মঙ্গলবার, ১২ মে, ২০০৯

কবি বলেছেন, "ভালোবাসা খুব খ্রাপ"

প্রথমত, ভালোবাসার ব্যাপারে বহুল ব্যবহৃত প্রপঞ্চটি হলো "প্রেমে পড়া"। আমরা স্বভাবতই কারো প্রতি ভালোবাসায় 'পড়ি', কাউকে ভালো লাগে এবং প্রেমের প্রবল তাড়নায় আমরা 'পতিত' হই। এই পতনে লাগে সুখের মতোন ব্যথা. (কবিগুরুর জয় হউক)। এখানে আর কোন ভাল শব্দ নেই ভালোবাসার প্রাথমিক আরম্ভ ব্যাখ্যা করার জন্য। এবং এখানেই সবচেয়ে বড়ো সমস্যা, বা বলা যায় সমস্যার শুরু। আপনি কোন এক জাদুকরের তুকতাক মন্ত্রচালনায় পড়ছেন, পড়ছেন, পড়ছেন। কেউ যেন ভুলিয়ে ভালিয়ে আপনাকে এই খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছে। চোখ খোলা আছে, সব দেখে শুনেই আপনি অভিকর্ষজ ত্বরণের চাইতেও দ্রুতবেগে ভালোবাসায় পড়তে থাকেন। এবং সকল জাগতিক পতনের মতো, এই সর্পিল গতিপথেরও একটা নিম্নতল আছে। সেই 'রক বটম'-এ পৌঁছানো মাত্রই যে প্রবল আঘাত, জ্ঞান হারানোর মতো বিমর্ষ-জ্বালা, তা কেনই বা আমাদের সহ্য হবে? তখন কি সকল স্নায়ু, মনন, শরীরে সেই যাতনাই ফুটে উঠবে না?

দ্বিতীয়ত, ভালোবাসা অন্ধ। আমরা যখন ভালোবাসি, প্রেমে পড়ি, অন্ধের মতোই আবেগিক প্রবাহে ভেসে যাই। চোখ মুখ বন্ধ করেই আমরা সেই পথে হাঁটা শুরু করি। এবং ইন্দ্রিয়ের অন্ধত্বহেতু সেই ভালোবাসা আমাদের যেভাবে চালায়, আমরাও সেভাবেই চালিত হই। এটা আপনার পক্ষে বুঝে ওঠাও সম্ভব নয়, যতক্ষণ না সেই পট্টি চোখের উপর থেকে সরছে। আমরা যখন আর ভালোবাসি না, কেবলমাত্র তখনই ধরা পড়ে আমরা কতটা মেষশাবকের ন্যায় ভালোবাসার অলিতে গলিতে ঘুরে মরেছি।

তৃতীয়ত, ভালোবাসা বড়োই যাতনাময় (আবারও কবিগুরুকে স্মরিছে মন)। আপনি যখন প্রেমে পড়বেন, আপনার অনেক অনুভূতিই বিশ্লেষণের বাইরে চলে যাবে, বা বলা যায়, উদ্দিষ্টের অগ্রাহ্যের শিকার হবে। যা কিনা মনের মাঝে এক বিষণ্ণ শুন্যতার সৃষ্টি করে। কেবলই মনে হয়, এই যাতনাভার, এই অনপনেয় দুঃখবোধের যেন সীমা নেই। অনুভূতির প্রত্যুত্তর না পেলে যে অভিমান জমা হয়, তা প্রবল স্রোতের মত কানাগলিতে দাপড়ে বেড়ায়। অনেকের জন্যে (হয়তো সবার জন্যেই) এই অনিচ্ছুক অবহেলা কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। "কেন সে আমায় বুঝিলো না, মনের মাঝে উঁকি দিয়া কেন জানিয়া লইলোনা আমি কী ভাবিয়াছি তাহাকে নিয়া দিনমান"- এই প্রবল অভিমানের সময়, আমাদের অন্ধ-আবেগ একবারও এই বোধ পায় না যে আমরা তো নিজেদের কাছেই অচেনা। অপরে (সে যতোই ভালোবাসুক না কেন) কীভাবে জানবে আমার মনের খুঁটিনাটি অপ্রকাশিত কথা?

চতুর্থত, "ভালোবাসা ও যুদ্ধে সকলই জায়েজ", এই আপ্ত-বাক্যের মধ্যেই সকল দুঃখের বীজ লুক্কায়িত। যুদ্ধের মতোই, ভালোবাসা এক নিরন্তর প্রতিযোগিতা। আমাদের মনে তা মানবিক, কিন্তু চিন্তা করে দেখলে, তা আসলে রাজনৈতিক। ভালোবাসার ব্যাপারে আমরা আড়ালে হিংস্র প্রতিযোগী একে অপরের। আমরা বারবার জিততে চাই; আকাংক্ষা করি যাকে, তার ভালোবাসা পেতে চাই। একইভাবে আরো অনেকেই হয়তো প্রার্থিতের সারিতে দাঁড়িয়ে আছে। তাদেরকে আমরা হারাতে চাই একনিষ্ঠতা দিয়ে। আমার অনুভূতি বা একাগ্রতা, আরেকজনের চেয়ে বেশি হবে- এটাই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। কিন্তু সম্ভাবনার অঙ্কই বলে যে সেই যুদ্ধে (!) আমাদের হারের হার অনেকখানি। এমনকি জিতে গেলেও, ভালোবাসার মানুষটির সাথেও চলে টানাপোড়েনের দ্বৈতযুদ্ধ, এবং সেখানেও নিলামে ওঠে আমাদের আদি ও অকৃত্রিম ভালোবাসা-ই।

পঞ্চমত, এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ, ভালোবাসার নিক্তিতে মাপলে আপনার ভালোবাসা খুব উল্লেখযোগ্য বিষয় নয়। আমাদের সকলের অনুভূতির তীব্রতা, প্রেমে পড়ার মুহূর্ত থেকেই মোটামুটি একই রকম থাকে। একই আবেগের দোলাচলে আমরা তাড়িত হই, যদি না কেউ নিজেকে ইরোস বলে দাবি করেন। বিভিন্ন মানুষ আলাদা আলাদাভাবে প্রেমে পড়ার পরেও, সবার ভালোবাসার দাম সমান। সম্পর্কের বাজারে যে জিনিসের দাম সমান, এবং যোগান প্রচুর, তার জন্যে তাহলে আমরা কেনই বা মাথা কুটে মরি? তার জন্যে কেন বেহিসেব বিনিদ্র রজনী যাপন, চাপা দীর্ঘশ্বাস নির্গমন, চোখের কোণে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুদাগ মোচন? ঘুমিয়ে পড়ার পরে স্বপ্নে সেই ভালোবাসা বা ভালোবাসার মানুষকে ক্রমশ হারিয়ে ফেলার দুঃখবোধ আমরা কেন পুষে রাখি?

যাকে উদ্দেশ্য করে আমরা আমাদের যাবতীয় কোমল আবেগ নিবেদন করি, যদি সে মূল্য না দেয়, তাহলে তার আদৌ কোন উপযোগ নাই। আর এই মূল্যসূচক নির্ধারণের জন্যে চোখে আঁটতে হয় ধৈর্যের চশমা, কাঁধে চড়াতে হয় সহনশীলতার চাদর। তারপরে অজস্র দিনরাত, যাপিত-জীবনের সময়কালকে কাগজ ভেবে লিখে রাখতে হয় ভালোবাসার হিসেব। এতকিছু জানার পরেও আমরা ক্রমাগত প্রেমে পড়ি, ভালোবাসি, দয়িতের মুখে সুখ খুঁজি। ভালোবাসায় নিপতিত, আপতিত আর পতনোন্মুখ সকলের জন্যে শুভকামনা রইলো। ওদিকে দেখি একা বসে কবি বলছেন, "ভালোবাসা খুব খ্রাপ"।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন