বৃহস্পতিবার, ২৭ মে, ২০১০

নতুন যুদ্ধ! স্মৃতিরক্ষার যুদ্ধ!

কাচের বড়ো বড়ো শোকেসগুলোতে থরে থরে সাজানো কতোগুলো কঙ্কাল-- মাথার খুলি, পাঁজরের হাড়, ফিমার, হিউমেরাস, রেডিও-আলনা, টিবিও-ফিবুলাঃ এগুলো সব হাত আর পায়ের হাড়। খুলির কারো কারো দাঁত নেই, কারো কারো দাঁত আছে। কঙ্কালগুলো নতুন না। হাড়ের গায়ে খয়েরি দাগ, বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সেটা রক্তের। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞেরা এই হাড় ও খুলির পরীক্ষা করেছেন, সংরক্ষণের জন্যে ধুয়ে মুছে এখানে পাঠিয়েছেন আর স্মৃতির জাদুঘরে সেগুলো থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। জাদুঘরটি আমাদের। স্মৃতিগুলো আমাদের। হাড়গুলো আমার পূর্বপুরুষের।
আজকে দৈববলে ঢাকার মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে পা পড়লো আমার। মক্কার লোক যেমন হজ্জ পায় না, আমিও তেমনি এতোদিন ঢাকার জল-কাদায় বসবাস করেও এই জাদুঘরে যেতে পারি নি। ব্যর্থতা পুরোপুরি আমার, আর অল্প একটু জাদুঘর বানানো লোকজনের, এমন চিপার মধ্যে, গলির ভেতরে আড়াল করে কেন এটা বানিয়ে রেখেছে আমি তা জানি না। বিস্ময় লাগলো এই অভাবনীয় স্মৃতিগুলোর সংরক্ষণের ব্যবস্থা দেখে! গার্ডগুলো মরা-শুকনো, নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। এই যে মহামূল্যবান সব নিদর্শন, যা দেশের কোনা কোনা থেকে মানুষেরা যুদ্ধের স্মৃতি হিসেবে আগলে রেখেছিলেন, আর এখানে পাঠিয়েছেন, সেগুলোর কিছু হলে কী হবে ভাবতেই খারাপ লাগছিলো।
তবে এই খারাপ লাগাটা শুরু হয়েছে শেষের দিকে। তার আগে মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম জাদুঘরে রাখা প্রাচীন সব রত্নগুলোকে। একটা ব্যাপার খুব চমৎকার লেগেছে, তা হলো দ্রব্যগুলো সাজানোর পন্থা। খুবই যত্ন নিয়ে, সময়কালের বিভেদগুলো পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে সাজানো ছিলো। এক একটা ঘর এক একটা যুগ, এক ঘর থেকে হেঁটে আরেক ঘরে গেলেই প্রজন্ম বদলে যাচ্ছে! অভাবিত রোমাঞ্চ বোধ করছিলাম।
প্রথম ঘরটিতে প্রাগৈতিহাসিক বঙ্গ, বা বাঙ্গালা, বা ভারতবর্ষের কিছু নিদর্শন। গ্রীকরা যখন দাপটে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল কাঁপিয়ে বেড়িয়েছে, সেসময়কালীন দক্ষিণ এশীয় এই জনপদেও আর্য-অনার্য-দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী দাপটের সাথেই বসবাস করতো। পলল মাটিতে তাদের সেই চিহ্ন খুব বেশি নেই, তবুও অল্প একটু আলো দেখেই সেইসময়ের কিছু কিছু ধারণা পেলাম। এদের পরে এলো মৌর্যের শাসন, বৌদ্ধসম্রাট চন্দ্রগুপ্ত, অতীশ দীপঙ্কর-- অহিংসতা। এই জিনগত বৈশিষ্ট্য এখনো হয়তো কিছুটা বাকি রয়ে গেছে আমাদের মাঝে! তারপরে পালবংশ ও সেনবংশের হাত বদলে মুসলিম রাজ- সেখান থেকে ব্রিটিশরাজ। এই সময়কালগুলো ঘর থেকে ঘরে যেতে যেতে পেরিয়ে যাচ্ছিলাম। থমকে গেলাম একটা বদ্ধকুঠুরির সামনে এসে।
একটা কালো দেয়ালের ঘরের মেঝেটা লাল রঙ করা। ভেতরে দুটা ইট, মোমবাতিতে আগুন জ্বলছে। দরজার জায়গায় কাচ দেয়া, সেই কাচের ফাঁক দিয়ে দেখলাম কালো দেয়ালে একটা স্বর্ণতালিকা!
ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবীদের নাম, ক্ষুদিরাম, সূর্যসেনসহ সকলের নাম মোমবাতির মৃদু আলোতেও জ্বলজ্বল করছে।
মনে হলো আস্তে আস্তে এই পলল মাটির জনপদ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। টের পাচ্ছিলাম আশেপাশে সাপের মতো হিসহিসে কণ্ঠস্বর। সামনেই পড়লো দ্বিজাতিতত্ত্বের পুরোধাদের ছবিঃ এ কে ফজলুল হক, মোঃ আলী জিন্নাহ সহ একটা বড়ো গ্রুপ ফটো। দেখে কিছুটা শরীর রি রি করে উঠলো। এই জনপদের মাঝে সাম্প্রদায়িকতার সবচেয়ে গভীর বিষ খুঁড়ে বের করে আনার রূপকারদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ধর্ম দিয়েও বিভাজন করা যায়, সেটা এনারাই শিখিয়ে দিয়েছিলেন। সেইসময়ের পর থেকে কোন হিন্দু আর মুসলমান একে অপরকে নির্মল মনে বিশ্বাস করে নাই!
পরের ঘরটিতে পাকিস্তান শাসনকালের সব (কু)কীর্তি। বামে প্রথম দেয়ালে একটা সাদাকালো ছবি দেখতে পেলামঃ একটা মানুষের মৃতদেহ- তাঁর মাথার খুলি ফেটে ঘিলু ছিটকে পড়েছে রাস্তায়। মৃতদেহটি শহীদ রফিকের। এই ছবিটি লুকিয়ে তুলেছিলেন ফটোগ্রাফার (মার্জনাঃ আমি নাম ভুলে গেছি দেখার পরেও)। মগজের মাঝে বিস্ফোরণ ঘটলো একটা। শুয়ো*!!
তারপরেও আমরা তো ঘুরে দাঁড়িয়েছি। চুয়ান্নের পরিষদের ছবি দেখলাম। পাশেই দৈনিক পাকিস্তানের কিছু পেপার কাটিং। আরেকটু এগিয়েই সেই কুলাঙ্গার আইয়ুব খান! সামরিক শাসনের মতো অভিশাপ যিনি আমাদের প্রথম চাখিয়েছিলেন।
তার পাশের ফ্রেমে একটা পেপার কাটিংয়ে লেখা পাকিস্তান বেতারে রবীন্দ্র সঙ্গীত ব্যান হবার খবরটা। বাংলার প্রতি এমন বিদ্বেষ কেন ছিলো পাকিদের মনে? আমি তখন হুট করেই এই প্রশ্নটা নিয়ে ভাবতে বসলামঃ আসলেই তো, আমরা নিরীহ লুঙ্গি পরা চাষা ভুষা লোকজন। দুইবেলা খাইতে পারলেই খুশি থাকতাম। পুরা পাক-আমলের শুরু থেকে এই জনপদের মানুষদের সাথে এরকম নিষ্ঠুর আচরণ কেন করেছিলো তারা? আমি বুঝে পাই না। সব শাসকই শোষক- এটা ধরে নিলেও, "কেন বাপু, খাও যতো হাউশ ততো, তয় আমাগো চাইরডা ভাত দিয়া খাইলে কি অয়?" কী হতো যদি সামরিক শাসন করতে করতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একটা দুটা উপকার করতো। আমরা তো প্রদেশ ছিলাম, আমাদের সেটুকু অধিকার দিলে কার কী এসে যেতো? কেন্দ্র তো সব লাভের গুড় এমনিতেই পাচ্ছিলো! তবে কি ভবিতব্য?
এর পরে ভাবনার জাল ছিঁড়ে দিলো আসাদ আর কিশোর মতিউরের লাশের ছবি দুইটা। উনসত্তরের শহীদ। পাকিস্তান আমলে ঠিক কতো জন বাঙালিকে বিনা কারণে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিলো? একটা "শান্তিপূর্ণ" দেশে হুটহাট এরকম মানুষ মারা পড়লে সেটা দেশের কর্তাব্যক্তিদের সম্বন্ধে কোন ধরনের ধারণা দেয়? পাকিস্তানের রাষ্ট্রযন্ত্র সম্ভবত এখন এটা কেয়ারও করে না। "চল্লিশ বছর ধরে মারছি, মাথা ঠাণ্ডা রেখে আজও মেরে চলছি!"
এর পরের ঘরটি প্রতারণা-হত্যা-রক্তপাত-জল্লাদের ছবিতে ভরপুর। চার দেয়ালে সাজিয়ে রাখা ছবিগুলো দেখে মাথা ঘুরাবে, আপনি একসাথে দেখার চেষ্টা করেই দেখুন! প্রায় গোলাকার গণ্ডি দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে, এই ছবিগুলোর কাছাকাছি গিয়ে দেখার শক্তি অনেকেরই নেই। ঢাকা শহরে পঁচিশে মার্চের রাতে যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ, সেটার বর্ণনা কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব না। এই হত্যাকাণ্ডের খবর যারা জানতো, যারা এই হত্যাকাণ্ডের কিছু কিছু নিজেরাই দেখেছে চোখের সামনেই, তাদের মধ্যে থেকেই কোন কোন বেজন্মা রাজাকার দলে নাম লিখিয়েছিলো! হায়রে! এতোকিছুর পরেও এদেরকে এখন কেউ কেউ 'বেনিফিট অফ ডাউট' দিতে চায়, 'অতীত ভুলে' মিলেমিশে চলতে চায়! ধিক্‌
ঘরটার এক কোণে একটা ছোট ফ্রেমে ভারতে চলে যাওয়া মোট শরনার্থীর সংখ্যা লেখা। শেষের তিনটা ডিজিট ভুলে গেছি। তবে তা ছিলো ৯৮,৯৯,০০০ এর বেশি। শূন্যগুলো ভুলে গেছি। সেখানে যে কোন সংখ্যা বসিয়ে নেয়া যায়। আটানব্বই লাখের কাছে কয়েকশত আর এমন কী! তাজ্জব! আমি এইটা কী বলছি? আমার কাছেই এগুলো কেবল সংখ্যা, আমি জানিও না ৯৯৯ আর ১০০০ এর পার্থক্য ১ আর সেই ১-টা মানুষ আমি নিজেও হতে পারতাম! একটা মানুষের দাম ইতিহাসের পাতায় কিছুই না, কিন্তু একাত্তরের যুদ্ধের সময়ে নির্বিশেষে মেরে ফেলাদের আর্তনাদ বলছে, সেগুলো ভুলে যাবার মতো নয়!
এর পরের ঘরগুলো আমি কেবল ছুঁয়ে গেছি। কোন ঘরেই বেশিক্ষণ দাঁড়ানোর মতো মানসিক জোর ছিলো না। একটা ঘরে একটু বেশি সময় ছিলাম। সেখানে থরে থরে স্টেন গান, এল এমজি, গ্রেনেড, মর্টারশেলগুলো সাজানো। মেশিনগানের খালি খোসা দিয়ে লিখে রাখা হয়েছে বাংলা। দেখলাম ইপিআরের হাতে বানানো বর্শা, এইগুলা দিয়ে যে নরপশুদের মারা হয়েছে, তাদের চেহারাটা দেখতে ইচ্ছা হচ্ছিলো। আর কুর্ণিশ করতে ইচ্ছা করছিলো বন্দুক আর বর্শা আর গ্রেনেড হাতে সেই সাধারণ মানুষগুলোকে! অসামান্য ঋণ শোধের চিন্তা করাও পাপ!
শেষের ঘরগুলোর মাঝে দুটো ঘরে দমবন্ধ অনুভূতি হলো। একটা হলো শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ঘর। সারি সারি খুলিগুলো সেখানেই দেখেছি। ঢাকার বধ্যভূমিগুলো থেকে তুলে আনা হীরকখণ্ডসম মানুষগুলোর দেহাবশেষ। তাঁরা চলে গেছেন এবং আমাদের নিঃস্ব করে গেছেন- মননে, চিন্তায়, আবেগ-অনুভূতিতে আমরা একটা নিঃস্ব জাতি হয়ে গেছি। আলো হাতে যাঁরা ছিলেন, তাদেরকে ঐ আল-বদর, আল-শামসের রাজাকারগুলো মেরে ফেলেছে। এই দলগুলোর পুরোভাগে ছিলো গোআ-মইত্যা-মুজাহিদের মতো পাপিষ্ঠ। (গালিও কম হয় এদের জন্যে)!!
আরেকটা ঘর আমার মায়ের, আমার বোনের। সেই ঘরটা আমি দ্রুত হেঁটে বের হয়ে গেছি, আশেপাশের ছবিগুলো বা নিদর্শনগুলো আমি দেখতে চাই না।
****
ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলাম জাদুঘর থেকে। একটা মৃদু নিঃশ্বাস ফেললাম। সামনে একটা উঠান, চারপাশে সবুজ গাছপালার মাঝে একটা শান্ত সমাধিস্থ প্রকৃতি। যেন আমাকে আশ্বাস দিচ্ছে,


কোন ভয় নেই, তুমি স্বাধীন। এতোক্ষণ যাঁদের দেখলে, তাদের ধমনীতেও তোমার মতো জীবন দৌড়ে বেড়াচ্ছিলোঃ ঐ রুমী, ঐ বাদল, ঐ আসাদ, ঐ মতিউর, ঐ নামহীন খুলির মানুষটাও এই পলিমাটির জমিনে একদা হাঁটতো। তাঁরা আজ নেই, কারণ তাঁরা কেউ কেউ তোমার কথা ভেবেছিলো- আর সবকিছু ছেড়ে মরে গিয়েছিলো। অখ্যাত এক গ্রামের একটা দা জাদুঘরে দেখেছো না? সেটা দিয়ে কুপিয়ে একজন মহিলা পাঁচটা রাজাকারকে মেরেছিলেন। কুপিয়ে একটা ডাব কাটতে যাও, তাহলে বুঝতে পারবে ঐ মহিলাটি কতো অপূর্ব যোদ্ধা ছিলেন!! তাঁর জন্যে শ্রদ্ধা, সম্মান এগুলো ফাঁপা শব্দের কোন দরকার নেই। খালি ঐ ঘৃণ্য রাজাকারগুলাকে ছেড়ো না। ঐ মহিলাটির শতাংশেরও শতাংশ পরিমাণ জোর যদি তোমার মনে আর হাতে থাকে, তাহলে এই স্বাধীন দেশে বসে ঐ রাজাকার আর অপরাধীগুলোকে সাজা দাও!



***
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অনেক অনেক প্রচার ও উন্নয়ন দরকার। জাদুঘরের ঢোকার পর থেকেই এইটা মাথায় ঘুরছিলো যে কেন এর ব্যবস্থা নেয়া হয় নি এখনও?? বের হওয়ার আগেই মন ভালো হলো এটা দেখে যে আসলে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। একটা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ট্রাস্টি গঠন করা হয়েছে। নতুন ভবন নির্মাণ করা হবে আগারগাঁওয়ে। ভবনের নকশা দেখে গর্বে বুক ফুলে উঠলো! একেবারে স্থাপত্য সৌন্দর্য্য! ঠিক ওভাবে বানানো হলে আমি প্রতি সপ্তাহে বিকালবেলা হাঁটতে যাবো ওখানে। শপিংমলের চাইতে ঢের ভালো!
তবে কাজ শেষ হয়ে যায় নি। নতুন জাদুঘরের নির্মাণব্যয় ৬০ কোটি টাকা। নেট ঘেঁটে ইত্তেফাকের খবর পেলাম যে গতমাসেই সম্মেলনে জানানো হয়েছে যে অতিসত্ত্বর এই ভবনের নির্মাণকাজ শুরু হবে! 
আমি যুদ্ধে যেতে পারি নাই। তবে যুদ্ধের স্মৃতি টিকিয়ে রাখার যুদ্ধতে শামিল হতে চাই!


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন