শুক্রবার, ৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১১

কাঁড়া আর আকাঁড়া

ছেলেবেলা ম্যাজিকের মতো ছিল। কতোকিছু জানতাম না। কতোকিছুর কার্যকারণ আর কলকব্জা বুঝতাম না। তাই অজানা ব্যাপারগুলোকে ভেলকিবাজি মনে হতো। স্কুল ছুটি হলে এক আইসক্রিমের গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতো, দু’টাকা দিলেই কমলা কমলা পলিথিনে মোড়ানো। একপাশের পলিথিন দাঁতে টেনে ছিঁড়ে ফেলতাম, তারপরে মুখের মধ্যে গলে গলে যেতো কমলার স্বাদ। ঠোঁট আর জিব একদম টকটকে কমলা হয়ে উঠতো। সেই আইসক্রিম বানানোর বিদ্যা অজানা ছিলো, খুব আশ্চর্য হতাম, রোজ এতো এতো আইসক্রিম কোথায় বানায়? কে বানায়? যে বানায়, সে কী জানে আমি এই আইসক্রিম কতো পছন্দ করি? জানলে কতোই না ভালো হতো!
 

তারপর একদিন বছর পাঁচেকের স্কুল-পেরুনো তাগড়া বড়ো ভাই বললো, এগুলো লম্বা লম্বা বরফ বানিয়ে তার ওপর চিনি আর রঙ মিশিয়ে পলিথিনে ভরে বিক্রি করে আর পানি নেয়া হয় মিউনিসিপ্যালিটির কল থেকে ফ্রি ফ্রি – - – শুনে আইসক্রিমগুলো আমার জিবের ওপর থেকে বাষ্প হয়ে চলে গেলো।
 


স্কুল বাসে করে বাসায় ফেরার সময় রোজ একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে স্পিডব্রেকার পড়তো। বাসটা একটু ঝাঁকুনি দিয়ে আবার চলতে শুরু করতো। আমি জানালা দিয়ে বাইরে ফুটপাতের পাশে দোকানপাট দেখতাম। স্পিডব্রেকারের কারণে ওই জায়গার দোকানগুলো নড়ে চড়ে উঠতো আমার চোখে। খুব অবাক হতাম, কোনোদিন পাশের কোন দোকান নড়ে না কেন, এই ভেবে। রাস্তার ওপরে স্পিডব্রেকারকে মনে হতো একটা অচল আঁচিল। কখনই সারবে না এমন দুশ্চিহ্ন। মাঝে মাঝে অনেক স্পিডব্রেকার পেলে মনে হতো হ্যাঞ্চব্যাক অফ নট্‌রড্যামের পিঠে চড়েছি। এবড়ো খেবড়ো কুঁজের ভারে নুয়ে থেবড়ে যাওয়া রাস্তার জন্য মায়া হতো।



একদিন বাস ড্রাইভার মামা বললেন, রাস্তা বানানের সময় কনট্রাকটর ট্যাকা খাইসে, তাই রাস্তাখান বচ্ছর যাইতে না যাইতে এই অবস্তা। ঠিকঠাক বানাইলে মাক্‌খনের লাগান একটা রাস্তা হইতো – - -
আমার ঘোর তখনো ভাঙে নি, তাই ভুল করে জিজ্ঞেস করলাম, স্পিডব্রেকারও কি তাহলে টাকা খাওয়ার কারণে জন্মায়?
 

পানের রসে রক্তজবার মতো কুচি কুচি দাঁত ঝিকিয়ে তিনি বললেন, ‘না গো মামা, ইসপিড বের্কার তো বানাই থোয় আমগো লিগা। আমরা য্যান ইসপিড বাড়াইতে না পারি। রাস্তা বানানের পর ইটা দিয়ে উচা কৈরা দেয় – - -
কুজের মতো, আঁচিলের মতো রাস্তার গা থেকে ধীরে ধীরে সব পচে গলে খসে পড়তে থাকে।
 


এভাবে ক্রমাগত আমার জাদুবিদ্যার ভ্রম ভেঙে যেতে থাকে। আমি এইসব ভাঙনে কষ্ট পাই। নিদারুণ বেদনায় দুঃস্বপ্ন দেখি। তারপর ঘামতে ঘামতে চেঁচিয়ে ঘুম ভেঙে হাতড়ে হাতড়ে জাদুগুলো খুঁজতে থাকি। বিছানার তলে গিয়ে ওগুলো হারিয়ে যায় চুপচাপ। টের পাই না। সদ্য ঘুম ভাঙা কষ্ট নিয়ে ভোর হওয়া দেখি। ভান করতে শুরু করি। ভ্রম ভেঙে গেলেও আমি অনেক কিছু শিখছি। শিখতে শিখতে আমি বেড়ে উঠছি। বুড়ো হয়ে পড়ছি। উঠতে উঠতে আর পড়তে পড়তে আমার ভালো লাগতে থাকে। আমার খারাপ লাগতে থাকে। ভালো লাগা আর খারাপ লাগা নিয়ে আমি একরকম আনকোরা সুখে ডুবে যেতে থাকি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন