শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

দ্বিধা


সন্ধ্যা নেমে এসেছে বলেই মনে হয় এই হলুদ আলোয় ডিভাইডারে বসে রোমেলা দু'হাত মুঠো করে বেশ চিন্তায় মগ্ন হয়ে থাকে। একমুঠোয় সবুজ পাতা ঘিরে থাকা কতগুলো দোলনচাপা। বাদামি ময়লা ফ্রক-পরা রোমেলা তার হতবিহ্বল ভাব কাটাতে রুক্ষ্ণ তেলহীন চুল সরায় মুখের উপর থেকে। একটু আগে একটা গাড়ি-মহিলার কাছে সে পাঁচটা ফুল বিক্রি করেছে। তারপর থেকে ডিভাইডারেই বসে আছে থম্‌ মেরে। কী করবে বুঝতে পারছে না। সামনে দিয়ে হুশহাশ করে গাড়িগুলো বেরিয়ে যাচ্ছে বা সিগন্যালে পড়ে বুড়োটেগুলোর মতো বসে থাকছে রোমেলাকে না ছুঁয়েই। সকালে মা অল্প একটু পান্তা দিয়েছিলো, সেই থেকে কড়া রোদটুকু সয়ে রোমেলা সারাদিন ফুল বেচেছে। গত তিনমাস। প্রথমে গোলাপে শুরু, কিন্তু কাঁটার মতই খ্যানখ্যানে শরুফা একদিন অনেক থাপ্পর-চড়ে রোমেলাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলো যে সে একাই এখানে গোলাপ বেচবে। সাদা দোলনচাঁপা নিয়ে তার পরদিন থেকে রোমেলা এখানে ছুটে বেড়ানো শুরু করলো আগের মতই, শুধু গালের একপাশে দু'সপ্তা নখের ছড়ে যাওয়া দাগ ছিল। হেসে হেসে এগিয়ে গেলে ফুল বিক্রি হতে পারে এটা শিখে গেছে বলেই সারাক্ষণ মুখে হাসি ঝুলিয়ে রাখতে হয়। মাঝে মাঝে ধবধবে হাতির মতো মোটা কিছু গাড়ি-মহিলার হাঁসফাঁস দেখে ওর এমনিতেই হাসি পায়। তবে রাতে ঘরে ফিরে যাবার সময় রোমেলার মনে হয় এই ছাইভস্ম-মাখা শহরে কেউ হাসে না, সবাই তার মতোই ঝুলিয়ে রাখে। হাতের অবশিষ্ট ফুলগুলোও সারাদিন রোদ-কালি মেখে ছাইমুখ নিয়ে পড়া-না-পারা বালিকার মতো অধোবদন হয়ে থাকে।


আজকে একটু আগেই পাঁচটা ফুল বেচেছে রোমেলা, পাঁচকাঠির দাম বিশটাকা। গলি থেকে গাড়িটা বেরিয়ে সিগন্যালে পড়ার সময়ই ওটার গায়ে বাদামি ঝরনার মতো আছড়ে পড়েছিলো সে। কাচ নামিয়ে গাড়ি-মহিলা পাঁচটা ফুল নিয়ে টাকাটা দেবার আগেই কারেন্ট চলে গেল। অন্ধকারে টাকা দিয়েই ছুটে বেরিয়ে গেছে গাড়ি আর গাড়ি-মহিলা। সবুজ জ্বলজ্বলে আলোর নিচে ডিভাইডারে বসে রোমেলা দেখে ওর মুঠির ভিতর একটা চকচকে একশ' টাকা!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন