বুধবার, ২৪ জুন, ২০০৯

স্নানক্লান্তি


পানির ফোয়ারা মুখ থেকে অনর্গল সাপের মতো ফোটায় ফোটায় পানি ছুটে আসছে। প্রথমে তারা উচ্ছ্বাসে ঝাপটা দিল আমার কপালে, ঈষৎ নিচু করে রাখা মুখে দ্রুত গড়িয়ে নামল তারা, সদলবলে, সোল্লাসে। চোখের পাতা কেঁপে উঠলো কিছুটা, পানিবিন্দুর ভারে আবেশে বুঁজে এলো। পানির রথের সেদিকে খেয়াল নেই, দুর্দান্ত দাপটে সে গাল, চিবুক, ঠোঁট, থুতনি পেরিয়ে গেল অনায়াসেই। তারপরে কেউ কেউ ঝরে গেল সুদূর টাইল্‌সে। মহাপতন! কেউ কেউ সেই ঊর্ধ্বমুখী চলনে গড়িয়ে গেল গলায়, গোপনে-


গোপন সুখের মত আমি চোখ বুঁজেই থাকি। পানির অবিশ্রাম ধারা ঝরছে, অঝোরে, নিভৃতে। গলারভাঁজ থেকে গ্রীবার সমতলে তারা ছুটে চলে। নীরব, কিন্তু নিরলস। আমি খেয়াল করি পিঠের ওপরেও আছড়ে পড়ছে ক্ষুদেকণা, বিম্বিসার পথের মত, সেখানে পথ তৈরি হয় অচিরে। গহনপথের ঠিকানায় ঘোলা ঘামের দাগ বিস্মৃত হয়, যেভাবে আমি আমার শৈশব ভুলে গ্যাছি, যেভাবে গতকালের জীবন হারিয়ে ফেলেছি। সেভাবে জরুরি প্রত্যাদেশের মত নোটিশ ঝুলে উঠল পিঠে, জলের দাগ ক্ষণস্থায়ী, কিন্তু প্লাবনেরও অধিক শোক মুছে দিতে পারে।


পানির ঢেউ আরো নিচে নেমে যেতেই থাকে আমাকে শিউরে দিয়ে। চোখ খুলে আমি পানির রঙ দেখি, উন্মনা দেহের সৌরভের মত রঙ পাঁপড়ির সামনে খেলা করে। চারপাশে পানির দোলায়মান দেয়াল, দুলছে, নাচছে, সরে যাচ্ছে, কাছে আসছে। আমিও অজান্তেই মাথা দুলাই। ঘুরতে থাকে পৃথিবী আমার চারপাশে, মানুষেরা বিম্বের মত বশংবদ হয়ে সঙ্গী হতে থাকে, কাতার কাতার মানুষ, অজস্র অসংখ্য অচেনা অবয়ব ঘিরে ধরে আমাকে। আমি টের পাই জলের পর্দার বাইরে সকলে হা হা করে আমার দিকে হাত বাড়িয়েছে। ডাকছে, আয়! আয়!


কিন্তু আমি নড়তেও পারি না। অচল পাথরের মত নিস্তব্ধ হয়ে আমি আমার শরীরে ক্রমাগত ঝাঁপিয়ে পড়া পানি, আর ঝরে পড়া বিন্দু গুনি। তার বাইরের পৃথিবী ঝাপসা, ক্রমশ দূরাগত, অভিমানী! সামনে ও পেছনে পানিপথে প্রবল স্রোত, আমি ভেসে যাই খড়কুটোর মত। নিঃশ্বাসেও জলজ অক্সিজেন আমার ফুসফুসে নৃত্য শুরু করে দেয়। আমি আরাম পাই, ধীরে ধীরে আমার পেশি শিথিল হয়ে আসে, চোখ বুঁজে ফেলি আবার, এবং এবারে আমি আর সেটা খুলতে চাই না। শুধুই অবিরাম বর্ষণ। শুধুই ঝরোসুর। শুধুই নীরবতায় পানির গান। আঁধারের পর্দা নেমে এলে আমার কোষ জেগে ওঠে পলিদ্বীপের মত, বাইশখালি চরের মত। চরের ধবল বালুর মত আমার শরীরে ভিন্‌রূপী ত্বক হেসে ওঠে। আমি চোখ না খুলেই অবাক হয়ে তার খিল খিল হাসি শুনি।


একটা সময়ে নেমে আসা পানির স্রোত থেমে যায়, স্রোতের ভেতরে বিন্দুর রথ স্থবির হয়ে আসে, উড়তে থাকা বাষ্প কণাও ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে আমার খুলির ভেতরে সেঁধিয়ে যেতে থাকে। আমি চোখ খুলি না তখনও, শিথিল শরীরে পড়ে থাকে শাদাটে হাড়ের মত সিক্ত মেঝেতে। শরীরে লেগে থাকা পানির বিন্দুগুলো সহোদর-মায়ায় মাটিতে নেমে আসতে থাকে, আমার আতিথেয়তা বুঝি তাদের আর ভালই লাগে না! দূরের পর্দার ওপাশে মূর্তির মত স্থির মানুষের মুখ, শতসহস্র মানুষের নির্বাক চোখ আমার বন্ধ চোখের ভিতর দিয়েও আমাকে বিঁধতে থাকে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন