রবিবার, ১৭ মে, ২০০৯

অকালপক্ক!

আমার পিতার মাথার চুল প্রায় শাদা। মধ্য তিরিশেই তাকে দেখতাম মাঝে মাঝে ছুটির দিনে হাতে একটা শণ্‌ (চিমটা) নিয়ে আয়নার সামনে গিয়ে চুল বাছতে। তারপরে একটা সময়ে পাকাচুলের সংখ্যা এত বেড়ে গেল যে সেগুলো বাছার খুব একটা দরকার পড়েনি। বেশ কাঁচাপাকা একটা ধূসরতা তাঁর মাথার ওপরে মেঘের মত বসে যায়। চোখের ওপরে মোটা ফ্রেম আর ভারী কাচের চশমায় তাঁকে ঋষিসুলভ লাগে আমার! সময়ের সাথে সাথে মাথার উপরের সেই মেঘ আরো ফর্সা, আরো সুন্দর হয়েছে।

আমার মাথায় প্রথম পাকাচুলের আভাস পেয়েছিলাম যখন দ্বাদশবর্ষে পড়ি। সেসময়ে ক্লাশ সাসপেন্ড হয়ে গেছে। পরীক্ষার আগে সারাদিন ঘরে বসে পড়াশোনা করি। পড়ার সময়ে নখ খোঁটা, চুল এলোমেলো করা আমার বদভ্যাস। সেই সময়েই একদিন আবিষ্কার করি একটা বেশ লম্বা চকচকে সাদা চুল সামনের দিকে অনেক কালোচুলের ভীড়ে হিহি করে হাসছে! অতি দ্রুততায়, কেউ দেখে ফেলার আগেই ওটাকে উৎপাটন করলাম। তারপরে অনেকক্ষণ চোখের সামনে ধরে রাখলাম। কী আশ্চর্যজনক একটা নতুন জিনিশ। আমার মাথার প্রথম পাকা চুল! তখনই আঁতিপাতি করে খুঁজলাম, আর পাই কী না, কিন্তু না, বাকিরা ইন্সপেকশনের সময়ে বিলকুল কালোচেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।

তারপরে অনেকদিন খেয়াল করিনি, দুয়েকবার চোখে পড়েছে শাদা ঝিলিক। কিন্তু প্রথম পাওয়ার সেই উত্তেজনা আর বোধ হয়নি। সব অনুভূতিই খুলে-রাখা-মুড়ির মত পোঁতায় যায়। টের পেতাম যেদিন চুল কাটাতে যেতাম। নরসুন্দরের দোকানে আজকাল ছেলেরাও রূপচর্চা করে। ফেস্যিয়াল, ব্লীচিং, কালারিং ইত্যাদি নানারকম চৌকস রূপায়নবিদ্যার খবর পেয়েছিলাম এক প্রগলভ ও ব্যাকুল নরসুন্দরের কাছে। সে খুব করে চাইছিল আমার মাথাকে রঙে রাঙাতে, বা আমার মুখের অবাঞ্ছিত লোম উৎপাটন করার। আমার খোমাসৌন্দর্য নিয়ে সে বড়োই উদ্বিগ্ন। তখন তার অতিউৎসাহে ভাঁটা দিতে আলোচনা ঘুরিয়ে দিয়েছিলাম। সেই সুবাদে জানতে পারলাম মেয়েদের মতো, ছেলেরাও ভ্রূ-প্লাক করে। প্রৌঢ়দল আজকাল কলপ মাখে না, ওটা খ্যাত। এখন মেহেদি দিয়ে চুলকে করে ফেলা হয় আগুন-কমলা রঙ, দৃষ্টি আকর্ষক এবং হাল ফ্যাশান। তারা পাশাপাশি কান ফুটাও করে থাকেন। বলার সময়ে তিনি আমার কানের উপরের চুলে কাঁচি চালাচ্ছিলেন, ভয়ে আমার হাত পা...

পকেটে টাকা নেই এই অজুহাতে সেদিন তার কালার আর ব্লীচের হাত থেকে বেঁচেছিলাম। তারপর থেকে আরো কমদামি, এবং ওপেন-স্পেস সেলুনেই আমার যাতায়াত, সেখানে এত রকমারি বিলাসিতার চাহিদা বা যোগান কোনটাই নেই। তখন থেকেই আমি এটা নিয়ে ভেবেছি। ছেলেদের মাঝে কেন এই সৌন্দর্যসচেতনতা বা রূপ-সজাগবোধ? এটা নিশ্চয়ই স্কুল-কলেজ-পরিবার-বন্ধুমহল থেকেই সবাই শিখছে (যেভাবে আমি নিজের "রূপ-বিমুখতা"(!) শিখেছি)। সেখানে কী অবস্থান থেকে এই বোধ কিশোর বা তরুণদের মনে পৌঁছায় সেটা বুঝে ওঠার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি বলেই সেই সব সেলুনে যেতে আমার এত অপারগতা।

তবে চুল কাটলেই আজকাল নাপিত কলপের কথা তুলে। "ভাইজান, সাইড দিয়া চুল তো অনেক পাইকা গ্যাসে। কলপ লাগাইবেন নিহি?" এই চালুপ্রশ্নে আমি আনুভূমিক মাথা দুলিয়ে চলে আসি। কয়েকদিন খোঁচা খোঁচা সাদা ঝিলিক চোখে পড়ে, সকালে দাঁত ব্রাশ করার সময়ে। তারপরে অন্য চুলের মিছিলে তারা একটু ম্রিয়মাণ হয়ে লুকিয়ে যায়। আমি স্বস্তিতে থাকি। বয়স যতোই বাড়তে থাকে, ততই আমরা তরুণ হতে চাই মনে হয়, অনেকটা ভাঁটার টান ধরলে তাড়াতাড়ি তীরে উঠে আসার তাগিদের মতো।

তবে এখন বেশ অন্যরকম হাল্কা অনুভব হচ্ছে। মাঝে উইক-এণ্ড ছিল বলে দাড়ি কাটিনি কয়েকদিন। আজকে সকালে অফিসে যাবার আগে আয়নার সামনে খুব ভাল করে খেয়াল করলাম। তিন-চারটা শিশুতোষ শাদা রোঁয়া থুতনির কাছে 'হ্যালো! হাউ আর ইউ স্যার?" বলে উঠল! আমি থতমত ভঙ্গিতে তাদেরকে ফিরতি সম্ভাষণ জানালাম। তারপরে ততোধিক শাদা ফেনায় মুখ-চোয়াল ঢেকে নিলাম। ফেনার তলে চোয়াল নিজের অজান্তেই দৃঢ় হয়ে এলো। হাতে উঠে এলো "সচেতন পুরুষের আস্থা" জিলেট রেজর! ঘ্যাচাঘ্যাচ-ঘ্যাচাং টানে শিশুপাকাদাড়িগুলো ফেনায় মুড়ে নামিয়ে ফেললাম।



আআহ! কী শান্তি!


***

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন