বুধবার, ১৭ জুন, ২০০৯

সঁর্দি কাঁশি জিঁদাবাঁদ

সৈয়দ মুজতবা আলীকে আমার ভাল লাগে। লোকটা মহারসিক ছিলেন। এত কনফিডেন্স নিয়ে বললাম, এখন কেউ যদি চেপে ধরে, “কেমনে জানলেন, আপনি তো মুজতবা আলীকে দেখেনই নাই?” তাহলে আমিও বিগলিত হেসে বলবো, তাঁর লেখা পড়ে মনে হয়, জনাব। তিনি অত্যন্ত রসিক ছিলেন। আমাদের পাঠ্যেও তাঁর লেখা ছিল। তবে আমি পাঠ্যের পাশে তার বই রেখে বেমালুম পড়তাম। সেই সময়ে নেশা চাপলো যখন বাবার পোস্টিঙয়ের কারণে মা তার সন্তানদ্বয় নিয়ে পিতৃগৃহে। সেখানে আমার মামার বইয়ের বিরাট সম্ভার। আমাকেও কে জানি বললো, বেশি বেশি গল্পের বই পড়লে চোখ নষ্ট হয়, চোখ নষ্ট হলে চশমা পাওয়া যায়। আমি চশমার লোভে বই পড়া শুরু করলাম। এক পর্যায়ে পেলাম আলী সাহেবকে। তিনি মোটামুটি বাক্যঝঙ্কার আর পৌরাণিক উপমা মিশিয়ে আমার চর্মচক্ষু রঙিন করে দিলেন..


তো, এতদিন গেল, এত বকবক করলাম, পাতার পর পাতা লিখেও ফেললাম। কিন্তু একবারও মুজতবা আলীর কথা এলো না কেন? এমন প্রশ্ন আপনি করতেই পারেন! আসলে হয়েছে কি, নিঃশ্বাস না আটকালে যেমন বাতাসের মূল্য টের পাওয়া যায় না, এসির বাইরে না বেরুলে যেমন গরমের তাপ টের পাওয়া যায় না, তেমনি সর্দি কাশি না হওয়া পর্যন্ত সৈয়দ মুজতবা আলীকে স্মরণ করা হয় না। তাঁর “বেঁচে থাকো সর্দি কাশি” পড়ে যতটা হেসেছি, মজা পেয়েছি, সাথে মন ভার-ভারও হয়ে উঠেছে, তেমনটা আর কোন রম্য লেখাতেই হলো না। আজকে হ্যাচ্চো হ্যাচ্চোর ঠেলায় যখন নাক বেচারা ফাটে, খকখক কাশিতে গলার ফর্দাফাই (নাকি পর্দা-ফাই?), তখনই মনে পড়ল আলী সাহেব বলেছিলেন, “দুই নাকে রাইন আর ওডার বইছে!” তা উনি জর্মনদেশের বাসিন্দা, এমনধারা নদীর নাম নিতেই পারেন যার নাম আমার বাপ-দাদা কেউ শুনেন নাই, শুনলেও চোখে দেখেন নাই, চোখে দেখলেও নাতি বা পুত্রকে এসে বলে যান নাই। মোদ্দাকথা, আমি জানতে পারি নাই।


ভূগোলে আমি বরাবরই গোল্লা। এই গোলগাল পৃথিবীর উত্তল পিঠে কোথায় যে কী তা ঠিক ঠাহর হয় না মাঝে মাঝেই। পরে শুনলাম পুরো ভূখণ্ড নাকি এককালে একসাথেই ছিল! তাকে “প্যানজিয়া” বলতো। পরে কেমনে কেমনে দূরে সরে গেছে। { শিক্ষাঃ কেবল মর্ত্যের পাপী-তাপী পুরুষ-নারী, মতান্তরে বিএফ-জিএফ-রাই দূরে সরে না। মায় পুরো স্থলভাগই যোজন যোজন দূরে ছিটকে যায়} এমনধারা না হলে সবাই কত কাছাকাছি থাকতাম। হেঁটে হেঁটেই এপার ওপার করা যেত। বুশের মত বেয়াক্কেল বা সাদ্দামের মত ঘাউরা বেশি লাফালাফি করলে বাড়ির কাছে গিয়ে হাউকাউ করা যেত সবাই মিলেই! কিন্তু দুই নাকের শিকনির নহরের মতোই, সব খাবলা খাবলা মাটি আলাদা হয়ে গেল, কেউ টেরটিও পেল না। এখন কত পাসপোর্ট, ভিসা, ইমিগ্রেশন, মাইগ্রেশন, রেসিডেন্ট, ওয়ার্ক পারমিট, স্টুডেন্ট ভিসা ইত্যাদি ইত্যাদি।


সে যাক, কথা হচ্ছিল নাকের নহর নিয়ে। গত হপ্তায় বিষম ঘটনা ঘটে গেল। গরমের এই সময়টায় আমি বরাবরই সাবধান থাকি যেন ঠাণ্ডা না লাগে। সেদিন খুব ঘেমে নেয়ে বাসায় ফিরে, কোথায় ঠাণ্ডা হবো, আমি ঢুকে পড়লাম বাথরুমে। কী ভূত চেপেছিল কে জানে। কলেজ বাথরুমের মত লা লা লে লে আন্দাজে গান গেয়ে বেরিয়ে চুল মাথা মুছে বসে রইলাম। রাত ঘনালে দেখি নাকের মাঝে শুলশুল করছে! একটু পরে গলার ভেতরে খুশখুশ। আমি নিজেই উশখুশ শুরু করলাম। শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার-স্যাপার বুঝি কম। খালি উদ্দীপনা-পরবর্তী-প্রতিক্রিয়া (!!) টের পাই। রাতের পরে সকালে উঠেই দেখি মাঁআঁআঁআঁআঁ! নাঁক বঁন্ধ, খ্যাঁশখ্যাঁশে কাঁশি। দুপুর গড়াতে না গড়াতেই হালকা গা গরম। আমি তো মহাখুশ। এই পেয়েছি সুযোগ, অফিস ফাঁকি দেবার।


মানুষ ভাবে এক, আর উল্টাপাল্টা কিছু একটা ঘটে যায়, কিন্তু যেটা ভেবেছে সেটা কিছুতেই ঘটে না। পরীক্ষা নিতে হবে সেই সময়েই। নিজের পরীক্ষা দেয়ার হলে ডজ্‌ মারা যায়, না বলে কয়ে পরে একটা ভুয়া ডাক্তারের চুয়া সার্টিফিকেটও দেখানো যায়, কিন্তু যেখানে আমি নিজেই পরীক্ষক, সেখানে ফাঁকিবাজির জো নাই। তাই আমাকেও এই গরমে, ভাজি হতে হতে বিদ্যালয়ে যেতে হয়, নাক টানতে টানতে কথা বলতেই হয়, খকখক কাশি ঠেকাতে ঠেকাতে খাতা বিলি করে হাঁটাহাঁটি করতে হয়। বড়ো হওয়ার বড়ো জ্বালা। কোনমতে গার্ড শেষ হলেই, হেড স্যার আমার ঘাড়ে আজাইরা কোন কাজ চাপানোর আগেই, আমি বাসায় ফুটলাম। এসে দেখি আমার ঘরও ফুটন্ত কড়াই। জানালা খোলা ছিল বলে হু হু করে গরম বাতাস ঢুকে গেছে। সেখানেই পিঠ পেতে শুয়ে রইলাম। পনেরো মিনিট পর পর গিয়ে নাক ঝাড়ি, ফিরে আসতে আসতেই ভারি হয়ে যায়। কিছুক্ষণ ফোঁৎ ফোঁৎ তারপরে আবার বেসিন…


এমন যন্ত্রণায় তো স্বয়ং ইয়েসউদ্দীনও পড়েন নাই। তাই আমি শুরু করলাম ডুয়াল অ্যাটাক। একদিকে অ্যান্টিহিস্টামিনে নাক জমাট বাঁধাই, তারপরে অ্যান্টাজল দিয়ে সেটা তরল করি। জমাট তরলের ফাঁকে পড়ে একটা সময়ে নাক ফুরফুরে হয়ে ওঠে। তাতে আগের মতোই ঘণ্টায় ষাট কিমি বেগে বাতাস বইতে শুরু করে। কিন্তু অন্যদিকে গলার অবস্থা বেগতিক। ওখানে ঝড়োবাতাস সহ দমকা দমকা আওয়াজ বেরিয়ে আসছে। থামানোর উপায় (বাংলাদেশের দূর্যোগকালীন ব্যবস্থার মতোই) আমার জানা নেই। জলোচ্ছ্বাস এলে যেমন, গরু-ছাগল নিয়ে মানুষ পাকা দালানে ওঠে, তেমনি কাশি বিপর্যয়েও আমি আশ্রয় নিলাম জিথ্রক্সের কাছে। ৫০০ মিলিগ্রামের শুকনো ট্যাবলেট কী বেমালুম গলার ক্ষতে পরশ বুলিয়ে দিল। আহা! এমন আরাম, প্রশান্তি আর কোথায় পাবো? পেলাম, আমি ইহাকে পেলাম। রোজ কোঁৎ করে গিললাম, সাথে জ্বরের বাণঃ প্যারাসিটামল। এই ফার্মাসিউটিক্যাল ট্যাকটিক্সে তিন ভাইরাসীয় সেনা একেবারে পর্যুদস্ত হয়ে গেল। কপালের ঘাম শুকালো, সাথে নাকের ভেতরে ‘রাইন-ওডার’! গলার ব্যথা গেল ও কথা ফিরে এল। সব মিলিয়ে আবার আগের মতোই আমি “ফিট! একদম ফিট!”


পরিশিষ্টঃ পুরো লেখার মাঝে কোথাও কিন্তু সর্দিকাশির ভালো দিকটা বলিনি। খালি বকেই গেলাম হতচ্ছাড়া নচ্ছার ভাইরাসগুলোকে। তবে লেখাটাতো আসলে তাদের গুণগানের জন্যেই, তাই শেষ করার আগে একটু ভাল দিক বলি। সুস্থ থাকলে কেউ তেমন পাত্তা দেয় না। আসি যাই, চোখের সামনেই ঝুলছি বলে সবার কাছেই সাধারণ, স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিলাম। এই কয়দিনের অসুখে নানাপ্রান্তে হাঁকডাক বড়ো মধুময় লাগলো।
কেউ ফেসবুকে নক দেয়ঃ কিরে, তোর খবর কি? আওয়াজ নাই!
কেউ এসেমেস করেঃ দোস্ত, কেমন আছিস? একটা জিটুজি কর। অফিস করতে করতে কাহিল হয়ে গেলাম তো! তোরে অনেকদিন দেখি না।
আর কেউ বারবার ফোন করে খোঁজ নেয়ঃ ঠাণ্ডা লাগাবা না। গলায় কাপড় জড়িয়ে রাখো। সময়মত অষুধ খাও। আজকে গোসল করতে পারো তবে বেশি ভিজবা না। গরম পানিতে গার্গল করো, ভালো লাগবে। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ো, রাত অনেক হয়েছে।


ক্যাডেটে পড়া অব্দি মা ছাড়া এভাবে কেউ যত্ন করে নাই। এই ভয়ানক সর্দিকাশির সুবাদে সেটার পরশে মন কেমন করে উঠলো। আমি তো সাধারণ মানুষ, এমন অসাধারণ ভালোবাসা পেলে কীভাবে তা সামলাই!




***

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন