বৃহস্পতিবার, ৬ মে, ২০১০

রবীন্দ্রনাথ!


মাঝে মাঝে তুমি খুব নিবিড়ে ছুরি গাঁথো
মাঝে মাঝে আমি চোখ দিয়ে তোমাকে চিরে ফেলতে পারি
মাঝে মাঝে আমাদের দিনগুলো ঘোলাটে কাচ হয়ে ওঠে

কোন কোন মানুষকে 'কোয়ান্টিফাই' করা যায় না (কোয়ান্টিফাইয়ের ভালো বাংলা পাচ্ছি না, তুল্যমূল্য ধরনের কিছু নাকি?)। আর কাউকে বুঝে ওঠার জন্যে অনেকরকমের বিষয়-আশয় মাথায় রাখা লাগে। এটাও ঝঞ্ঝাটের ব্যাপার। যেমন ধরুন, ছোটবেলায় কোন একটা গান শুনেছিলেন। ছোট মানে ততোটা ছোট, যখন গান শুনে কথাগুলো বুঝতে বা মনে রাখতে পারবেন। তারপরে মাঝের বিশ বছরে সেটা শোনাই হয় নি। এরপর হুট করে একদিন কোন এক কুঠুরি থেকে ক্যাসেট বের হলো, ধুলো ঝেড়ে চালানোর পরে ঘাই মেরে সব স্মৃতি জেগে উঠবেই। গানের সুর, কথা মাতাল করে দিবেই। গানটার কারিগরি উপাদানের ভালো লাগার চেয়ে আপনার ব্যক্তিগত স্মৃতি বেশি জরুরি হয়ে যাবে। তখন কেউ আগ বাড়িয়ে চশমা নাড়িয়ে সুরজ্ঞান দিতে আসলে আপনার রাগ হওয়া বিচিত্র নয়।
ভাবতে বসেছিলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে। চতুর্মাত্রিকে ঢুকেই লালচে-আগুন আর শ্যামল-সবুজ দু'টো ব্যানার পেলাম। আমাদের যাপিত জীবনে রবীন্দ্রনাথ মোটেই জয়ন্তীতে পালন করার মতো বিষয় নন। আমি নিজে অনেক বেশিই নির্ভর করি তাঁর উপরে। তবুও উদ্দেশ্য পেলে বিধেয় খুশি হয়, তাই রবীন্দ্রনাথের জন্মদিনে তাঁকে একটু বিশেষভাবে মনে করতে চাইলাম। আমি তেমন হোমরাচোমরা কেউ নই, রবীন্দ্রনাথের ওপরে অভিসন্দর্ভও লিখি নাই, সেমিনার-আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তৃতাও দেই নাই। তাঁর উপস্থিতি বা গুরুত্ব আমার কাছে একান্তই আমার বিচারে, আমার চিন্তনে। তাই এই বেলা অন্যসব গুরুবিদ্যা দূরে থাক!
বাংলা পাঠ্যবইয়ের একটা ভালো দিক হলো রবীন্দ্রনাথের সাথে আমাদেরকে ছোটবেলা থেকে পরিচয় করিয়ে দেয়া, খারাপ দিক হলো সেই পরিচয়টা বেশিরভাগ সময়েই অনেকটাই ভ্রান্ত হওয়া। পাঠ্যবইয়ে কবিতা, ছড়া আর ছোটগল্পগুলোকে কেটে ছিঁড়ে মোটামুটি ফালি ফালি করা হয়। শব্দার্থ, সারমর্ম, ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, শব্দ আর বাক্য ধরে আলোচনা করে করে রবীন্দ্রনাথের পিণ্ডিও চটকে দেয়া হয় ভালোমতোন। রবীন্দ্রনাথ হয়ে পড়ে ফররুখ আহমদের সমমানের রচয়িতা, দু'জনের প্রশ্নের উত্তরেই নম্বর সমান। সবার ক্ষেত্রেই প্রথাগত শিক্ষার গণ্ডির বাইরে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে আসল পরিচয় ঘটে! সেই পরিচয় বড়ো রহস্যময়, প্রেম-ভক্তি-জাদু মিশ্রিত রঁদেভু'র মতোন।
প্রতি শুক্রবারের ছুটির দিন সকালে দেবব্রত আর কণিকা গান গাইতেন আমার বাসায়। ঘুম ঘুম চোখ মেলতেই 'শীতের হাওয়ায় লাগতো নাচন', হোক না তখন প্রখর গ্রীষ্ম। মাঝে মাঝে সকালের খাবারের টেবিলে 'বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বাণী' হয়ে আসতো গরম খিচুড়ির ঘ্রাণ, এই সবেই মিশে থাকতো তাঁর উপস্থিতি। যদিও তাঁকে ঠিকমতো চিনি নি তখনও, তাই মনে হতো 'আমার বেলা যে যায়' গানটা কেউ একজন সারাদিন নিরুপায় বসে থেকে লিখেছেন। এই শিশুতোষ কল্পনা লাগাম ছাড়া হলো যখন 'বীরপুরুষ' আর অন্যান্য কিশোর লেখার সংকলন পেলাম উপহারে। বইটার নাম ছিলো "কৈশোরক"। রবীন্দ্র-রচনাবলির কিশোর উপযোগি লেখাগুলো নিয়ে সংকলন এটা। ছড়া, কবিতা, ছোটগল্প, নাটক, কী নাই? সেইখানেই আমার প্রথম কল্পনার জাল ছড়ানো চিন্তার শুরু। ছোটবেলাতেই মুগ্ধ হলাম, বিস্মিতও কিছুটা।
ফটিক বলাইদের সাথে পরিচয় ঘটলো, দেখা হলো অমলের সাথে, কাবুলিওয়ালার মিনি'কেও পছন্দ হলো খুব!
সেখানে আরো পেলাম কেষ্টা বেটাকে, তাকে কেন সবাই চোর ঠাউরাচ্ছে, ভাবতেই খারাপ লাগলো। মন খারাপ হলো উপেনের জন্যেও, বাবু তার দুইবিঘা নিবেই নিবে যে!
কালো কৃষ্ণকলির প্রেমে পড়লাম আরো একটু বড়ো হয়ে, লোকে কি বলে সেটার কেয়ার তো আমি নিজেও করি না!
এইট পাশের পরে কে যেন খোঁজ দিলো গল্পগুচ্ছের। আমাকে বললো, এই ছোটখাটো লেখা পড়ে কী করবি? রবীন্দ্রনাথের আসল ঐশ্বর্য গল্পে, সেগুলো পড়। আমি ঝাঁপ দিলাম, অতলে। ভেসে উঠলাম কয়েকদিন পরে, যখন গোগ্রাসে পড়ে ফেলেছি 'ইচ্ছাপূরণ', পেটের ব্যথার ভান করে আমিও তো অনেকসময় ইশকুলে যেতে চাইতাম না। সেটা মনে হয় রবীন্দ্রনাথ টের পেয়ে গিয়েছিলেন। 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন' পড়ে মনে হলো রাইচরণের মতো আমারও যদি কেউ থাকতো! 'গুপ্তধন' গল্পে পেলাম ধাঁধা:
রা নাহি দেয় রাধা
পায়ে ধরে সাধা
শেষে দিলো রা
পাগোল ছাড়ো পা
হৈমন্তী, অতিথি আর সমাপ্তি গল্প তিনটির ব্যাপারে কিছু বলাটাই বলে হয় বাতুলতা হবে।

রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে অনুভূতিগুলো ছাড়াছাড়া হয়ে যায়, তাঁর রচনার মতোই ব্যাপ্ত হয়ে পড়ি। বাংলা কবিতায় রোমান্টিসিজমের পুরোধা তিনিই। সাধারণত রচনার ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেক লেখকই কোন নতুন ধারার সূচনা করলে সেটাতে দক্ষতা দেখাতে পারেন না, পরের কেউ এসে সেখানে অসম্ভব সব কাজ করেন। রবীন্দ্রনাথের বেলায় সেই সূত্র খাটে না। তিনি একাই যে রোমান্টিসিজমের চর্চা শুরু করেছিলেন, বাঙালির অন্তরের 'আমিত্ব'কে যেভাবে প্রকাশ করেছিলেন তেমন সৌরভ আর কারো পক্ষেই ছড়ানো সম্ভব হয় নি। মনের রুক্ষতম রাগ, হিংসা থেকে শুরু করে গাঢ়তম আবেগ পর্যন্ত, কোমলশ্যামল রূপ থেকে রুদ্রতার বয়ান সবখানেই রবীন্দ্রনাথের ছোঁয়া। এবং বহুমুখিতার রূপায়ন এতোটাই বৈচিত্রময় যে, সবার মনেই লেখাগুলো নিয়ে অনুভবের একটা সাধারণ মন্তব্য হলো, "আরে! আমি নিজেই তো এভাবে চিন্তা করি। আমার মনের এই কথাটা রবিবাবু জানলেন কেমন করে?!"
সম্ভবত এখানেই রবীন্দ্রনাথের মুন্সিয়ানা। দেড়শ' বছর আগে জন্মেও যে কোন যুগে, যে কোন মানুষের মনের গহীনে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেন তিনি। তাঁর এই ঈর্ষণীয় ব্যাপনক্ষমতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, তার দেড়শতম জন্মদিনে!
শুভ জন্মদিন রবিবাবু, শুভ জন্মদিন বুড়োবাবু!!
***

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন