শনিবার, ৩০ জানুয়ারী, ২০১০

মুখবন্ধ

হ্যাং হয়ে থমকে আছি। মনিটরে মাঝেমাঝে ফেইটাল এরর হয়। গাঢ় চকচকে নীল পর্দা এসে সব ঢেকে দেয়। শাদা গোটা গোটা অক্ষরে লেখা থেকে নির্মম পরিহাস। সকল চেষ্টা ফাঁকি দিয়ে মরে গেছে যন্ত্র। যন্ত্রেরও শরীর বিগড়ায়, মাথা নষ্ট হয়। মাথা মানে প্রসেসর, নয়তো মাদারবোর্ড। মা! মা! তোমার কী হয়েছে মা? মন খারাপ? মন খারাপ হলে আমাকে একটু জড়িয়ে থাকো। আরো একটু সময়… তোমার গায়ের গন্ধে একটা শৈশব ফেলে এসেছি আমি। মা!


নীল পর্দাটা তিরতির করে কাঁপছে। হাত চলে যাচ্ছে রিসেট বোতামের দিকে। চাপ দিলেই নিকষ কালো হয়ে উঠবে সব। সওব। তারপরে দমবন্ধ অনুভূতির অক্টোপাস, চেপে ধরে চারপাশ। নাগপাশ। হাঁসফাঁস। ফাঁসে ঝুলে গেছি আমি হ্যাং।


তারপরে বিপ বিপ করে আমার ধুকপুকানি ফিরে আসবে আমার, এবং আমার কম্পিউটারের। কম্পুসোনা চোখ খোলো। দেখো গাঢ় কোমল রাত জানালার বাইরে জমা হয়ে আছে। আলোগুলো অনেকেই একা একা তোমাকে দেখার জন্যে দূর থেকে এসেছে। তাদেরকে বিষণ্ণ করে দিও না। ওদের আলোটুকু উজ্জ্বল আর ভালো। তুমি ভালোমানুষের মতো জেগে ওঠো।


মা! আমার অনেক অনেক পাপ এই জীবনে। তুমি ছাড়া সেই কথা আমি আর কাকে বলবো। এই নষ্টতা ভ্রষ্টতার পৃথিবীতে জন্মের পর থেকে আমি পাপ করছি। সবাই বলে আমি অন্যায়ও করেছি অনেক। প্রথম প্রথম আমি ‘ভুল’ করতাম, তারপরে ‘কাজটা ঠিক করো নি’ বলতো সবাই। আরো কিছুদিন পরে বললো, ‘তুমি খুব খারাপ! এটা কী করে করলে? এ বড়ো অন্যায়’। একদিন সবাই খুব রেগে গেলো, ‘পাপী! নষ্ট! খারাপ! কুৎসিত!’ বলে তারা চেঁচিয়ে উঠলো, আমার চারপাশের বাতাসও থমকে গেলো। মনে হলো, সেদিন ফুসফুস ভরে উঠলো প্রাকৃতিক পাপে। আমি তো এরকম চাইনি। এভাবে সব ঘটে গেলো কীভাবে? আমাকে একটু জায়গা দিবে না মা? তোমার জঠরে ঢুকে আমি আবার ঘুমিয়ে পড়ি।


মনের ওজন কতো? এতো কিছু বিজ্ঞান জেনে গেলো, অণুপরমাণুর ভেতরের বিদ্যা! আমাকে কেউ বললো না কতোদিন বাঁচলে মনের ওজন অসহনীয় হয়ে ওঠে? বললে আমি হয়তো সাবধান হতাম, সতর্ক হতাম যে আমি বিপজ্জনক হয়ে উঠছি। পাপবোধের ছুরি রক্তনালীর ভেতরে গুঁড়ো গুঁড়ো আফিমের মতো মিশে যাচ্ছে। তুমিও তো কিছু বলো নাই মা। আরেকটু হেসে আমাকে নিষেধ করতে! ‘বাবু, ওদিকে যেও না। আমার কথা শোনো। তাকাও এদিকে। ওখানে যেতে নেই।’ এভাবে বললেই আমি শুনতাম তোমার কথা। আমি তো তোমার লক্ষ্মীসোনা…


***


আমি এখনও নিথর মনিটরের দিকে চুপচাপ তাকিয়ে আছি। ঘরে কেউ নাই। ঘরের বাইরের লাইটগুলো নেভানো। চুপচাপ। এদিকে বাইরে জানালার বাইরে রাস্তায়ও কেউ নেই, কয়েকটা স্ট্রিট লাইট। ওগুলোকে এখন একলা একলা আর বিষণ্ণ লাগছে আমার। আর দেখো আমি মনিটরের দিকে তাকিয়ে হাসছি। স্ক্রিন-সেভারে জলজ মাতৃকায় একটা শিশু চোখ মুদে ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি সেই শিশুটির মুঠো জড়িয়ে ধরলাম!




----

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন