বৃহস্পতিবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০০৮

দ্য নাইট ইজ স্টিল ইয়াং!!

রাত নামলে নিশাচর সকল প্রাণিদের মাঝে একটা প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যায়। যেমন করে দিবাচর প্রাণিরা সকালে সূর্যকে মানে, উনি উঠে গেলেই তারা বিছানা-বালিশ ছেড়ে উঠে পড়ে। তারপরে বিমূঢ় ত্বকে পানি ঝাপটা দিয়ে জেগে ওঠে। জেগে ওঠার ক্ষণ থেকেই তাদের বোধসমূহ সজাগ হতে থাকে। শৌচ শেষ করে নাশতার পরে ধূমায়িত চা খেতে খেতে সকল পাপ ঘাড়ে নিয়ে জাগতিক বোধেরা ফিরে আসে।


সেরকম ভাবে নিশ্চয়ই নিশাচর প্রাণিরা জেগে ওঠে। সূর্য ডোবার সাথে চাঁদের সময়কাল মিলে না অনেক সময়। রাত আসে যখন, সন্ধ্যা ফুরানোর পরে, প্যালেট থেকে আরো একপোঁচ গাঢ় অবাস্তব বিমর্ষ আঁধার চারপাশে বুলিয়ে দিলে, রাত নেমেছে নিশ্চিত হওয়ার পরে তারা জেগে ওঠেন। তাদের জেগে ওঠা দিবাচরদের মতো এতো সশব্দ হয় না। অনেকটা সরীসৃপের মতো নিস্তব্ধতায় একটা সাড়া পড়ে যায়। একটু পরে, টের পাওয়া যায়, নগরের জনপদ ছাপিয়ে, রাস্তার জ্বলজ্বলে চৌকস গাড়ি-হেডলাইট মাড়িয়েও নিশাচরেরা জেগে উঠতে থাকেন।


রাত বাড়তে শুরু করলে নিশাচরদের প্রাত্যহিক আলাপ শুরু হয়। তাদের আলাপে দিবাচরদের মতো সরলীকরণ থাকে না। সকালের মানুষেরা যেমন সরাসরি কথা বলে, সরাসরি হাসে, কাঁদে, ঝগড়া করে, নিশাচরেরা তেমন করতে পারেন না। রাতে আলোকিত করার মাধ্যমগুলো হয় ঝাপসা নাহয় অতি উজ্জ্বল। নিশাচরদের চোখ তাতে পুরোপুরি কখনোই মানিয়ে নিতে পারে না। ক্রমশ অভিযোজনের চেষ্টায় রত চোখে সবকিছু ঠিকঠাক ঠাহর করা যায় না। বৈদ্যুতিক আলো সেকেণ্ডে পঞ্চাশবার জ্বলে ওঠে আর নিভে যায়। এতো দ্রুততার সাথে কাজ করলেও নিশাচরদের চোখে এই আলোর অনবরত ওঠানামায় একটা ঢেউমূলক সরণ ঘটে। চোখের বাইরে সবকিছুকে তারা কর্ণিয়ায় গেঁথে নিতে পারে না। আর যেখানে বৈদ্যুতিক আলোরহিত, সেখানে তারা আধোঅন্ধকারে ঠাহর করতে শুরু করে। দেখার ক্রিয়াটার সাথে ঠাহর মিশলে একটা তেলজল মিশ্রণ তৈরি হয়। প্রতারক স্মৃতি তাদেরকে ভ্রষ্ট করে।


এহেন পরিস্থিতিতে নিশাচরদের কথা জড়ানোকুটিল বহুবিধ মাথাওয়ালা হয়ে ওঠে। কথার লেজের মুখও খোলা থাকে অনেকগুলো। র‌্যাটলস্নেকের জান্তব সর্‌সর্‌ শব্দ করে লেজের ছিন্নমাথাগুলো নড়ে চড়ে শূন্যে। অন্য নিশাচরেরা সেকথার লেজে পাড়া দিয়ে কখনো কখনো নতুন কথা বাঁধে শক্ত গিঁট দিয়ে।


তারপরে দিবাচরদের ঘুমানোর সময় আসে। তারা খেয়ে দেয়ে মশারি টাঙায়, দাঁত ব্রাশ করে, একটু টিভির চ্যানেলে চ্যানেলে ঘুরে বেড়ায়। তারপরে হাই তুলতে থাকে। একটা সময়ে কাঁথাচাদর গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়ে। তখন নিশাচরেরা হেসে হেসে দিবাচরদের ঘুমিয়ে পড়া দেখে। শিশুদের ঘুম দেখে যেমন করে নব্যপিতামাতারা স্নেহের হাসি হাসেন, সেরকম একটুকরো হাসি ক্ষয়াজ্যোৎস্নার মতোন তাদের চোয়ালে লটকে থাকে। এইরকম জীবন তারা কবে কতো আগে কয়েকমৃত্যু আগে ছেড়ে এসেছে! কয়েকজীবন পরের একজোড়া নিশাচর-চোখে তারা চেয়ে থাকে।


তারও কিছু পরে ওদের ভুলে তারা আবার কথার গিঁট বাঁধতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আগে বাঁধা কথার সুতোরা অনেকসময়ে হারিয়ে যায়। নিশাচরেরা তাতে খুব একটা উদ্বিগ্ন হয় না। রাতে চলাচল কম হয় প্রাণিদের, এরকম বহুমাথা আর সর্পলেজী কথার সুতোয় অন্যকেউ ভুলেও পা মাড়াবে না। পথের পাশে পড়ে রইলেও বাকিরা সন্তর্পণে এড়িয়ে যাবে। তাই হারানো কথামালা নিয়ে ব্যস্ত হয় না এরা। বরং দেখা যায় নতুন কথার প্রতি তাদের অনেক মনোযোগ, অখণ্ড মনোযোগ।


আরো কিছু পরে নিশাচরদের মাঝে কেউ একজন জোরে শব্দ করে হেসে ওঠেন। শব্দের তীব্র সাইরেন ঠাশ ঠাশ করে দেয়াল ভেঙে দেয়, রেলিঙে হেলান দিয়ে রাখা চৌকি বা কাঠের স্তুপগুলো প্রতিধ্বনির মতো গুড়িয়ে পড়তে থাকে। রেজোনেন্সের মতো শব্দের ঢেউ অনুনাদ-চূড়া-খাদ মাড়িয়ে আসতেই থাকে, আসতেই থাকে। কোনও কোনও দিবাচরের ঘুম সেই শব্দে ভেঙে যায়। তারা চোখ কচলে বিছানা ছেড়ে উঠে পানি খায়, বুকে মাথায় ঝাপটা দিয়ে আবার শুয়ে পড়ে মশারির পেটে।


নিশাচরদের দেখার মতো দৃষ্টিশক্তি ঘুম-চটে-চেয়ে-থাকা দিবাচর-চোখদের থাকে না। এটা অনেক আগে থেকেই জানে নিশাচরেরা। এজন্যে তাদের হাসির শব্দের অনুরণন চলতেই থাকে। প্রস্তর-গড়া-জনপদ-বস্তির চল্‌টা-ওঠা রাস্তায় সেই হাসিগুলো কথাগুলো মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে থাকে। উপরে বিবিক্ত আকাশে এ-ক-ফোঁ-টা আলোও বাকি থাকে না। রাত কতটা গভীর হলো বুঝে উঠতে কোনও এক নিশাচর মুখ তোলে। অন্য-অনেক সর্পিলেরা তাকে নিশ্চিন্ত করেঃ "আরে! দ্য নাইট ইজ স্টিল ইয়াং!"



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন