শুক্রবার, ২৬ ডিসেম্বর, ২০০৮

পুরোনো জন্ম এবং নতুন মৃত্যু


প্রথম খণ্ড


গাড়ীটা চলছিল অনেক জোরে। জানালা খোলা। আমি অনেকদিন চুল কাটাইনি। তুমুল বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল বারবার। আমি ঠিক করার চেষ্টা করছিলাম না। আমার চোখ ঢেকে যাচ্ছিল ঝাপ্টায়, বার বার!


আমরা দুই ভাই এয়ারপোর্ট রোড দিয়ে শাঁ শাঁ করে ছুটে যাচ্ছি। ড্রাইভিং সীটে আমার খালাতো ভাই। বিস্রস্ত মুখে একগাল খোঁচা খোঁচা দাড়ি। বিপজ্জনকভাবে কয়েকটা গাড়িকে এদিক ওদিক করে পাশ কাটালো।


"আস্তে!" "সামলায়ে চালা!"- আমি একটু সচকিত হই!


"আর শালার বাইঞ্চোৎ দুনিয়া!" "আস্তে চালায়া কী লাভ?" - আরো কয়েকটা কুৎসিত জন্মসংক্রান্ত গালি বেরিয়ে আসে ওর মুখ দিয়ে।


দ্রুত মোড় ঘুরে আমরা আরেকটা রাস্তায় ঢুকে পড়ি। ফাঁকা রাস্তা- ঘড়িতে কোয়ার্টজ বলছে দশটা বেয়াল্লিশ।


"বাড়ি চল! আর কত রাস্তায় রাস্তায় ঘুরবি?"- আমার স্বরে হতাশা আর ক্লান্তি ঝরে পড়ে। শেষ কিছু সময় ধরে আমরা এখানে ঘুরছি। প্রায় ফাঁকা রাস্তাগুলোয় গাড়ির গ্যাস পুড়িয়ে চর্কির মতো, আর ওর মাথার ভেতর যেভাবে হিরোশিমা ভেঙে পড়ছে সেটা বুঝতে পেরে আমি থমকে থাকি! এখানে আমার কিছু বলার নাই।


দ্রুত ছায়াবাজি সামলে একটা বিকট ট্রাকের হর্ণ এবং ফ্ল্যাশলাইট আমাদের ঝলসে দেয়ার সাথে সাথেই ঘটাং করে ব্রেকহুইলটা ভেঙে গেল। ওর মুখ একচিলতে হাসি ঝিকিয়ে উঠল আর আমি দেখলাম বুলেট-মোশনে আমরা গাড়িসমেত আইল্যাণ্ডে আছড়ে পড়লাম। জ্ঞান হারানোর আগে তূর্য কাতর কণ্ঠে হেসে দিল না কঁকিয়ে উঠল সেটা আমি টের পাইনি।


---- ---- ---- ---- 


দ্বিতীয় খণ্ড


স্বচ্ছ গ্লাসে বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে। ভেতরে জমানো আইসক্রিম একটু একটু গলনের সূত্র মাপছে। টুং করে গ্লাসের গায়ে একটা টোকা দিল সুমাইয়া। দুয়েকফোঁটা পানি তার নখাগ্র ছুঁয়ে নেমে আসছিল। আলতো ঝাঁকিতে তারা নিচে রাখা টিস্যুতে আশ্রয় নিল। টিস্যুমাতার কোল ছাপিয়ে বিন্দুদ্বয় ব্যাপিত- অভিস্রবিত! সুমাইয়া নখ ঘষে মুছে নিতে নিতে দু'ঠোঁটে টেনে নিলো স্ট্র! ঘোলাটে স্ট্রয়ের ভেতর দিয়ে চকোলেট উঠছে ক্রমশ!


ঘড়িতে সময় দশটা বেজে পঁয়তাল্লিশ। সুমাইয়ার গায়ে শীতল শীতাতপ একটা পরশ বুলিয়ে দিলে সে একটু কেঁপে ওঠে কি? পাশে রাইয়ান বসে ছিল। আরো গাঢ় করে জড়িয়ে ধরে সে সুমাইয়াকে। তপ্ততার সূত্র তখন খেলতে শুরু করে। ইতস্তত বিক্ষেপ অভিক্ষেপ এপাশ ওপাশে দোলনাক্রান্ত-শৈশব বিস্মৃত হয়। সুমাইয়াও উষ্ণ হতে চায়!


তিনমিনিট পরে আবছা জ্ঞান ফিরলে তূর্যও উষ্ণ রক্তপাত টের পায়। আস্তিন ছাপিয়ে রক্ত ছুটছে ট্রাউজার ছাপিয়ে গরম স্রোত নামছে। সম্বিত ফিরে পেতেই পাশ ফিরে আমাকে দেখল ও। আমার পা দুটো দুমড়ে বেঁকিয়ে উপরের দিকে উঠে এসেছে পেটের কাছাকাছি। মুখ ঈষৎ হা। হাত দুটো সরানো। বুক জুড়ে চাপ চাপ রক্ত। গাড়ির উইন্ডশীল্ডের ফাটলে বিকিরিত হয় দূরান্তগামী হেডলাইট।


রক্তে যেন প্লাবন বইছে সুমাইয়ারাইয়ানের। তারা মিশে যেতে থাকলে সে টের পায় প্লাবন নামছে দুই পা জুড়ে। তূর্যের শরীরেও রক্ত বইছে। আমি দর্শক হয়ে যেতে যেতে টের পাচ্ছি তূর্য ঠা ঠা করে হেসে দিচ্ছে। সুমাইয়ার চাপা শীৎকারের সাথে ওর গোঙানি মিশে যাচ্ছে হাইওয়েতে।


---- ---- ---- ---- 


তৃতীয় খণ্ড


সাদা আলোর বেশ কিছু প্রকার আছে। হলুদাভ, নীলাভ অনেকগুলো শেডে সাদারঙ মেলে রাখা যায়। এখন যেমন নীলচে সাদা আলো জ্বলে আছে এখানে। দেয়ালের টাইলসগুলোকেও সেই আলোতে নীল মনে হচ্ছে। ফ্রস্টেড গ্লাস বন্ধ। শীতাতপের ঘন বিজবিজে শব্দের সাথে সহচর শব্দ হচ্ছে আরেকটাঃ পর্যায়বৃত্তিক বিপ্‌-বিপ্‌-বিপ্‌... । সেসময়ে দস্তানাবৃত অপরিচিত দু'হাত তূর্যের বাদামী জীবাণুনাশক মাখানো লোমহীন-ত্বকহীন পা থেকে পায়ের টিস্যুগুলো কেটে ফেলছিল। তীব্র সাদা আলোটাও সেখানে হা করে রাখা হাড়মাংসের পাশে ছটফট করছিল। 


কালো হয়ে যাওয়া মরা টিস্যুগুলোকে ডাক্তারের কেটে ফেলা খচাখচ- সে দেখতে পারছিল না, কারণ চোখে সাদা গজ্‌ খুব শক্ত করে আঁটা। নাকেমুখে কয়েকগণ্ডা নল, অ্যানেস্থেটিকে ফুসফুস আর মস্তিষ্ক ভরা। ঘি'রঙা-দস্তানাতে রক্ত মিশতে থাকে, যেভাবে সুমাইয়ার ফর্শা উরুতে রক্ত মিশছিল। তূর্যের শরীরে ছোপ ছোপ শ্লেষা মিশেছিল তখনও! চিল-চিৎকার দিয়ে সে পৃথিবীকে জানাচ্ছিল তার ইশতেহার। ক্ষুদ্র হাত-পা অব্যবহৃত চলনে তৎপর! সুমাইয়া ক্লান্ত হেসে দিচ্ছিল। রাইয়ানের ঢেকে রাখা মুখে শুধু চোখের ঝিলিক দেখে সে বুঝে নিচ্ছিল যে তার সন্তান ঠিকঠাক জন্মেছে। 


এখানে দস্তানা-সমূহ তূর্যের পা ড্রেসিং করে দিতে ব্যস্ত। আরও দু'দিন পরে তার শরীর জুড়ে লেন্সবাচক-চোখ স্থির হলে শিশু-তূর্য আর তরুণ-তূর্য ফ্রেমজুড়ে মাখামাখি হয়ে যায়। 


কেন্দ্রে শুধু সুমাইয়ার হাসিটুকু অমলিন চেয়ে থাকে। 


---- ---- ---- ----
(সমাপ্ত)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন