শনিবার, ৯ জানুয়ারী, ২০১০

তুমি জানবেও না যে এই লেখাটা তোমায় নিয়ে...

আ,


ছোটবেলায় আমি একবার দৌড়ের রেসে নেমেছিলাম। অনেক প্রাণপণ দৌড়ে নিঃশ্বাসের শেষবিন্দুতে পৌঁছে দেখি আমি হেরে গেছি আরেকটা ঢ্যাঙা ছেলের কাছে। সেদিন ফিনিশিং লাইনের পাশে দাঁড়িয়ে আমার অনেক কান্না পাচ্ছিলো, ছোট ছিলাম। আবেগী ছিলাম। এখনও হতচ্ছাড়া আবেগ আমায় ছাড়ে না। সেদিন থেকে হারতে বড়ো কষ্ট হয় সবসময়।


 ২
বছরের বিশেষ দিনগুলোতে আমাদের কখনোই দেখা হয় না! এটা খুব অদ্ভুতভাবে তুমি একদিন বললে, কী নিয়ে যেনো আমাদের মধ্যে খুটখাট লেগে গেলো আর তুমি বললে, খুব ক্লান্ত স্বরে, যেন এই কথাগুলো বলতে তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে! বললে, “তুমি কি খেয়াল করেছো যে আমরা কোন উৎসবের দিনে, আয়োজনের দিনে, দিবসগুলোতে দেখা করতেই পারি না!” আমি খুব ক্লান্ত ছিলাম হয়তো, তাই ভেবে দেখলাম যে আসলেই পারি না। কিন্তু এটা নিয়ে বলার কিছুই ছিলো না। দেখা না করার কারণ আমরা হইনি কখনো। পরিপার্শ্ব আমাদের কতোভাবে বেঁকেচুরে দেয়। সহস্র আকাঙ্ক্ষার গলা পরিস্থিতির চাপে বুজে আসে অনায়াসে, যেনো কোনো বাগানের মালি গাছে পানি দেয়ার নলটা অনায়াসে বুজে দিলো!


এক একটা বছর যায় আর আমি অবাক হই, কীভাবে বিস্তর বিস্তর স্মৃতি জমা হয়। আমি জন্মের পর থেকে এক একটা স্মৃতির ঘর বুনছি। কত হর্ষ, বেদনা আর বিরহ জমা হয়ে আছে, অমলিন আর্কাইভের মতো। কিন্তু তুমি এলে আর এসব ঘরের চাবি হারিয়েই ফেললাম আমি। টেরও পাই না যে সেই দুঃস্মৃতির ঘর আমার বুকের ভেতরে এখনও আছে!


দুর! আজকের দিনে কেনো আমি এসব বলছি। কিন্তু জানো তো, আমি কেমন মেলাঙ্কলিক-অ্যালকোহলিকের মতোন। মাঝে মাঝে রেট্রোস্পেক্টে নিজেকে দেখি, আর ভাবি আমি কীভাবে খাদের একটু পাশ দিয়ে সাঁ করে বেরিয়ে এলাম। তুমি সামনে ছিলে নিয়ত ঘূর্ণির বছরটা জুড়ে ছায়ার মতো একই গতিতে ঘুরেছি দু’জনেই। এতো দ্রুত দিনগুলো পেরিয়েছে যে মাঝে মাঝে টের পাই নিঃ আমি অনলাইনে একজনের সাথেই কথা বলছি, রোজ রোজ। প্রতিদিন। তুমিও খেয়াল করেছিলে? আমি কতটা অপেক্ষা করতাম, অপেক্ষার মুহূর্তে কী ভাবতাম এখনও সব জানি।


ঝকঝকে দোকানটার চেয়ারগুলো ঠাণ্ডা ছিলো, সেটা শীতের জানুয়ারি ছিলো। আমি কাঠ হয়ে বসে ছিলাম আর তোমার অপেক্ষা করছিলাম। তুমি একটা নীলচে বেগুনি জামা পরে আসলে, জামায় শাদা শাদা ফুল। এসে সামনের চেয়ারটা টেনে বসলে আর আমি জমে গেলাম। আমার হাতে একটা প্যাকেট ছিলো, প্যাকেটের ভেতরে পোকা ছিল। পোকা না, একটা ঝিনুক ছিলো। ছোট প্যাট্রিফায়েড ঝিনুক। ঝিনুকটা একটা চাবির রিঙের ভেতরে সারাজীবনের জন্যে আটকা পড়ে গেছে! আমি সেই প্যাকেটটা তোমার দিকে ঠেলে দেয়ার সময়ে একটু একটু কাঁপছিলাম মনে হয়। সেদিন তো বুঝি নি, সেই প্যাকেটের ভেতরের চাবির রিঙে আমার সবটুকু বাঁধা পড়ে গেছে…


তোমার সাথে এর পরে আমার যতোদিনই দেখা হয়েছে, আমি সেই কম্পনটা টের পেয়েছি। এটা কোনো বলার মতো বিষয় না, বরং হয়তো দুশ্চিন্তার বিষয়। আমি নিশ্চয়ই উদভ্রান্ত অসুস্থ কেউ! নাহলে কেনো আমি এমন সম্মোহিত হবো, কেনো একজনের চোখের দিকে তাকালে আমার আর কোনোকিছুই ভালো লাগবে না– তাকে ছাড়া। কেনো কারো খিল খিল হাসি শুনলে আমি মোবাইল কোম্পানিকে ধন্যবাদ দিবো আর সারাজীবনের জন্যে চার্লি চ্যাপলিনের চেয়ে বড়ো কমেডিয়ান হয়ে যাবো! কেনো সে ব্যস্ত আর পাঁচ মিনিটের বেশি দেখা করতে পারবে না জেনেও আমি ঠা ঠা রোদ্দুর অনায়াসে মাথায় মেখে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারবো! এতোসব কেনো বড়ো অস্থির করে আমাকে!


আমি জানি তুমিও আমার মতোই কাঁপো। আমি নিশ্চিতভাবেই জানি এই খেলাঘরে তুমি আমার চেয়ে বেশি আমাকে ভালোবাসো। নিজের ওপর দাবি ছেড়ে দিয়েছি সেদিনই, চাবির রিঙের সাথে তোমাকে দিয়ে দিয়েছিলাম স-ও-ব!
এই প্রথম আমি হেরে গিয়ে অনেক খুশি হয়ে গেছি। এই প্রথম আমি জেনেছি সব দৌড়ে জিততে নেই। মাঝে মাঝে ফিনিশিং লাইনে সবচে কাঙ্ক্ষিত মানুষটি দাঁড়িয়ে থাকে শুধুই আমার জন্যে…


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন