বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০০৮

সনদবিহীন আত্মজ


ঙ.
...শশাঙ্ক নামে একটা ছেলে জন্মেছে একটু আগে। ম্যাটার্নিটি ওয়ার্ডের ঘোলাটে পর্দাঢাকা কেবিন থেকে তার চিল-চিৎকার ভেসে আসছে। ফিনাইলধোয়া ঘরে জীবাণুমুক্ত তোয়ালেতে সে জড়ানো। রোগ-জরা তাকে এখন ছুঁতে পারবে না। আরো অনেক অনেক দিন পরে সে পঙ্কিল হবে, তার আগে এখন অন্তত সে নিষ্পাপ, সরল, নির্মল আগমনের পরে কাঁদছে। শশাঙ্কের মা, একটু আগে প্রসবজনিত রক্তক্ষরণে মারা গেছেন চুপচাপ। মৃত্যুর একটু আগে তিনি একবার শশাঙ্ককে কোলে নিয়ে তার নরোম মাথায় চুমু খেয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলেছেন।...




ঘ.
...গত কিছুদিন ধরে শরীরটা কেমন খুলে খুলে যাচ্ছে। এমন ক্লান্ত লাগে! বসতে কষ্ট কষ্ট উঠে হাঁটতে কষ্ট। বেশি সময় একজায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। পা দুটোও ফুলে গেছে। আমি একটা সময়ে কী সুন্দর তন্বী ছিলাম। পাতলা ছিপছিপে ছিলো শরীরটা। এখন কেমন ভারি হয়ে গেছি। আমার ভেতরে বাবুটা নড়াচড়া করে। ও আসছে। আর ক'টাদিন পরেই। ও এলে আমি ওকে বুকে চেপে বড়ো করবো। ছেলে আসছে আমার। ওর সাথে এতদিনে কতো কতো কথা বলেছি! কীভাবে কীভাবে সময়টা চলে গেল! শশাঙ্ক! শশাঙ্ক নাম রাখবো ওর। কী সুন্দর তেজস্বী নামটা! শুনলেই রক্তের মধ্যে চিন্‌ চিন্‌ করে ওঠে। মনে হয় মৌর্যসম্রাট সাঁই সাঁই করে তরবারি ঘুরাচ্ছে আর বীরের মতো এগিয়ে আসছে!...




গ.
...আমার ভেতরে একটা বাবু জন্মাচ্ছে একটু একটু করে। আমি ওর জন্যে দিনরাত জেগে থাকি বা ঘুমিয়ে থাকি। ওর সাথে কথা বলি বা অভিমান করি। বাবুটার জন্যে আমার কেমন কেমন করে! গত পাঁচ-ছয়মাস ধরে এই বাবুটা আমার মধ্যে জন্মেছে, বড়ো হচ্ছে. আজকাল খুব দাপাদাপি করে। ফুলে ওঠা পেটের টানটান চামড়ার নিচেই শুয়ে আছে। ওর কি এখনও চোখ ফুটেছে? ও কি স্বপ্ন দেখা শিখেছে? কিসের স্বপ্ন দেখে ও? নিশ্চয়ই স্বর্গের স্বপ্ন দেখে ও। সেই স্বপ্ন দেখে মুখে হাসিও ফুটে ওঠে আমার বাবুটার।...




খ.
...এটা খুব বিরক্তিকর একটা রুটিন হয়েছে! রোজ সকালে উঠেই গা গুলানো বমি আসে। চেষ্টা করেও আটকানো যায় না। তারপরে নাশতা করার আগ পর্যন্ত মুখটা টকে থাকে। সেই স্বাদে আরো বমি হবে বলে মনে হতে থাকে। বিচ্ছিরি! সকাল সকাল মেজাজটা খারাপ হয়ে থাকে। এ কেমন যন্ত্রণায় ফেঁসে গেলাম! সামনের দিনগুলোয় আরো কী কী ভোগান্তি হবে ভাবতেই শিউরে উঠছে গায়ের লোম। বাচ্চা জন্ম দেয়া কতো কষ্টের! যাদের কাছে শুনেছি সবাই বলেছে, সবাই সুযোগ পেয়ে খালি ভয় দেখায়।...




ক.
...আমি হাতে টেস্টের কাঠিটা ধরে বসে আছি। এটা কীভাবে সম্ভব! অবিশ্বাস্য লাগছে নিজের কাছেই। এভাবে তো আমি চাইনি। এভাবে করে কি হয় কোন কিছু? ভয় হচ্ছে খুব। আমি এখন কী করি! এখন কোনভাবেই বাচ্চা নেয়া যাবে না। আরো অন্তত দুইবছর। আমার ক্যারিয়ারের পুরা বারোটা বেজে যাবে। তারওপর বাচ্চা মানুষ করবে কে? কাজ দেখবে কে? আমার কেমন দিশেহারা উদভ্রান্ত লাগছে! ইস্‌! আরেকটু কেয়ারফুল হলেই হতো। কেন যে... ...




০.
কোন গল্প নয়। কোন সত্যকাহিনী নয়। একটা মানুষ আর তার অপত্য-মানবের কথা। টুকরো টুকরো কথা, যে কথাগুলোর কোন মূল্য নেই পৃথিবীর কাছে। সর্বসম ঘূর্ণনে পৃথিবী নশ্বর সত্য বুকে নিয়ে ঘুরছে। সবই বিনাশ হবে একদিন। পৃথিবীচারী মানুষও সেকথা জানে, জানে বলেই আরো আরো নতুন প্রাণ নিয়ে আসে এখানে। নারীদের গর্ভে বীরপ্রসব ঘটে। তারপরে সেই বীর, পুরুষ হয়ে বেড়ে ওঠে। পেছনে নারীটি ধীরে ধীরে হারিয়ে যান, বেঁচে থাকলে, কিংবা মরে গিয়েও তাঁরা হারিয়ে যান। পৃথিবীর কিছু যায় আসে না তাতে। তবে তাঁরাও বড়ো অকৃত্রিম ভালোবাসায় আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যান, যেন আর কারো স্বীকৃত সনদের কোনও দরকার নাই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন