রবিবার, ২৪ মে, ২০০৯

বেশ্যানগর

বেশ্যানগরে রাত দশটার পরে বিকটাকার ট্রাক প্রবেশ করে। বলা উচিত ঘোঁত ঘোঁত করতে করতে ঢোকে। দুর্দান্ত বেগে, সজোরে, এবং নির্ভুল লক্ষ্যে। তার আগে, বিকেল থেকে সন্ধ্যা গড়িয়ে গড়িয়ে, ধীরে ধীরে পড়তে থাকে এই গ্রীষ্মে। দমফাটা গরমে ছয়টার কাঁটা ঘড়ি ছেড়ে পারলে বেরিয়ে আসতে চায়। সাড়ে ছয় পেরিয়েও গরম বাতাসের আঁকুপাকু শ্বাস থামে না। তারপরে কালশিটে পড়লে, রাস্তার বুকের ওপরে, কোমল শিথিল সিএনজি বা গাড়ি চলাচল করে। তাদের ধুকপুক গরম ইঞ্জিনের দাগ লেগে থাকে ফ্লাইওভার কিংবা বিলবোর্ডের গায়ে। ক্লান্তচলন ছেড়ে একসময় তারা গৃহস্থের ঘরে ফেরে, গ্যারেজে, গোডাউনে, ছাদের তলায়। তারপরে ক্রমশ শান্ত হবে রাজপথ, ভেবে সকলেই ঘরে ফিরতে চায়। সেসময়ে, এই বেশ্যা নগরে ঠিক কয়েক মুহূর্তের জন্যে হলেও একটা নিঃস্তব্ধতা নেমে আসে।


ফটকের এপাশে ওপাশে পথের চিহ্ন প্রকৃতি আলাদা। ওপাশে কাঁচা ইট, এপাশে ঘন কংক্রীট। তারপরে ধীরে পথ হয়ে ওঠে পিচগলা আলকাতরা-গোলা। ট্রাকের শরীরের ভীড়ে, হেডলাইটের তীব্রতা ছড়িয়ে পড়ে সেই নরোম নালীতে-উপনালীতে-গলিতে-উপগলিতে। পাড়া সজাগ হয়ে যায়। ঘরের বাতি নিভিয়েও ঘামভেজা মিশ্রিত শরীরে উল্কি এঁকে দেয় ট্রাকের শিস। শীৎকারের শব্দ ছাপিয়ে সবাই শুনতে থাকে, সারি সারি ট্রাক নেমে আসছে, জড়ো হচ্ছে! তাদের জমায়েতে অশ্লীল চালক সমবায় সমিতির হলুদ-দেঁতো নেতা হাত তুলে রাখেন। সবাই নীরবে তাঁকে অনুসরণ করে। পথের মাঝে তখনও বিচ্ছিন্ন কয়েকটা সিএনজি ঘুরছে। মালিকের জমা টাকার পরে, নিজের ঘরের জন্য কিছু উপার্জনের আশায়। এখনও বউয়ের কাছে ফিরতে পারেনি, রাতের বাজার সেরে, এমন ঘষটানো চাকুরে বলদগণের বাহন হওয়ার ধান্দায়।


মিরপুর দশের মোড়েই রাত জমে থাকে দশটার পরে। সেখান থেকে কাকলি রেলগেইট, খালি দশ খালি দশ খালি দশ। সিএনজিওলা হাঁকে। সওয়ার চারজন হলেই দে-ছুট। ছুটে ট্রাকের পিছনে পিছনে, ওভারটেকের সাহস নাই। একটু পরে সেটা সামনে থেকে সরে যায়। আরেকটা ট্রাক দেখা যায় রাস্তার মোড়ে আড়াআড়ি খুব শিথিল পড়ে আছে। একবারে সে উল্টো ঘুরতে পারে না, বেশ্যানগরের নালীগুলো অনেক সরু। দু'পাশে প্রচুর ফুটপাত ছাপানো হকারের টং। নীল নিরোধক পলিথিনে মোড়ানো ছাপড়া। সেগুলোকে বাঁচিয়ে শক্ত ট্রাকের উল্টো ঘুরতে দু'বার আগুপিছু হওয়া লাগে। আস্তে আস্তে তার প্রগমণ দ্যাখে নীরব সিএনজি। তারপরে একটু ফাঁকা পেয়েই সেই দানবের পেছনের চিপা আইল্যাণ্ড উপড়ে সে ছুটে। যাত্রীগুলো একটু ঝাকুনিতে একে অপরকে আঁকড়ে ধরে সামলায়। কম্পাঙ্ক বাড়লে আমরা হয়তো অপরিচিতকেও আপন ভাবি।


দশটার পরে মাইয়্যা, মাগীরাও নামে। ঘোমটা দেয়া সারি সারি মেয়েরা সূর্যের সাথে ওঠে, চাঁদের সাথে ডোবে। সোডিয়াম আলোর উজ্জ্বলতায় তারা ঘরে ফিরে। ভোরে আবার সেই আলোর ম্রিয়মাণ চোখের ওপর দিয়েই তারা কাজে বেরুবে। এই মাইয়্যাগুলার দু'পায়ের ঘন ওঠানামা, হাতের পর্যাবৃত্ত মন্থনের ওপর নির্ভর করছে এই বেশ্যানগর। স্থূলাঙ্গী, শীর্ণাঙ্গী, শাদা, শ্যামলা হাজারো নারীকে সাজিয়ে রাখতে খুপরি খুপরি ঘরে তীব্র আলোতেই তারা সেলাই হয়ে যায়। সেই নীরব ঘটাং ঘটাং সূঁচ তাদের শরীরে কোন দিক দিয়ে ঢোকে আর বের হয় কে জানে? এমন সেলাই, দাগও থাকে না শালার! এই মাইয়্যাগুলা ট্রাকের পথের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে ফিরে। তাদের মাঝ থেকে কেউ কেউ ট্রাকের সাথে মিশে হারিয়ে যায়, পরের দিন সেলাই হওয়ার আগেই।


আরো কেউ কেউ এই শুনশান নগরে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ে। দুগ্ধফেননিভ শয্যায়। শুভ্রকুসুমিত ব্রীড়া শতফুটো চাদরে মাখা থাকে। মলিন লুঙ্গি তুলে তাদের স্বামীরা পাশে শোয়। সারি সারি শরীর, সারি সারি ঘাম, থাম, আলো, চিৎকার, ঘুম, মরণ। এভাবে শহরের রাত বাড়তেই থাকে। চাঁদের কলার সাথে তুলনাবাজির দিন শেষ। এখন ঋতুস্রাবের দিনের সাথে তুলনা খুবই মোক্ষম মিলে যায়। এক মাসে সেটা মিস হলেই সকলে সজাগ হয়। এমআর এমআর বলে কিশোরী-যুবতী ছুটে ছুটে আসে আরো হাজারো সাজানো বিগলিত শুভ্র বিছানায়। সেখানেই তাদের শরীর থেকে মুক্তো বেছে নেয়া হয়। এই শহরের ঝলমলে আলোকসজ্জায় খুব দরকারি সেসব মুক্তো। ঐ মাইয়্যা-মাগীরা কী করে জানবে সেই কথা?


ট্রাকের চালকেরাও একদিন ক্লান্ত হয়। বেশ্যানগরের ফটক বার বার পার হতে হতে, পার হয়ে যেতে যেতে তারা যখন শুনতে পায় খোপ খোপ খোঁয়াড় থেকে গৃহস্থরা বেরিয়ে আসছে। ফুটপাত থেকে উঠে আসতে থাকে মাইয়্যারা, খুপরি থেকে হকারের স্যান্ডলের শব্দও পাওয়া যায়! এভাবে দলে দলে কোটি কোটি মুখ, কোটি কোটি ঘামকণা। তরল আগুনচাষী সূর্যের আলো বেরুনোর আগেই তারা জমায়েত হয়। তাদের জমায়েতের উদ্যান এই বেশ্যানগরে একটাও নাই। তারা ঘরের ব্যালকনিতে জমা হয়। ওভারব্রীজের ওপরে জমা হয়। মরাধ্বজা লেকের পাড়ে জমা হয়। কনস্ট্রাকশন সাইটের বালুতে তাদের বিষণ্ণ ছায়া পড়ে। ছায়া কেঁপে কেঁপে ওঠে। এই বেশ্যানগরে তাদের অনবদ্য ইতিহাস হা, হা করে শ্বাস নিতে নিতে একদিন গুমখুন হয়ে যায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন