রবিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

দৈনিক খবরাখবর এবং বিষয়াশয়, অনুষঙ্গ

তেরছা হয়ে বাঁধা মশারিটা সকালে জানিয়ে দিল, এরকম অযত্নে টাঙানো হলে সে কালকে থেকে ধর্মঘট শুরু করবে। আমি সব শুনে একটু নিরুপায় বোধ করছি। ভাবলাম, দাবি-দাওয়া মেনে নেই; রাতে মশা খুব জ্বালায়। ঘরের কোণে কোণে খুঁজে পেতে কয়েক টুকরা দড়ি পেলাম। সেগুলো হাতে পায়ে জুড়ে দিতেই মশারির মুখে কী বিগলিত হাসি! আমারও ভালো লাগলো, যাক বাবা। এবারে খুশি, হলো তো?


এরকম ভেবে পা ডুবিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। একটু এগুতেই দেখা গেল দরজার কোণে গতরাতে রহিমার ছড়িয়ে দেয়া সাদা চকের মত বিষে মুখ ডুবিয়ে দুটি কিশোর-তেলাপোকা মরে আছে। তাদের ঊর্ধ্বমুখী ছয়-ছয়টি পা নির্দেশ করছে একটা গুরুতর প্রোপাগাণ্ডা: পতিতার মেলে ধরা উরুর মত ব্যক্ত হয়ে গেছে জীবন আর কৈশোরের আকুল কৌতূহল। আমার খারাপ লাগে। আচমকাই গলার মাঝে খট করে একটা দলা আটকে যায়। ইদানীং এই বাজে ব্যাপারটা ঘটছে। বেশ আগে, একটা সময়ে খারাপ লাগার ব্যাপারগুলো আমার অনুভূতিকে দেউলিয়া করে দিতো আর সেসময়ে নানামুখী ব্যস্ততায় আমি সেই বিপন্নতা ঢেকে ফেলতাম। আজকাল সেটা হচ্ছে না (কিছুটা স্বস্তিকর ব্যাপার। সর্বদা ঢাল-তলোয়ারে প্রস্তুত থাকাটা কষ্টের), আবার এহেন উটকো গলায়-আটকে-থাকা দলার প্রকোপও বাড়ছে। আমি বেশ দুশ্চিন্তায় থেমে থাকি কিছুক্ষণ।


কিশোর তেলাপোকাদের ঠেলে সরিয়ে দিই একটু। পৃথিবীর পাঠ চুকেছে, এখন পিঁপড়েরা আসবে ভূরিভোজের আহার্য নিয়ে যেতে। আমি সেই ফিস্টের হাট-বাজার একটু স্থানান্তরে পাঠিয়ে ঘটিয়ে ভুলে থাকতে চাই যে আমার গলায় একটা কিছু আটকে আছে।
সামনে এগিয়েও পিছনে ফিরে যাওয়া যেতে পারে। যেমন আমি নীল দানাদার কলয়েডীয় পেস্ট টেনে নিই, শিশ্ন টেপার মতো বের করে আনি সরস মাজক, এরপরে ব্রাশে লাগিয়েও কিছু সময় নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকি!


পরে ফিরে এলে দেখি চৌকো চৌকো আলোবাক্স ঘরের মাঝে অ্যাসেম্বলি বসিয়েছে। বসে পড়তে পড়তে তারা খিক করে হাসে, ঠ্যালা দেয় একে অপরকে, দুলে ওঠে সম্মোহনে। আমাকে ঘরে ঢুকতে দেখেই তারা জোরে চেঁচিয়ে ওঠে, "ওমা! তুমি তো পুরাই নগ্ন! হে হে হি হি হু হু!"


আমি একটু ঝামটে উঠি, কিংবা সেখানেও আমার গলায় আটকে থাকা দলাটি সরে যায় না বলে আমি নীরবই থাকি। "সরো সরো, জায়গা দাও দেখি!" আমি বললেই তারা সরে যাবে এমনটাও ঘটে না। আমাকে অনেক কিছু করতে হবে এখন। সাদা-রঙিন জামা জড়াতে হবে, এবং ভুলে যেতে হবে যে একটু আগেই নগ্নতা আমাকে আরাম দিচ্ছিল। আলোবাক্সেরা গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল হেসে কুটি কুটি, সেটা এখন পারবে না, এই সত্য মেনে নিতে নিতে আমি আরো একবার হেরে যাই। আমাকে আরো প্রসাধনে চর্চিত হতে হবে, চুল আঁচড়ে নিপাট ভদ্রলোক সেজে বেরুতে হবে বাইরে। এসকল নিছক স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রণা মেখে আমি পথে নামি।


রোদ চিরে যেতে থাকে যেভাবে তাতে আমি আরাম পাই। জামার অশ্লীলতা ভেদ করেও সুস্থ রোদ আমাকে ছুঁয়ে যাচ্ছে এমনটা ভাবি, ভাবতে ভাবতেই একরাশ ধুলো জুতোর ওপরে এসে পড়ে। ফুটপাতের পাশে অলস-শয্যাবাসী ধুলো। মনে পড়ে যায় জুতোটার চামড়ার গর্তে গর্তে কত অজ্ঞাত ধুলো জমছে রোজ। দুয়েকদিন পর পর আমি কালি মেখে দিলে গর্তে বসবাস করা ধুলোরাও হোলি খেলে, কালো হোলি! তারপরে আবার নীরবতা, নতুন অতিথিরা আসে, গল্প জুড়ে দেয়, কুশল বিনিময়, হাপিত্যেশ! অতঃপর পুনরায় হোলি। চক্রাকারে আমি আর ধুলো একটা সম্পর্ক স্থাপন করেছি পরষ্পরের সজাগ সম্মতি ছাড়াই। সেই কথাও মনে পড়ে।


ফুটপাতের পাশে নগর-রূপায়কেরা রেলিং দিয়েছে, সার সার রূপালী রেলিং। রোদ মেখে ঝিকিয়ে উঠছে চিৎকারে। আমি একটু ছুঁয়ে দিতেই আঙুলে ফালা ফালা তড়িতের মতো তাপ ঢুকে পড়ে। আমি কৌমার্য হারানোর মতোন হতাশা আর বেকুবি আর হা-হুতাশ আর গ্লানি আর অসহায়ত্ব টের পাই। সিদ্ধান্ত নিই, এবারে হাত রাখা যায় রেলিং সঙ্গমে। এবারে ঘর্মাক্ত হওয়া যায়, অবসন্ন হওয়া যায়। এবারে রেলিংকে ভেতরে টেনে ঢুকিয়ে বীর্যহীন করে দেয়া যায়। আমি উল্লাসিত হই!


তারপরে আমি লম্বা পা ফেলি সামনে। মনে পড়ে যায় তেলাপোকা কিশোরদ্বয় আমার মতোই বেরিয়েছিল, আমার ঘরের কালো-পথে ওরা হাঁটতে হাঁটতে মিশে গেছে পা ছড়িয়ে। মনে পড়ে চৌকো আলোবাক্সগুলোকে, ওরা নিশ্চয়ই এখন জমাট রুলটানা ঘরে বাসর সাজিয়ে ফেলেছে। মনে পড়ে একটা নীলবীর্য-শিশ্ন রেখে এসেছি মুখ না লাগিয়েই, ওখানে এখন স্বতঃস্ফূর্ত নিঃসরণ হবে, ভিজে যাবে ক্রমশই আমার বেসিন, টাইলসের খাঁজ, চৌকাঠ, কার্পেট, আলোবাক্সের কাফেলা!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন