মুরতাজার নীরবতায় আমি অসহিষ্ণু হয়ে উঠি, “ভাবিসাব’রে ফোন করবার চান নাকি?”
মুরতাজা চমকে বলে, “না, তারে ক্যান করুম?”
– “তাইলে!”, আমি ঝেড়ে ফেলে দিলাম দুপুরের জটালো-চিন্তাটা।


মুরতাজার মুখে কথা এসেও, এক টুকরা হাসির আড়ালে ভেসে যায়। মুখ বাঁকা করে হেসে দিয়ে সে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। সোলায়মান ডাক্তারের ঘর থেকে বেরিয়ে, রোগী ওষুধ কিনে চলে যায়। আমি তখনও কাউন্টারে ঠায় দাঁড়ানো!
হাতের কাজটুকু সেরে মুরতাজা আবারও মুখে সেই বাঁকা হাসিটা ঝুলায়।
–”হাসেন ক্যান?”, চাপাস্বরে কাজ হয়। মুরতাজা বলে, “যারে ফোন করতে চাই তার নাম রেশমা।”


রেশমা। রেশমা নামটিকে আমি চিনি। ঘিঞ্জি গলির ভীড়ের মধ্যে থেকে আলাদা করে টের পাওয়া যায় এমন এম্বুলেন্সের সাইরেন হয়ে ওঠে রেশমার নামটা। অথচ আমার বা মুরতাজার জানা আছে যে ‘রেশমা’ নামটাও রেশমার আসল নাম নয়। সেই নামের সুতোয় মুরতাজা বাঁধা পড়ে গেছে।
সে বলতে শুরু করে, “রেশমার কাছে অনেকদিন ধইরাই আমি যাই। রেশমারে আপনি চিনবেন না। না চিনোনই ভালো। এরে একবার চিনলে কি বিপদ, তা আমি বুজতাছি।”, একটু দম নেয় মুরতাজা, “এইখানে আসোনের আগে থেইকা, আমি রেশমারে চিনি। রেশমা আমার বহুত ভালা লাগে। বুঝলেন?”


আমি বুঝি।


–”তো আপনি সন্দ্যায় এরাম করেন ক্যান?”
“রেশমারে ফোন করতে ইচ্ছা করে। আগে আমি ঐ টাইমৈ যাইতাম হের কাছে। এখন যাইতে পারি না। মাঝে মইদে দুপোরে যাই। যে গরম!”
মুরতাজার গরম লাগার কষ্ট আমি বুঝতে পারি। আমার গরম লাগতে থাকে। রেশমার যাবতীয় অতিথিদের গরম লাগার বেদনা টের পাই শরীরে।
“সুলাইমান সা’ব আগে সন্দ্যায় ছুটি দিত। এখন দেয়না।”, চাপা গলায় বলে মুরতাজা, “বেডার খাই বাড়ছে, এত রাইত পর্যন্ত ব্যবসা আর ব্যবসা।”


এগুলো কথা যে আসল কথার প্রস্তাবনা, সেটা আমি বুঝি। আর সেজন্যেই অপেক্ষা করি মূল কারণটা জানার জন্য। আমার পায়ের ধরে আসা ঝিঁঝিঁটাকে আমি পাত্তা দেই না।
মুরতাজা বলে, “আগে সন্দ্যায় যাইতাম, অহন দুপোরে। এইটা কোনো বিষয় না আসলে। তয় খারাপ লাগে। কি করি কন?”


মুরতাজা যে আমাকে আপনি বলছে সেটা আমি খেয়াল করি না। অভিজ্ঞ কারো কাছেই পরামর্শ নিতে হয় বলে এই সম্বোধন। আমি মাথা নেড়ে বুঝে ওঠার চেষ্টা করি, “আপনের সমস্যা কি? সন্দ্যায় ফাঁকা ফাঁকা লাগে?”
আমার শ্লেষটা গায়ে মাখে না সে, “না রে ভাই, আমার খালি অস্থির লাগে। সন্দ্যায় আমি বইতাম। তখন দেখছি রেশমা মুবাইল বন্‌ কইরা দিত। এখন সন্দ্যায় হের মুবাইল বন্‌ পাইলে আমার খালি অস্থির লাগে।”


ঝিঁঝিঁ কেটে আমার পায়ে সাড় ফিরে আসতে চায়। পায়ের বুড়ো আঙুলের দিকে সাঁই সাঁই করে রক্তকণা ছুটে যাচ্ছে, মগবাজারের ঘিঞ্জি গলির মতো ভীড় ঠেলে। স্নায়ুর ঝড় পা থেকে পেটের দিকে গুলিয়ে উঠে আসছে। রেশমার মোবাইলের ডায়াল টোনের কাছে বাঁধা পড়া মুরতাজা আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। আমি চোখ সরিয়ে নেই। কাউন্টারের ভিতরে, একটু কোনার দিকে, সরলমনে বসে থাকা হলুদ টিফিন বক্সটা মুখ ব্যাদান করে চেয়ে থাকে।




***
নোটঃ এই লেখাটার আংশিক পরিবর্তিত রূপ দৈনিক সমকাল পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকীতে প্রকাশিত হয় ৩০ মার্চ, ২০১২। প্রকাশিত লেখাটির লিঙ্ক এখানে। 

বৃহস্পতিবার, ২ জুলাই, ২০০৯

দূরত্ববোধক

দূরত্বের নাম নেই, শহর কিংবা গ্রামে আমাদের দূরত্ব নিয়ম মেনেই বাড়ে-
ধীরে স্থবির চোখ মেলে নিমেষব্যাপী আমরা দুঃখ থেকে দূরগামী হই
দুঃখ সিঁড়ি বেয়ে সাপের মত উঠে আসে সন্তর্পণে হৃদয়ের কাছে
ধাতব রেলিঙে যাবতীয় অনুসর্গ ছেড়ে আসা সাপের চোখে আমি কাতরতা পাই
শহরে কিংবা গ্রামে, এই প্রাপ্তি আমাকে সুখ দেয়
আমার চেয়েও অধিক কাতর দুঃখের অবয়ব আমার স্বভাবজাত অহমিকায়
পরশ বুলায় সাপের মায়ায় সিঁড়িঘরে একটি বাগান তৈরি করি
বাগানে বিষের ফুল ফুটে উঠবে একদিন, এমন প্রত্যাশায় শিখে নিই যাবতীয় কৃষি
মাটির গন্ধে সিড়িঘরে সাপেরা ঘুমিয়ে পড়ে, অপরিচিত ডাকপিয়ন
চিলেকোঠার কড়া নেড়ে বিভিন্ন হলুদ খাম রেখে গেছে, প্রত্যাগত আহ্বান
মাটি থেকে দূরে ধাতবের কাছে ডাকে উন্মাদ স্বরে, মাদকের ঘ্রাণ
আমার মগজে ডাকপিয়নের নাম লিখে রাখে সকলে, স্মৃতির অধিক কালিতে
আঁচড়সমূহ ব্যাপ্ত করে দেয় আমাদের আকাশে মুখের দাগের জ্যামিতি
দূরত্বের নিয়মে আমি দৈনন্দিন পথ সিঁড়িঘরে জমা রাখি।