রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০০৮

পাপবোধ সংক্রান্ত টুকিটাকি বা হেনো তেনো


আমার পাপবোধের অনুভূতিটা বেশ টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। আসলে চারপাশের মানুষগুলোর সাথে দিন দিন সম্পৃক্ততা কমে যাবার ফলেই মনে হয় এমন চিন্তার মোড় ঘুরে যাওয়ার সূত্রপাত।


পাপবোধ খুব সম্ভব একটা আপাত আরোপিত অনুভূতি। একটা শিশু কখনোই এই চেতনার অধিকারী হয়ে জন্মায় না। ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে ওঠার সময়টাতে, রঙ-রূপ-বর্ণ-শব্দগুলো চিনে চিনে চারপাশকে বোঝার সময়টাতে কোন এক অদৃশ্য প্রক্রিয়ায় এই অনুভূতি তার ত্বকে অভিস্রবণের মতো ঢুকে যেতে থাকে। মনে হয় সে নিজেও টের পায় না সে কখন পাপী হতে শুরু করে- কিংবা বলা যায় নিজেকে কখন পাপী ভাবতে শুরু করে।


একটি শিশু বড়ো হয়ে উঠতে উঠতে নিজেকে একটা সময় দোষী ভাবছে এই চিন্তাটা পীড়াদায়ক। তার স্বাধীনতার পরিপন্থীও বটে। কেননা মূলত শিশুদের দ্বারা আমরা ক্ষতিগ্রস্থ হই না। নিতান্ত দুরন্ত শিশুও তুচ্ছ বা মূল্যবান তৈজস ভেঙে ফেলা ছাড়া তেমন কোনও গুরুতর অপরাধ করে না। অথচ সেই সময়টায় তাকে বেশ বিরূপতা পেতে হয়, বাবা-মা- বড়োদের কাছ থেকে। শিখে নিতে হয় উচিত-অনুচিতের লিস্টি। মা-বাবা শিখিয়ে দিতে থাকেন, চলা-বসা-কথা-হাঁটা-থামা। অপরাধী সত্ত্বাটির হয়তো তখনই জন্ম ঘটে।


উচ্চারণে যেসব শব্দেরা দূষিত, বা পঙ্কিল সেগুলো আমরা বড়োরা খুব সযত্নে পরিহার করতে চেষ্টা করি একটা শিশুর সামনে। কেননা একটা সময়ে সে আমাদের সামনে কুৎসিত সেই শব্দ বা ভঙ্গিগুলো শিখে ফেলবে এটা জানার পরেও আমরা সেগুলো যতটা সম্ভব আড়াল করতে চাই। কিন্তু এতে করে যখন তারা শব্দগুলো শেষমেশ শিখেই যায়, তখন সেগুলোকে পরিচয়পত্রসহই শিখে নেয়। এমনকি অভিধানেও আমরা তাদের সেভাবেই চিহ্নিত করে রেখেছি।


এত গেল শব্দেরা, আশেপাশের দৃশ্যাবলিও যথেষ্ট কুৎসিত আমাদের এই জনপদে। বিরাট আকাশ-সংস্কৃতি না হয় ছেড়ে দিলাম, সচেতন অভিভাবকেরা হয়তো বেছে বেছে কাদা-ময়লা এড়িয়ে চলেন। কিন্তু রাস্তাঘাটে, বাজারে, দপ্তরে আমরা ক্রমশই অশ্লীল হয়ে উঠছি দিনে দিনে। ইদানীং কিছু পোশাকে নগ্নতা দারুন প্রকাশ পায়। গোপন রতিতে হয়তো তা দারুন কামনাজড়িত সুখের প্রভাবক হবে, হয়তো পুরুষ বা নারীটির সঙ্গীর দ্বারা প্রশংসিতও। কিন্তু প্রকাশ্যে আমরা চোখ দিয়ে চেটে-পুটে খেয়ে নিতে নিতে ভুলে যাই, পাশেই কোমর-উচ্চতার ছেলেটি বা মেয়েটিও দুচোখে গিলছে। তার দুচোখে নেমে নেমে পড়তে থাকা যুবকের প্যান্ট, আর উঠে উঠে যেতে থাকা যুবতীর টপস্‌ খুব সহজেই জানলা খুলে হাট করে তীব্র রোদ ঢুকিয়ে দিচ্ছে। সাথে করে ব্রীড়াজনিত সঙ্কোচটুকুও ঝরে পড়ছে।


আমরা এগোচ্ছি সামনে, ধীরে ধীরে আমাদের পদক্ষেপের দ্রুততা বাড়ছে। সেক্ষেত্রে বাইরের জগতের আলো প্রবেশ করার সময়ে অতিবেগুনিরশ্মির মতো কিছু রঙ আমাদের বালক-চোখদের খুব দ্রুতই বয়স্ক করে দিচ্ছে। আমি জানি এটা ঠেকানোর কোনও উপায় নেই। ফ্যাশন নামক বিদঘুটে অসংজ্ঞায়িত শব্দটির ফাঁদে পড়ে অশ্লীলতা ক্রমশই শ্লীল হয়ে যায়।


বালক থেকে বড়ো হয়ে উঠলেই অনেকটাই আগল খুলে যায়। অনেক আপাত রহস্যেরা সহজ-কঠিন সত্যরূপে প্রকাশ পায়। শরীর সশব্দ হয়। সেসময়ে ভাঙা-গড়ার খেলা খেলতে খেলতে একেকজনের নিজস্ব পাপবোধ গড়ে উঠে। এখানে ধর্ম হয়ত একটা বিরাট সর্বগ্রাসী ভূমিকা পালন করে। স্কুলের নতুন-বদলি-হয়ে-আসা হেডমাস্টারের মতন খুব সীমা-নির্ধারিত হয় সবকিছুর। ভালো-মন্দকে বার্লিন দেয়াল তুলে আলাদা করে দেয়া হয়। তবে আগের এই একচেটিয়া অধিকারটুকু ধর্ম দিন দিন হারাচ্ছে। সেটা কতটা হতাশার বা কতটা আশার তার তুলনা করা সম্ভব না। তবে তার মসনদে নতুন যে বসবে তাকে ভালভাবে চিনে নেয়াটা জরুরি। আমরা যখন এক স্বৈরশাসককে সরিয়ে আরেক স্বৈরশাসক টেনে আনি- তখন অনেকসময় বেশ দেরিতে টের পাই, আগেরজনই ভালো ছিলো!


ধর্ম খুব প্রয়োজনীয় রূপ ছেড়ে এই ঢাকা শহরের ইট-কাঠের চাপে পড়ে জুম্মাবার আর রোজার মাসে আটকে যাচ্ছে। অন্য ধর্মগুলোর পালন অতো প্রবল নাই। গুরুজনেরা বলেন, আগে সেগুলোর অনেক উচ্ছ্বাস এখন গলাবন্ধ কোটের মতন গরমে আটকে হাঁসফাঁস করছে। আর ইসলাম দারুন জোশে ছড়িয়ে পড়ছে। ব্যক্তির পালনের মাঝে ধর্মই ঠিক করে দেয় পাপবোধ কেমন হবে। দিনের পর দিন নামাজ ক্বাযা করে আমাদের ত্বকে যে বোধ আঁচড় কাটে না, সেই বোধই সাঁড়াশি আক্রমণ চালায় একদিন রোজা না রাখলেই (যদিও দুটোর মূল্যমান ধর্মমতে সমান)! এখন আমাদের ক্ষয়িষ্ণু প্রজন্ম সেটাও মানছি না। সমস্ত মাল্টিমিডিয়ার তোড়ে নিবিড় ধর্মপালন বইয়ে চাপা-দেয়া ফুলের পাঁপড়ি হয়ে গেছে। সেখানে ধর্মের সামাজিক উচ্চারণ প্রবল উচ্চকিত।


এখানে তখন মনে হয় কোন বোধে তাহলে আজ আমরা নিজকে যাচাই করি? কেউ কেউ হয়ত মধ্যবিত্ত মূল্যবোধগুলোকে আষ্টেপৃষ্ঠে আঁকড়ে ধরছে। বাবা-মায়েরা কুইনাইন-গোলানো গ্লাসে করে তা সন্তানকে গিলিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তার মধ্যেও এর রূপ পরিবর্তিত হয়। মানুষ থেকে মানুষে যাবার সময়ে বোধেরা বদলে যায়। নজরুল-রবীন্দ্র-গানেদের রিমিক্সের মতোই! বিলাসিতার মাত্রা আর অপচয়ের পরিসীমা নতুন করে নির্ধারিত হয়। টাকার গন্ধ অনেকটা আফিমের মতো রক্তে প্রবেশ করলে আমরা তাতে বিমোহিত আচ্ছন্ন হতে থাকি আর ক্রমশ ভুলে যাইঃ আমাদের প্রপিতামহেরাও দুপুরে খররোদে ঝলসে যেতে যেতে লাঙলে কাঁধ জুড়ে ঠেলে ঠেলে নীরস মাটি খুঁড়ে সোনা ফলাতেন। তার ত্বকের কালোরঙা জিন আমার অসূর্যম্পশ্যা মাতামহী-মাতার শরীর ঘুরে আমার মাঝে আসতে আসতে চাপা পড়ে গেছে। দুধ-সাদা ত্বকে ঘামেরা জমতেও পারেনা। তাই টিনটেড গ্লাসের ওইপাশে দাঁড়ানো বৃদ্ধ হাত বাড়ালে তাকে আমরা চিনতেও পারি না।


এভাবে ভাবনাটা খুবই একপেশে মনে হয়। একটা এক্সট্রিম-কে প্রকাশ করতে মনে হয় আরেকটা এক্সট্রিম-কে টেনে আনতেই হয়। রুপোর টাকার ঝনঝনানিতে কানে তালা লেগে যেতে যেতে আমরা পাপবোধ কাটিয়ে উঠতে থাকি। এই জনপদের অনেক নিচে, অনেক গভীরে আমাদের প্রপিতামহেরা হাড়-গোড়ে শুয়ে থাকতে থাকতে কেবলই ক্ষয়ে যেতে থাকেন!




***

২টি মন্তব্য:

  1. লেখাটা ভালো লাগলো। এমনিতে আমার অভ্যাস খারাপ, অযথা তর্কাতর্কি করি লেখা নিয়ে। তবে প্রথম দিন তাই আপনাকে কিছু রেয়াত করা যেতে পারে।

    আরো কিছু ব্যাপারঃ
    * ব্লগের টেম্পলেট সুন্দর
    * নিজেকে নিয়ে লেখা কথাগুলি সুন্দর
    * তবে প্লেসিং ঠিক হয় নি মানে লেখাগুলিকে বামে অথবা ডানে চাপাতে পারতেন।

    লেখা নিয়ে সিরিয়াস ভাবনার কথা না হয় সামনের কোন একদিনে জানাবো।
    আপাতত কুইজ, বলুন তো আমি কে ?

    উত্তরমুছুন
  2. আমি কুইজে খুবই খারাপ! আপনার মন্তব্য বেশ অপ্রত্যাশিত আনন্দ দিল। সেজন্য ধন্যবাদ। তবে পরিচয়টি দিলে স্বস্তি বাড়তো।

    উত্তরমুছুন