মঙ্গলবার, ১৬ জুন, ২০০৯

১০১০

নভেম্বরের এক শুকনো বিকেল। বিকেলের রোদ জমাট বেঁধে আছে তখনও, রাস্তায়। আমি গাড়িতে তল্পিতল্পা নিয়ে রওনা দিয়েছি। উদ্দেশ্য ১০১০।


১.
দরজা ঠেলে ঢুকতেই দুটো বিছানা, ডানদিকে লম্বালম্বি, বামদিকে আড়াআড়ি, দরজার পেছনে। চারকোনা ঘর। ঐপ্রান্তে আরও দুখানা বিছানা। ঘরের মাঝখানে দুটো বড়োবড়ো আলমারি দিয়ে মোটামুটি একটা বিভাজন তৈরি করা। আমি যখন ঢুকলাম, তখন কাউকে চোখে পড়লো না, অথচ ঘরে তালা দেয়া নেই। একটু ভিতরে গিয়ে দেখলাম আলমারির আড়ালের বিছানাতে একজন ঘুমাচ্ছেন, তার মাথার কাছে চেয়ারের উপরে রাখা টেবিল ফ্যান মৃদু শব্দে ঘুরছে। আমার হাতে গোল করে বাঁধা তোষক, ওটা মাটিতে রেখে আমি ঘুমন্ত মানুষটাকেই ডাক দিলাম।


সন্ধ্যা নামতে নামতেই সাকিব ভাইয়ের ফেলে যাওয়া আলনা, বাক্স, হ্যাঙার, তোষক, চাদর ইত্যাদি বাইরে বারান্দায় ছুঁড়ে ফেলা হলো। ঝুল এবং ময়লা পরিষ্কার করে আমি গোল করে বাঁধা তোষকটা মেলে দিলাম। টেবিল, বিছানা, চাদর, বালিশ। পায়ের কাছের জানালা দিয়ে বাইরে বাগানে জ্বালিয়ে রাখা টিউবলাইটের আলো এসে পড়ছে। আমি হেলান দিয়ে বসে থাকলাম আপাত অবস্থানে, কিছুটা ক্লান্ত এবং মলিন। ঘরের বাকি দুই বাসিন্দাও ফিরলেন। একজন ফিরেই ঘুম। আরেকজন মশারির ভিতরে উবু হয়ে বসে কী যেন করছেন। সাকিব ভাইয়ের মতো, এরাও কিছুদিন পরে ঘর ছেড়ে চলে যাবেন। বাকি থাকবে আড়ালে থাকা বিছানাধারী। রাত বাড়ে, কোলাহল, হাসি, খুচরো কথা ছিটকে ছিটকে যায় আমার চারপাশে। বুঝতে পারি এখানে মূলত বিযুক্ত এবং আলাদা আমি।


ক্লাসের পরে দুপুরে আড্ডার একটা প্রিয় জায়গা ছিল ক্যাফের সামনের চত্বর। অন্য ডিপার্টমেন্টের বন্ধুরাও জমায়েত হতো। মাঝে মাঝে ফিল্ম সোসাইটির সন্ধ্যার মুভি শো দেখা হবে কী না সেটা নিয়ে কথাবার্তা। কারো কারো আড়াইটায় সেশনাল, তারা বেশিক্ষণ থাকতো না। সোয়া একটা দেড়টার দিকে ক্যাফের ভেতরে ভিড়, শোরগোল, খাওয়া দাওয়া, তেহারি বিশটাকা, ঝালফ্রাই বিশটাকা, খিচুরি তুলনামূলক সস্তা ও বিস্বাদ। তারপরে আড়াইটার পরে নিঝুম হতো সিরামিকের উঠান। চলাচল হলাহল কমে আসতো, আমরা কেউ কেউ বসেই থাকতাম এবং মাপার চেষ্টা করতাম কীভাবে রোদ নেমে যায়, বেলা পড়ে যায়। মাঝে মাঝে দুয়েকজন ছিটকে যেত হেঁটে চলে যাওয়া ওড়নার সাথে। আবার কিছু পরে ফিরেও আসতো, দুপুরের সময় অনেক দীর্ঘ ও ধীর বলে। ১০১০-এর সাথে যেসময়ে আমার সম্পর্ক হলো, সেই নভেম্বরের সময়, সেই আশু শীতের টান বা রোদের দাপটের সময়েই আমি ধীরে ধীরে ক্যাফের সাথে আলাদা হয়ে যাই। টের পাইনি কখন, ক্লাস শেষে বের হয়ে ডানের বদলে বামে যাওয়া শুরু হলো। গেইট পেরিয়ে রাস্তার ওপারের ছোট গেইট দিয়ে ঢুকলেই তিতুমীর। তারপরে পেছনের উইঙয়ে, ডানদিকের শেষের আগের ঘর ১০১০। ঘরে ঢোকার আগে প্রায়ই ১০১১এ উঁকি দিতাম। আদিরসাত্মকদাদা হাঁক ছাড়তেন, কিরে ***! কারো মুখে এমন আদরণীয় অশ্লীল সম্বোধনও সয়ে যেতে পারে, এটা আমার ধারণাই ছিল না। এখানে দুপুরের পরে ডাইনিঙের সমালোচনা জমে, মহিষের মাংস বা ছাইপাশ খেতে হচ্ছে বলে আমরা বড়োই বিরক্ত হই। ম্যানেজার কত টাকা মেরে নোকিয়া কি স্যামসাং কিনে ফেলছে ভেবে যারপরনাই হতাশ হই। বিছানাধারী ছাড়া আমাদের ঘরের বাকি দুই চাকরি পেয়ে চলে গেছেন বলে আমাদের ঘর মোটামুটি ফাঁকাই। আমরা দু'জনে রেক্সিনের ম্যাট বিছাই ঘরে, ঝেড়েপুঁছে ঝুল-টুল পরিষ্কার করি। ঘরে যারা আসেন, তারা বেশ চমৎকৃত হল আমাদের পারিপাট্যে। দু'টা কম্পিউটার, মাঝে মাঝে মুভি শো, সারাউন্ড সাউন্ডে আশেপাশের মুভিখোরেরা জমায়েত হয়, রেক্সিনের মেঝেতে মফস্বলীয় কায়দায় আমরা হাসি, শোরগোল করি। সেখানে আমি আর নিজের উচ্ছ্বাসটুকুকে আলাদা করতে পারি না। কেবলই মনে হতে থাকে, এটাই স্বাভাবিক, সবচেয়ে বাস্তব জীবন।


৩.
শীতের কম্বল থেকে ওম চলে গেলে, গরম বাড়ে। ঘরে একটাই ফ্যান, আমরা দু'জনেই সালমান খানের ফ্যান, এজন্য উদোম গায়েই বসবাস। বিছানাধারীর শেষ টার্ম। পাশ করলেই তিনি যে বিদেশে উড়বেন, সেখানে তার সুপারভাইজার যে একজন মহিলা প্রফেসর এবং তাঁর নাম লিসা। লিসার সাথে তার পত্রালাপের আমি নীরব সাক্ষী, মাঝে মাঝে ভাষাবিড়ম্বনা ঘুচোতেও সমান সহায়তাকারী। শেষপরীক্ষার আগে ১০১০এ আরো দুটো ছানাপোনা আমার মতোই উঠে আসে। দরজার দিকের দুইবিছানায়। তারা অতিশয় চঞ্চল, প্রগলভ। আমাদের ঘরে প্রচুর হৈচৈ জমা হতে থাকে। এভাবে একটা সময়ে দুপুরের ঘুম উবে যায়, শান্ত ঘরেই ডাইনিঙ-ম্যানেজার-মস্তকমুণ্ডন-গর্দভবৈঠন-গ্রামছাড়ন চলতে থাকে। বিছানাধারীর যাবার সময় ঘনিয়ে আসে। আমি বুঝতে পারি, এভাবে চলে যাওয়াটাই আসল সত্য, এবং তারপরে নিজের ব্যাপারেও সচেতন হই। চেষ্টা করি জড়িয়ে পড়া সুতোগুলো আলাদা করতে। নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে। সব যোগাযোগ মানতেই হবে এমন তো কথা নেই- এমনটা ভেবেই আমি আলাদা ও বিচ্ছিন্ন হতে চাই। আমার খেয়ালে একবারও আসে না যে নিজের অজান্তেই আমি ধীরে ধীরে ক্যাফের ভীড় ভুলে গেছি, আর মনে নাই দুপুরের দৌড়, ঘাম, ওড়নাদের সৌন্দর্য।


আমাদের ঘরে বিছানাধারীর জায়গায় উঠে আসে মোটামানুষ। মোটামানুষের বাসা খুব কাছেই, কিন্তু বেচারা সদাব্যস্ত, সদাদৌড়বিদ, মহাকেজো। কেঁচোর মত পড়ে থাকতেও দেখিনি কখনও তাকে। রোল বিচারে আমার থেকে দুই পরে, কিন্তু মানুষ বিচারে সম্ভবত আমি তার ধারে কাছে নেই। মোটামানুষের হৃদয় বড়ো হয় এটা শুনেছিলাম, আফসোস ছিল কাছ থেকে এমন কাউকে দেখিনি বলে। এই মোটামানুষের ঘরে ওঠার পর থেকে আমিও বুঝলাম আপ্তবাক্য এমনি এমনি উক্ত হয় না। (একারণেই হয়তো আমিও মোটা হচ্ছি, হৃদয়ের আয়তন বাড়ানো যায় না, শুধু স্থূলত্ব দিয়ে যদি ধোঁকা দেয়া যায়!) মোটামানুষ একা এলো না, সাথে আরও একজন মোটামানুষ এলো। বোঝার সুবিধার্থে আসুন আমরা পরেরজনকে গীটারিক বলি। তার সাথে আমার পরিচয় ঐ গীটার দিয়েই। মানুষটা পাঁচতলা হল-এর ছাদে বসে নিশুতি রাতে গীটার বাজাতো। আমি শুনতাম, মাঝে মাঝে মোটামানুষের সাথে গলা মিলিয়ে গাইতাম। শিশির পড়লে, আমার ঠাণ্ডা লাগতো এবং মোটামানুষ ও গীটারিক মাথা দুলাতো, "তোরে নিয়ে... যে কী করি!" আমি হেসে ফেলতাম নিরুপায়, কারণ আমি নিজেই জানি না নিজেরে নিয়ে কী করা উচিত!


আমরা তিনজন রিকশায় চড়তাম। আপাতশীর্ণ আমাকে কীভাবে চিপা ও চাপা খেতে হতো সেটা সহজেই অনুমেয়। আমরা রাত জাগতাম। বারান্দায় বা ফুটপাতে হেঁটে বেড়াতাম। সোডিয়ামের আলো আমাদের ভালো লাগতো বলে আমরা চা খেতে বেরুতাম। পলাশীর মোড় ঘুরলেই আদা-চায়ের মামা, আমরা সেখানেই নিরন্তর ফাঁকা রাস্তার পাশে বসে ট্র্যাফিক সিগনালের ওঠানামা দেখতাম। বাহনবিহীন চওড়া রাস্তায় মাঝে মাঝে মহিষের দল চলে যেত, দেখে আমরা অবাকও হতাম কিছুটা। কখনও কখনও আমাদের ক্ষিদে লাগত। ডাইনিঙয়ের ঝোলঝোলকিউবিকমাছ বা আগাছাশাক রুচতো না বলেই আমরা রিকশা চেপে সোহাগে যেতাম। কালাভুনার ঝালে মোটামানুষ খুশি হতো, গীটারিক আরো দুয়েকটা মরিচ নিত আর আমি নাকের জল চোখের জল এক করতাম। খাওয়াশেষে জ্বলন্ত জিহ্বায় আরো তাড়না আনতেই আমরা চা খেতাম। গীটারিক ফস্‌ করে একটা সিগারেট ধরাতো। আমরা ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে খচ্চর স্যার আর ক্লাসের সবচেয়ে বড়ো আবাল ছেলেটাকে নিয়ে হাসাহাসি করতাম।


৪.
১০১০এ আমার জীবনও ফুরিয়ে এলো, এবং আমাদের তিনজনেরই সময় ফুরলো। মোটামানুষের সবার আগে। সে বেরিয়েই চাকরি নিয়ে নিলো (পরে সেটা ছেড়েও দিল)। গীটারিক নিজের আলসেমি ও নবাবি আচরণে কয়েকমাস পরেই চাকরি পেল দিনবদলের ফাঁকিঝুকিতে। আমার তখনও ঘরের মায়া কাটেনি, আমি পড়েই রইলাম আরো কিছুদিন। ছানাপোনা দুইজনের পরে আরো একজন ঘরে জায়গা নিল। তারপরেও আরও কিছুদিন আমি চক্কর কাটলাম। সেসময়ে বুঝিনি, তবে এখহন মনে হয় এটারও দরকার ছিল হয়তো। আমি ১০১০এ সব বাস্তবতাকে বুঝে উঠিনি তখনও। শেষ শিক্ষাটা হয়ে গেল শেষ তিন মাসেই। তারপরে আমি গ্র্যাজুয়েট, আমি ১০১০এর প্রাক্তন। দরজা ঠেলে ভেতরে এলে অচেনা মুখ, দরজা ঠেলে বাইরে গেলেও অচেনামুখ। আমাকে মুখোশ পরতে হয়। সেটা আমার ভাল লাগে না। তাই আমি ১০১০থেকে দরজা ঠেলেই বেরিয়ে আসি। যেভাবে এসেছিলাম, সেভাবেই চলে গেলাম। ভেবেছি যে সব শিখিয়ে দিয়েছে ১০১০ আমাকে, কিন্তু বেরিয়ে আসার সময়েই জানলাম সবচেয়ে বড়ো সত্যটা। এতদিন, প্রায় তিনবছরে যেটা আমি জানতেই পারিনি। টেরও পাইনি কীভাবে ১০১০ আমার কাছ থেকে এটা লুকিয়ে রাখলো, আড়াল করলো!


ফিরে আসার পরেই জানলাম, জুড়ে যাওয়া বা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত মানুষ নিলেও সেখানে কতটা মানসিক ক্ষয় ঘটবে তা আগে থেকে বোঝার কোনই সুযোগ নাই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন