সোমবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০০৯

টেবিলিক

ভাঁজ করা কাগজের ভেতরে একটা বিয়ের নেমন্তন্ন লুকিয়ে আছে, চারভাঁজি কাগজে ভাঁজে ভাঁজে বর, কনে, ও তাদের পিতামাতাগণ গা মিশিয়ে শুয়ে আছেন চিড়েচ্যাপ্টা। তাদের পাশেই, কাগজের গায়ে জমছে ধুলো, গত বছরের নেমন্তন্নের চিঠিটা ফেলা হয়নি! একটু দূরে রঙহীন তরল বিষ নিয়ে অ্যারোসলের ধাতবে ঢুকে যাচ্ছি আমি। বিন্দু বিন্দু বিষ, বাতাসে! ঝুম ঝুম ঝুমকার মত ঝুলছে, বাজছে। মুখোমুখি পড়ে আছে রুপালি ঘড়ির শরীর, জড়াজড়ি করছে তার সাথে আমার চাবির গোছা। গোছায় চারটা চাবি- পুরনো হতে হতে কালচে কালচে রঙ তাদের… একটা তোমার চাবি, তোমার ভেতরের গলিঘুপচিতে যাতে না হারাই সেই সংকেত লেখা আছে মোহন রূপেই। আরেকটা চাবিতে খোলে কালোগহ্বর যতো, আমাদের শরীরের মাঝে।


দূরে দেখি মোলায়েম মানিব্যাগখানা পেটমোটা হয়েছে অনেক! পেটের ভেতরে তোমাদের খসখসে ঠিকানাসকল। খাজাঞ্চিখানার নোটগুলোও চকচকে আজকাল, ইদানিং আমি শক্ত একটা কার্ড ঢুকিয়ে দেই তার পেটের ভেতরে আর কড়কড়ে নোটগুলো বেরিয়ে আসে। আজব যন্ত্র এক- শরীরে ধারণ করছে অর্থবিষ, শুনেছি মুদ্রাও তরলিত ক্রমশ!…
আরো আছে মুখ উঁচিয়ে থাকা গোলমুখো ওয়েবক্যাম-জালচোখ! গোলাপি মন্থর আলো জ্বেলে আমাকে দেখছে নিনির্মেখ। আমিও তাকে দেখি, রূপসী গোল চোখের মাঝে তার কোনো তাড়না নেই। ঘোর আছে, নিস্পৃহ ক্লান্তিহীন ঘোরে ফেলা চোখ তার তোমার চোখের চেয়ে অল্প একটু অসুন্দর…


ঝনঝনিয়ে বাজছে সেলফোন, কোষে কোষে তীব্র শিহরণ উঠে গেছে দুদ্দাড় তোড়ে জেগে উঠছে চরাচর। আমি ভাঙছি বাতাস ও নিদ্রার জোট। আলো! ওহ! আহ! চুরমার!

শনিবার, ১৯ ডিসেম্বর, ২০০৯

টু-ডু লিস্ট অফ টু-ডে

আমার ঘরে খুব বেশি জিনিশ নাই। একটা খাট, খাটের পাশে টেবিল। টেবিলের পাশ দিয়ে চেস্ট অফ ড্রয়ার, তার পাশে দরজা। অন্যদিকে খাটের পাশে জানালা, জানালার পাশে কম্পিউটার, তার পাশে বইয়ের শোকেস। এই।


আমি মাঝে মাঝেই একঘেঁয়ে হয়ে গেলে ঘরের এই লে-আউটটা বদলে ফেলি। এর সাথে আর কোনো অন্তর্নিহিত অর্থ নেই। আমার হয়তো সবাইকে একটা উল্‌টে পাল্‌টে দিতে ইচ্ছা করে, হয়তো এজন্যেই আমি এভাবে মাঝে মাঝে নিজের ঘর বদলে ফেলি। এবারে আলসেমি লাগছিলো (আমার মতোন অলসেরও আবার আলসেমি লাগে!), তাই আমি কেবল খাট আর কম্পিউটারের মাঝের চেয়ারটা হঠিয়ে দিলাম। তারপরে তার ও মাল্টিপ্লাগসমেৎ পুরো কম্পুবাবাকে টেনে খাটের পাশে নিয়ে এলাম। এখন শয্যা থেকেই অন্তর্জাল! সুতরাং আমার অনেক সুবিধা হলো। অলসতা একটা ভয়ানক আগ্রাসী রোগ।


মশা বেড়ে গেছে আজকাল। আর ক্ষুধার্তের প্রতি আমার করুণাবশত আমিও কিছু বলি না। মশাগুলো রক্ত খেয়ে খেয়ে ভোম হয়ে ওঠে। তারপরে আমি আঙুলে চেপে ধরলেই তার নধর দেহখানা চটকে যায়। আঙুলে আমার রক্তের কিছুটা অংশ লেগে যায়। মাঝে মাঝে আমি নাকের কাছে ধরে গন্ধ নেই। ধাতব ধাতব ঘ্রাণ আসে রক্তের, লৌহকণা আছে নিশ্চয়ই অনেক? আমার গা ঝিম ঝিম করে।


মনমরণের ইতিবৃত্ত পড়ে একজন বললেন আমার লেখায় অনেক ক্লেদ চলে আসছে প্রকাশিত হয়ে। এখন আর সেগুলো উপমা আর রূপকে ঢাকা নেই, বিবিক্ত হয়ে পড়ছে। তার কাছে অবশ্য সেই প্রকাশ দুর্দান্ত লেগেছে। কিন্তু আমি দ্বিধায় পড়ে গেলাম যে এই বদলটুকু ভালো হলো না খারাপ হলো সেটা নিয়ে। নতুনতর হয়েছে মনে করে স্বস্তিলাভের সময় নাই এখন আর, নিজেকে ভাঙতে হবে, টুকরো টুকরো করে ফেলতে হবে। তারপরে ভেঙে দেখতে হবে নতুন নতুন কোনোকিছু তৈরি করা যায় কী না! এমন না হলে আসলেই লেখালেখির কোনো আদত-উদ্দেশ্য হয় না। নিজের তৃপ্তির জায়গাটার বদল না ঘটালে লেখা বৈচিত্র্য পাবে না। আর কূপে আটকে গেলেই বিপদ। সুতরাং আমি প্রকাশিত ক্লেদ ও অনুক্ত উপমা নিয়ে এখন চিন্তিত।


মাথার চারপাশে দুয়েকটা পিনপিনে মশা ঘুরছেন। তারা অনেক জ্ঞানী ও কবির চাইতেও মহৎ। তাদের জন্যে অসীম শ্রদ্ধা!




***
- ১৯.১২.৯

মন মরণের ইতিবৃত্ত

মন মরে যাবার প্রক্রিয়ার সাথে আমি তেমন পরিচিত ছিলাম না।
বিজ্ঞপ্তি ও বিবৃতিতে মানুষের বিদেহী আত্মার কথা শুনেছি কেবল
জেনেছি, কেউ কেউ মরে গেলে দেহ বিয়োজন ঘটে,
আর কোনো কোনো লাশের খবর থাকে না।
ঈর্ষা করেছি যারা আত্মা হয়ে গেছেন, চল্লিশ দিন
ঘুরে বেড়িয়েছেন ভরহীন অশরীরে।


দুঃখ-শোক-সন্তাপ-বিদুরিত-প্রাণে-অপ্রাণে
আর অনেক অনেক বছর পরে, বিদেহীদের পরিচয়
আমার কাছে আটপৌরে হয়ে গেলে, জানতে পেরেছিঃ
দুয়েকজন সৌভাগ্যবানের মন মারা যায়।


মৃত মনের পোস্টমর্টেম রিপোর্টটি নিয়ে তারা বিব্রত হন।
মরা মাছের চোখের মত ফ্যাকাশে বা
আঁইশের মত জ্বলজ্বলে হয়ে তাঁরা
মানসিক পার্লারের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন।


এই নগরে এখন মনমরণের খেলা, সারি সারি শবাধারে শূন্যতা আর তার ভেতরে বিশ্রী বিশ্রী পুড়ে যাওয়া মন রাখা আছে। হে নাগরিক, তোমরা তোমাদের সেলফোনগুলো চার্জ দাও, সেখানে অবিশ্রাম তোপধ্বনি হবে আজকের ডে-লাইট-সেইভ্‌ড সূর্য ওঠার পর!
***

সোমবার, ১৪ ডিসেম্বর, ২০০৯

দ্য ওয়েল ট্যাম্পার্ড ক্ল্যাভিয়ের

আমাদের চারপাশের মানুষগুলো কেমন? 

আমি মাঝে মাঝে ভাবি আমি আজকে এখন পৃথিবীতে না থাকলে কেমন হতো? একেবারে সাধারণ ভাবনায়, শুরুতেই ধরে নেয়া যায় যে এই লেখাটা লেখা হতো না। আমি জানি আমার ভেতরে যে কথাগুলো জন্ম নিচ্ছে সেগুলো আর কেউ কোনোদিন বলে গেছে; তবে আমার মতো করে বলে নি। আর আমার মতো জীবন ঠিক আমার মতো করেও কেউ কাটায় নি। আমি যাদের সাথে মিশে মিশে, যাদের ভালোবেসে এতোটা পথ পেরুলাম তারা আমার সাথেই কেবল তেমনভাবে মিশেছে। “আর কেউ আমার জায়গা নিতে পারবে না”- পদার্থবিজ্ঞানে এই মত জানা আছে আমার। তবে কিনা, পৃথিবী ও মানুষ, তার আবেগ ও ভাবনা সবসময়ে বিজ্ঞানের কথা শোনে না। বড়ো খারাপ ও দুর্বিষহ আচরণ করে তারা অনেকেই। তাই বিজ্ঞান জানিয়ে রাখলেও আমার সন্দেহ হয়, হয়তো আমি না থাকলেও কেউ না কেউ আমার জায়গা নিয়ে নিতো!

এই ভয় থেকেই আমি হয়তো নিজেকে প্রকাশের চেষ্টা করি। ভয় তো খুব তীব্র মোটিভেটর, তাই না? আমি তাই উর্ধ্বশ্বাসে পালাই আমার হারিয়ে যাবার ভয় থেকে। আমার বিলুপ্তির খাদের কিনার থেকে আমি উলটো দৌড় দিই। আমার ফুসফুসে তেমন জোর নেই বলে সেই দৌড়ের পথে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ি বটে। তারপরে হাঁপাতে হাঁপাতেই আমি চেষ্টা করি। নিজের প্রতি কেন এতো প্রেম হায়! নার্সিসাসের জীন, বহন করছি রন্ধ্রে রন্ধ্রে! চারপাশের মানুষগুলো খুব করে আশা করছে, আমি তাদের দিকে তাকাবো, মুখে হাসি হেসে সকল ছল মুছে আমি তাদের কাছে আসবো। কিন্তু আমি কেবল নিজেকে নিয়েই ভাবছি!

আর আমিও তাদের মতো সাধারণ। তাই আমিও চাই সকলে আমাকে খুব খুব গুরুত্ব দিক, খুব মেনে নিক আমার সকল কথা। আমাকে ভক্তি করুক, আমার কথা আর চৌকস কৃতিত্বে তারা ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে এক একটা জ্বলন্ত কাঠ হয়ে যাক। আমি তাহলে এমনই নিষ্ঠুর নাকি! হয়তো তারাও এমনই নিঠুর, আমার মতোই?

আজকে খুব বাখ শুনছি। দ্য ওয়েল টেম্পার্ড ক্ল্যাভিয়ের। পিয়ানোর সুরটা খুব সাধারণ, এলিমেন্টারি। কিন্তু ওই যে বলে না, সহজ কথাই প্রাণে বাজে সবচেয়ে জোরে! রেকর্ডিঙ্গটা খুব ভালো, মনে হয় কেউ কানের কাছে প্রাণের পাশে বসেই বাজাচ্ছে। আলতো আলতো আঙুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে সুর বের হয়ে আসছে। আমি বাকি সব স্তব্ধতার মাঝেও টের পাচ্ছি হৃৎপিণ্ডের ধুকপুকানি। শীতে চারিদিক নিঃস্তব্ধ। আমি, বাখের ক্ল্যাভিয়ের, আমার হৃদয়ের স্পন্দন। আর কেউ নেই, কোথাও নেই!

ধুর, চোখে কেনো অযথাই পানি আসে?


***

বৃহস্পতিবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০০৯

ক্র্যাশ রিপোর্ট

আমার নতুন কম্পিউটারে এরই মধ্যে নানা অদ্ভুতুড়ে আর ভূতুড়ে অসুখ দেখা দিয়েছে। কেনার পরে প্রথমে দুইটা অপারেটিং সিস্টেম বসালাম, এক্সপি, যেহেতু আমি এক্সপি-কে ভালোবাসি; আর উইন্ডোজ৭, কারণ সে তন্বী তরুণীর দেহবল্লরি নিয়ে হাজির হলো। পাইরেসিকে জিন্দাবাদ বলতে আমার কোনই আপত্তি নাই, হীনমন্যতাও নাই; তাই দুইটা ড্রাইভে এক্সপি ও ‘৭’ জায়গা করে নিলো। আমি দুইখানেই যাই, ঘুরি ফিরি ভালো লাগে।


প্রথম সমস্যা শুরু হলো যেদিন থেকে লাইভ মেসেঞ্জারে কয়েকদিন ধরে ঝুলে থাকা নোটিফিকেশনের কারণে আমাকে লগইন করতেই দিলো না! বললো নতুন একটা লাইভ মেসেঞ্জার এসেছে, সেটা নামাও, নামিয়ে ব্যবহার করো। আমি সুবোধ বালকের মতন নামাতে গেলে বলে “তোমার সনাক্ত করার মতো কোন ইন্টারনেট কানেকশন নাই”। চোখ কপালে ওঠার আগেই চেক করে দেখলাম, সুন্দর ১৬কেবিপিএস গতিতে টরেন্ট নামছে! ভূতুড়ে কাণ্ডের এই হলো শুরু! এর পরে লাইভের দেখাদেখি ইয়াহু মশায়েরও মাথা খারাপ হয়ে গেলো। ফলাফল অগত্যা আমার গুগল-টক। আঙুর টক কেমন ও কত প্রকার বুঝলাম! লাইভ বন্ধ হওয়াতে আমার ওয়ান্ডারওয়াল দেখা হয় না! হলিউডি সেলিব্রেটিদের উদ্ভটতাও একটা মিস করার মতো ব্যাপার! শেষে পুরানো প্রেমিকা এক্সপি ছেড়ে ভাবলাম ‘সাত’এর কাছে যাই, পাত্তা পেতেও পারি। সাত- একটু হালফ্যাশন মানেন বলে বাংলা ফন্ট দেখতে খারাপ আসে। কত চেষ্টা করলাম বৃন্দার পাছায় লাথি মারার, ওটা ঘুরে ফিরে চলে আসে! সিয়াম রূপালি আর সোলাইমানলিপি’র মতোন অপরূপ ফন্ট থাকতে কেনো এইটা উইন্ডোজের ডিফল্ট ফন্ট হলো সেই রহস্য আজও বুঝলাম না! তবু দেখলাম এখানে সেটা সহ্য করেও লাইভ আর ইয়াহু দুইটাতেই যাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু লাইভে ঢুকে আবারও তাজ্জব হলাম, এমএসএন টুডের ট্যাবটা নাই! আজব কারিগর আমার! তাও কিছুদিন চালানো গেলো সাতে’র অপরূপতা নিয়ে। কিন্তু মিষ্টি মিষ্টি কথা আর কতদিনই বা ভালো লাগে! তাই ভাবলাম এক্সপি আরেকবার নিয়ে দেখি!


সিডি কিনতে গেলাম যেটা কিনে আনলাম, বলে NLTDR File Missing. Press ALT+CTRL+DLT to reboot!
বুঝলাম উইন্ডোজের সিডিতেও আজকাল ভুয়ামি শুরু হয়েছে। সেটআপ লোড করার প্রথম ফাইলটাই নাই!! তারপরে কচুক্ষেত মার্কেটের অগতির গতি ‘বিজনেস জোন’ নামের দোকান থেকে আরেকটা সিডি কিনলাম। খুব দোয়া পড়তে পড়তে সেটআপ দিয়ে দেখি এইটা পাইরেটেড জেনুইন কপি!!! অর্থাৎ কেউ একজন কিনেছিলেন, কিনে সেইটা জেনুইন করেছেন, নিজে নিজে ভিস্তার নানা আইকন আর থিম বসিয়েছেন, তারপরে কপি করে করে বাজারে ছেড়ে দিয়েছেন! কে বলে বাঙালির মেধা নাই, কে বলে আমরা কিছু পারি না? এত নিপুণ ও সুচারী শৈল্পিক চৌর্যবৃত্তি আর কারও দ্বারাই সম্ভব নয়। আমি তারপরে বসে বসে চুরির আলামত, অর্থাৎ সব থিম ও আইকনগুলো ডিলিট করলাম।


তবে এতোকিছুর পরেও ভবী ভুলবার নয়। এখনো লাইভ, যার জন্যে এত ঝামেলার শুরু, তিনি মুখ ফেরাননি। ভাইরাসের যন্ত্রণায় প্রায় দুইঘন্টা ধরে এভিজি ডাউনলোড করলাম। বেটা মশগুল-চোর, মিডিয়া প্লেয়ার নিয়ে ঝামেলা বাঁধিয়ে রাখায় উইনয়্যাম্প চালাতে হচ্ছে। লাইভকে আমার কম্পিউটারে না আনতে পারলে মরেও শান্তি নাই!
যে একাগ্রতায় আমি এই কম্পিউটার নিয়ে বসে আছি সেইটা অন্য কারো জন্যে দিলে সে নির্ঘাৎ আমার ভক্ত হয়ে উঠতো। আসলেই যন্ত্রের মন নাই!

বুধবার, ৯ ডিসেম্বর, ২০০৯

শব্দ পরিচয়

আমি অনেকদিন ধরেই কিছু লিখতে পারছি না। লিখতে না পারার যন্ত্রণা বা অসহায়ত্বের সাথে আমার অনেকদিনের সখ্য। এমন অনেকদিন হয়েছে, আমি দিনের পর দিন লিখতে পারি নি। আমার চারপাশে যারা লেখেন, তারা খুব চমৎকার লেখা পাতার পর পাতা লিখে ফেলেছেন। আমার তেমন কিছু মনে হয় নি। অন্যের লেখা পড়েও আমি টের পেয়েছি আমার ভেতরে কোনো শব্দ নেই। কোন সুর নেই। তাই আমি চুপচাপ হয়ে গেছি। আরো কিছুদিন পরে একটা সময়ে অনেক অনেক কথা ঘুম ভেঙে আমার মাথায় চলে এসেছে। তখন আমি আবার লিখতে শুরু করেছি। লিখতে লিখতে আমি ভুলে গেছি যে মাঝে কিছুদিন আমি শব্দহীন হয়ে কাটিয়েছিলাম! এমন সময় আসলে তাই আমি এখন একেবারেই বিচলিত হই না। ভাবি, যে কিছুদিন পরেই এই সময়টা কেটে যাবে। কেটে গেলে আমি কী কী লিখবো সেটা নিয়েও অনেক সময়ে আমি চিন্তা করেছি। কিন্তু এবারে কেনো জানি সেই চিন্তাগুলোও হচ্ছে না! আমি টের পাচ্ছি আমার ভেতরে কোনো শব্দ আসছে না। শব্দহীন হয়ে গেলে আমার কানের ওপর কেমন যেনো একটা চাপ পড়ে। মনে হয় একগাদা তুলো দিয়ে কেউ আমার কানে ধুম ধুম হাতুড়ি পেটা করছে।


শীত এলেও আমার এই অনুভব শুরু হয়। মনে হতে থাকে যে মাথায় ড্রামের বাড়ি পড়ছে। বড়ো একটা বিগ-ড্রাম নিয়ে রিজওয়ান যেভাবে তালে তালে বাড়ি দিতো, সেভাবে কেউ একজন বাড়ি দিচ্ছে। আমি রিজওয়ানের পাশেই বাঁশি নিয়ে দাঁড়াতাম বলে টের পেতাম ড্রামের সেই বাড়িগুলো কেমন করে বুকে এসে লাগে। শব্দের শক্তি নিয়ে আমার সকল সংশয় কেটে যেতো! রিজওয়ান এখন ফাইটার প্লেন চালায়। শাঁশাঁ করে ও যখন ছুটে বেড়ায় ‘বাংলার আকাশ রাখিবো মুক্ত’ শ্লোগান নিয়ে, আমার তখন খুব হিংসা হয়। ছেলেটা সারাজীবন শক্তিশালী শব্দ তৈরি করেই গেলো! আমি তেমন পারি না। আমার তৈরি করা শব্দেরা মৃদুমন্দ, লাজুক ও বিনম্র। খুব বেশি চিৎকার করলেও, হা হা করে অট্টহাসি দিলেও, আমি লিখতে গেলে খুব সোচ্চার হতে পারি না। আমার মনে হতে থাকে খুব জোরে বললে হয়তো কথাটার জোর কমে যাবে। হয়তো আমি যা বললাম, তুমি বা তোমরা সেটা বুঝবে না। ধরতেই পারবে না আমি কী অসম-সম্ভব তুলনা বুনছিলাম, রূপকের কত নিখুঁত রূপে মুগ্ধ হচ্ছিলাম! খুব জোরে বললে সেটা ঝাপসা হয়ে যায়।


এই শীত আর লেখাহীনতা তাই আমাকে অনেক কাবু করে ফেলছে। বুড়ো দাদুর মত আমি বেঁকে যাচ্ছি ভেতরে ভেতরে। এগুলো অর্থহীন বিলাসিতা, আমি জানি। আমার অস্তিত্বের টিঁকে থাকার জন্যে একেবারেই বাতুল-চিন্তা। তাই কাউকে হয়তো বলা হয় না। খুব প্রিয় মানুষটাকেও বলা হয় না। আসলে বলার তেমন কিছু নেইও। এমন না যে বলার সাথে সাথে সমস্যা দূর হয়ে যাবে। বা কারো সাথে এটা আলোচনা করলে, শেয়ার করলে একটা সুরাহা বের হবে। এই সমস্যা এতই বালখিল্য যে এটার গুরুত্ব কেবল আমার নিজের কাছেই। নিজে নিজে বুঝে গেছি, হয়তো একদিন এমনি এমনিই ঠিক হবে, তবে কীভাবে আর কবে হবে এটা আমার জানা নেই। জানা নেই বলেই আমি অপেক্ষা করি। কারো আগমন নিশ্চিত জেনে যে রকম অপেক্ষা করা দরকার, ঠিক তেমন। কান সতর্ক, ইন্দ্রিয় সজাগ করে হিম হিম শীত আর চাপ চাপ নৈঃশব্দ্য পাশে বসিয়ে আমি অপেক্ষা করি। আমি খুব ভালো করেই জানি আমার এই অপেক্ষা খুব শিগগিরই শেষ হবে। তারপরে নানান শব্দ আর সুর, রঙ আর রূপ আমার কাছে চলে আসবে। আমি আবার লিখতে শুরু করবো। প্রতিবার এমন বিরতির পরে আমার লেখা বদলে বদলে যায়। এবারেও যাবে আর আর সেই বদলে যাওয়া লেখাগুলো আমার ভালো লাগবে!


প্রিয় শব্দেরা, তোমরা সশব্দে এসো আমার ঘরে!

মঙ্গলবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০০৯

ফ্ল্যাশ ব্যাক

আজকে কেমন ঝটিতি দিন কাটছে!


মনে করেছিলাম আজকে সকাল সকাল উঠে ইউনি যাবো। ইউনিতে অনেক টুকরো টুকরো কাজ জমে আছে। বেশ কিছু খাতা দেখা বাকি, ঈদের আগে মিড নিয়েছিলাম। কয়েকটা নতুন লেকচারও বানাতে হবে। গত কয়েদিন ঠিক বারোটার আগে পরে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম বলে সকাল সকাল উঠে কনফিডেন্স বেড়ে গিয়েছিলো! কিন্তু আজকে আবার পুরানো রোগে পেলো  আমায়। ঘুম আর ঘুম। ঘুম কেটে দিতে দুয়েকবার ফোন বেজে উঠেছিলো ডেক্সটারের থিম-এ। আফরীনের ফোন। আমি নাকি ধরেওছিলাম, ঘুমের মধ্যে ফোন ধরলে, কথা বললে আমার মনেই থাকে না! তারপরে সুবোধ বালকের মতো আমি আবার ঘুমিয়ে পড়েছি কখন। শেষে আবার তারস্বরে চেঁচিয়ে উঠলো ফোন আর আমিও ঘুম ভেঙে ধড়মড়িয়ে উঠলাম। ঘুমের মধ্যেও তাহলে দেহঘড়ি চালু থাকে? ঠিকই টের পাওয়া যায় যে অনেক দেরি হয়ে গেছে! আজব কারখানা আর তার মহা-আজব ব্যাপার-স্যাপার।


ঘুম থেকে ঝট করে উঠেই দৌড়াদৌড়ি লেগে গেলো। ৩০ মিনিটের মধ্যে আমি ফিটফাট, বাবু। বাসা থেকে বের হয়ে তাজ্জব হয়ে গেলাম। কুয়াশা কুয়াশা রোদ!! রোদ কেমন ফিল্টার হয়ে এসে গায়ে পড়ছে। আমার চমৎকার লাগলো। রিকশা করে ইউনি পৌঁছানোর পথে বাবুস্কুল। ফিনফিনে শৈশবের সাথে হুটহাট দেখা হয়ে যায় ওখানে। আমি তৃষিতের মতো চেয়ে থাকি। লাল-সাদা ডোরাকাটা জামা পরে একটা বছর পাঁচেকের ছেলে বোনের হাত ধরে যাচ্ছে। দুরন্তপনায় বার বার বোনের হাত ছুটে যাচ্ছে। আমার সাথে ছেলেটার একবার চোখাচোখি হলো, বড় বড় টলটলে চোখ। মাথার চুলগুলো এলোমেলো, আমার খুব আপন মনে হলো ছেলেটিকে। রিকশা পেরিয়ে যাবারও আরো কিছুক্ষণ পর পর্যন্ত আমি তার কথা ভাবছিলাম!


অফিসে এসে একদণ্ড শান্তি নেই, ঝড়ের বেগে কাজ করতে করতে ভালই লাগছিলো। দুপুরে একটা ফাস্টফুডের দোকানে খেতে গেলাম, হাতে সময় ১৫ মিনিট। ১৫ মিনিটে খেয়েই অফিসে ফিরতে হবে বলে একটা বার্গার আর ফ্রাইড চিকেন বরাদ্দ হলো। কোনোদিকে না তাকিয়ে কোণের চেয়ারে বসে গপাগপ গিলছি। সামনের টেবিলে একটা ছেলে আর মেয়ে মুখোমুখি বসা, আমি কেবল ছেলেটার মুখ দেখতে পাচ্ছি। একটু পরে মেয়েটার গলার স্বর চেনা চেনা লাগলো, বাঁকা হয়ে চেয়ে দেখি শান্তা! স্কুল থেকে পরিচয়, ম্যাবস-কোচিঙয়ের কালঃ আটানব্বুই-নিরানব্বুই! ও সম্ভবত আমার অফিসের গলিতেই অন্য কোনো খানে চাকরি করে, আগেও একদিন দেখেছিলাম হন হন করে হেঁটে যাচ্ছিলো। আজকে আমি এতো ব্যস্ত যে কথাই বলতে পারলাম না। বার্গারে মনোযোগ দিলাম। তবে ঘাসপাতা মেশানো মাংশ চিবুতে চিবুতে মনে পড়ছিলো ফার্মগেইট, মোস্তফা, শিশির, রাহুল, ত্রিমিতা, পুষন, আলম…


স্মৃতি বড়ো বেমক্কা! এই তাড়াহুড়ার মাঝে আমাকে স্থবির করে দিলো!

সোমবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০০৯

শিরোনামহীন দু'খানা




অনেকদিন ধরে ঘুম ঘুম জেগে থাকা আর হঠাৎ জেগেই টের পাওয়ার দুঃসহ কাল কেটেছে তার,
তারপর অনেক ক্লান্ত হয়ে সূর্য ওঠার পরে সে অনায়াসে ঘুমোতে গেছে ভারী নীল পর্দাগুলো টেনে
মাঝে মাঝে এলোবাতাসে কুঁচো রোদ, নীল পর্দার গরাদের ফাঁক দিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছে
তার ঘুম ভাঙেনি, সারা রাতের ক্লান্তি আঠার মতো পাঁপড়ির ভাঁজে মিশে ছিলো, তবু সে মনে হয়
টের পেয়েছে আলোর আসা-যাওয়া আর চুরি করে তাকে দেখে ফেলাঘুম ভেঙেছে বহুদিন, সন্ধ্যে
পেরিয়ে শহর যখন গাঢ় আঁধার মাখছে, সাথে আরো মাখছে প্রসাধনী রূপসী মেয়েগুলো যেমন মাখে,
ঠিক তখন হঠাৎ চোখ খুলে সে জানালায় গোলানো লাল লালাভ আলো দেখেছেখুব ধীরে জেনেছে
এভাবে রোজ যেমন শহর সেজে ওঠে তখন তার ঘুম ভাঙেআমি আগেই জানি কারণ সবসময়েই তার
অপেক্ষায় থাকি, দুচোখ মেলে কাতর চেয়ে থাকি সে কখন উঠে বসবে, দু'হাত তুলে তার আড়মোড়া
ভাঙার ভঙ্গিতে দারুণ কমনীয় কামনার পালক লেগে আছেদেখো আমি কেমন অজান্তে ভেসে যাচ্ছি
তার ছড়িয়ে দেয়া আঙুলের নখ ছুঁয়েওড়বার বিলুপ্ত সাধ কোন অজানা কোণে লুকিয়ে ছিলো, ঘুম ঘুম!






তিনি দেখলেন দেয়াল ঝাপসা দুলছে
সরল দোলন শিখে ফেলা চোখ দেয়ালের শরীর
চেটে দেখে সেখানে কতটা হিম
কতটা বিভ্রান্ত ত্রুটি ঘটেছে

আজকাল তাঁর চোখের সামনে
মানুষ ও মানুষের মুখ হেসে ওঠে, স্বৈরিণীর মত
ক্রোধগুলো জেগে ওঠে তাঁর, কাটামস্তক
একে একে তুলে আনেন, আমি দেখি গলার নিচে
টপটপ কালো রক্ত ঝরছে

দেয়ালে সারি সারি আমাদের ছিন্ন মাথা ও চোখ তখনো হাসছে

***